পশ্চিম এশিয়ায় ইরান-ইজ়রায়েলের পর এ বার মধ্য আফ্রিকা। গত কয়েক দশক ধরে চলে আসা রোয়ান্ডা এবং ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর (ডিআরসি) মধ্যে ‘যুদ্ধ’ থামালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘অন্ধকার মহাদেশে’ হিংসার বীভৎস চেহারা সহ্য করতে না পেরেই কি এই পদক্ষেপ? না কি ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাটির রয়েছে অন্য কোনও ছক? ওয়াশিংটনের শ্বেত প্রাসাদে (হোয়াইট হাউস) দু’পক্ষের শান্তিচুক্তিতে তাঁর মধ্যস্থতাকে ইতিমধ্যেই ‘বাঁকা চোখে’ দেখতে শুরু করেছেন কূটনীতিকদের একাংশ।
চলতি বছরের ২৭ জুন মার্কিন মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তিতে সম্মত হয় যুযুধান রোয়ান্ডা এবং ডিআরসি। বিশ্লেষকদের দাবি, এই সংঘাত বন্ধ করার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দ্বিমুখী উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার বিখ্যাত সুবিশাল ‘গ্রেট লেক্স’ এলাকার বিরল খনিজ ভান্ডারের দিকে নজর পড়েছে তাঁর। দ্বিতীয়ত, সেখানে চিনের প্রভাব কম করতে চাইছেন তিনি। এই শান্তিচুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টের স্বপ্নