পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধরত রুশ ভাড়াটে সেনাদলে রয়েছে পাকিস্তানি নাগরিক। খোদ ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির এ-হেন দাবি ঘিরে দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, এর মাধ্যমে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে চাইছে ইসলামাবাদ। ক্রেমলিন ও নয়াদিল্লির ‘বন্ধুত্বে’ চিড় ধরানোই যে তাদের উদ্দেশ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে ঘটনাপ্রবাহের উপরে কড়া নজর রাখছে ভারত।
সম্প্রতি, উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের খারকিভ এলাকার যুদ্ধ নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন জ়েলেনস্কি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘মস্কোর ফৌজের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছে রুশ ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী, যাতে রয়েছে একগুচ্ছ দেশের নাগরিক।’’ এর পরেই ক্রেমলিনের ভাড়াটে বাহিনীতে চিন, তাজ়িকিস্তান, উজ়বেকিস্তান এবং আফ্রিকার দেশগুলির পাশাপাশি পাক নাগরিকেরা রয়েছেন বলে স্পষ্ট করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। পরে এই ইস্যুতে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর করা একটি পোস্টও।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যেই বাহিনীর মনোবল বাড়াতে ১৭তম সেপারেটেড মোটরাইজ়ড ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নের অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করেন জ়েলেনস্কি। সূত্রের খবর, সেখানেই ওঠে মস্কোর ভাড়াটে সেনার প্রসঙ্গ। পরে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) এ প্রসঙ্গে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘‘খারকিভে আমাদের যোদ্ধাদের চিন, তাজ়িকিস্তান, উজ়বেকিস্তান, পাকিস্তান এবং আফ্রিকার দেশগুলির নাগরিকদের নিয়ে তৈরি ভাড়াটে সেনাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রণাঙ্গনে আমরা তাদের জবাব দিচ্ছি এবং দিয়েও যাব।’’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পাকিস্তানের ‘এন্ট্রি’ অবশ্য নতুন ঘটনা নয়। ২০২৩ সালে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে কিভকে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ সরবরাহের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি নিয়ে ওই সময়ে একটি বিস্ফোরক রিপোর্ট প্রকাশ করে মার্কিন অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’। সেখানে বলা হয়, একটি গোপন চুক্তির মাধ্যমে এ ব্যাপারে পাক সরকার এবং সেনাকে রাজি করায় আমেরিকা। অস্ত্র সরবরাহের বিনিময়ে ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড) ঋণ নিশ্চিত হয়েছিল।
২০২৩ সালে এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে বিবিসি উর্দু। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনে ১৫৫ মিলিমিটারের কামানের গোলা এবং রকেট সরবরাহের জন্য মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি করে পাকিস্তান। এই অস্ত্র ব্যবসায় ইসলামাবাদের আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ কোটি ৪০ লক্ষ ডলার। দু’বছরের মধ্যেই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে রুশ ভাড়াটে সেনায় পাক নাগরিকদের ঢুকে পড়া নিয়ে তাই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
চলতি বছরের ৫ অগস্ট এই ইস্যুতে মুখ খোলে ইসলামাবাদ। একটি বিবৃতিতে পাক বিদেশ মন্ত্রক জ়েলেনস্কির দাবিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। শাহবাজ় শরিফ সরকারের দাবি, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে পাকিস্তান। সেখান থেকে সরে আসার প্রশ্ন নেই। এর আগেও কিভকে হাতিয়ার সরবরাহের বিষয়টি অস্বীকার করেছিল ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উঠেপড়ে লেগেছে পাকিস্তান। সেই আবহে জ়েলেনস্কির অভিযোগকে একেবারে উড়িয়ে দিতে নারাজ দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। গত ১০ জুলাই মস্কোর পাক দূতাবাসে ক্রেমলিনের সঙ্গে ইস্পাত শিল্প সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সেরে ফেলে ইসলামাবাদ। এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন খাতে বইতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
গত শতাব্দীর ‘ঠান্ডা লড়াই’-এর সময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক ছিল একরকম আদায় কাঁচকলায়। ১৯৫৪ সালে এশিয়ায় মার্কিন শক্তিজোট ‘কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা’ বা সেন্টো (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) এবং ১৯৫৫ সালে ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা’ বা সিয়াটোর (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সদস্য হয় ইসলামাবাদ। এশিয়ায় মস্কোর প্রভাব কমাতে সংশ্লিষ্ট সামরিক চুক্তিগুলি করেছিল আমেরিকা। ফলে ক্রেমলিনের সঙ্গে বাড়তে থাকে ভারতের ঘনিষ্ঠতা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর এই পরিস্থিতিতে আসে ব়ড় বদল। ওই লড়াইয়ে ভারতের কাছে সম্পূর্ণ ভাবে পর্যুদস্ত হয় পাকিস্তান। সংঘাতের সময় খোলাখুলি ভাবে আমেরিকাকে পাশে পেয়েও বাজি ঘোরাতে ব্যর্থ হয় ইসলামাবাদ। অন্য দিকে, সোভিয়েতের সাহায্য নয়াদিল্লিকে প্রথম থেকেই এগিয়ে রেখেছিল। ফলে ওই বছরই পুরনো সংঘাত ভুলে প্রথম বার মস্কোর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে পাক সরকার।
১৯৭১ সালে সোভিয়েতের সহায়তায় তৈরি হয় ‘পাকিস্তান স্টিল মিল্স’ বা পিএসএম। একে ইসলামাবাদ দুই দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক বলে তুলে ধরেছিল। ২০১৩ সালে ১১ হাজার ৮৭০ কোটি পাকিস্তানি রুপির রেকর্ড লোকসানের মুখে পড়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এর জন্য দায়ী ছিল বিশ্বব্যাপী মন্দা ও অব্যবস্থা। ফলে ইস্পাত উৎপাদন কেন্দ্রটির পুনরুজ্জীবন এবং আধুনিকীকরণের জন্য ফের মস্কোর দ্বারস্থ হয় ইসলামাবাদ।
কিন্তু, বর্তমানে একরকম খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে পাক অর্থনীতি। ফলে ব্যবসায়িক চুক্তির বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং রাশিয়ার মতো ‘সুপার পাওয়ার’গুলিকে তোষামোদ করা ছাড়া ইসলামাবাদের কাছে অন্য রাস্তা খোলা নেই, যার জেরে মস্কোর সঙ্গে ইস্পাত কারখানা সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ক্রেমলিনের হয়ে পাক নাগরিকেরা অস্ত্র ধরলে আশ্চর্যের কিছু নেই, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পাকিস্তানের ওই ইস্পাত কারখানাটির পুনরুজ্জীবন সংক্রান্ত চুক্তিতে আগ্রহী ছিল চিনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই দৌড়ে ছিটকে পড়ে বেজিং। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে আমেরিকা ও চিনের বাইরে নতুন ‘বন্ধু’ পেতে আগ্রহী ইসলামাবাদ। সেই উদ্দেশ্যে মস্কোর সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি শুরু করেছে ভারতের এই পশ্চিমের প্রতিবেশী।
তবে পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা ও চিনকে একপাশে রেখে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া বেশ কঠিন। কারণ, ইসলামাবাদের অর্থনীতি অনেকাংশেই এই দুই দেশের উপরে নির্ভরশীল। দেউলিয়ার হাত থেকে বাঁচতে গত কয়েক বছরে বেজিং ও ওয়াশিংটন থেকে ঋণের পর ঋণ নিয়েছে পাক সরকার। তা ছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আইএমএফ বা বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে অর্থ পেতে যুক্তরাষ্ট্র বা চিনের মুখাপেক্ষী হতে হবে ইসলামাবাদকে।
অন্য দিকে, ভাড়াটে বাহিনীতে পাক নাগরিকদের ‘এন্ট্রি’ থেকে শুরু করে ইস্পাত কারখানা নিয়ে দুই দেশের চুক্তির প্রভাবে ভারত-রুশ সম্পর্কে ফাটল ধরার আশঙ্কা খুবই কম। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে মস্কো ও নয়াদিল্লির সম্পর্কে কখনওই কোনও চড়াই-উতরাই আসেনি। উল্টে আর্থিক সঙ্কট হোক বা জাতীয় সুরক্ষায় হাতিয়ার— প্রয়োজনের সময়ে সেগুলি সরবরাহ করে গিয়েছে ক্রেমলিন।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রি করে চলেছে রাশিয়া। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লির সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে জড়িয়েছে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি, অবিলম্বে মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি বন্ধ করুক ভারত। কারণ, তেল বিক্রি করে যুদ্ধ চালানোর যাবতীয় খরচ হাতে পাচ্ছে ক্রেমলিন।
কিন্তু, ট্রাম্পের এই হুমকি উড়িয়ে নয়াদিল্লি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফলে এ দেশের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। পরে তা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হয়। আমেরিকার এই পদক্ষেপের পর তড়িঘড়ি রাশিয়া সফরে গিয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) অজিত ডোভাল এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
ট্রাম্পের হুঁশিয়ারির পর নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দেয় রাশিয়া। মস্কো জানিয়েছে, ভারতের মতো সার্বভৌম দেশ কার থেকে খনিজ তেল আমদানি করবে, সেটা অন্য কেউ নির্দেশ দিতে পারে না। ২০০৯ সালে রাশিয়ার উদ্যোগে তৈরি হয় ‘ব্রিকস’ নামের একটি সংগঠন। তাতে ব্রাজ়িল, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি রয়েছে ভারতও। বর্তমানে ‘ব্রিকস’-এর মোট সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০।
ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক আরও মজবুত করেছে রুপি ও রুবলের বাণিজ্য। দুই দেশই নিজেদের অর্থে পণ্য লেনদেন করছে। মস্কোর অবশ্য ‘ব্রিকস মুদ্রা’ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে অবশ্য এখনও সবুজ সঙ্কেত দেয়নি নয়াদিল্লি। অন্য দিকে, এই পরিস্থিতিতে আরও তীব্র হয়েছে পাকিস্তানের মার্কিন প্রেম। চলতি বছরে দ্বিতীয় বারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের।
সব ছবি: সংগৃহীত।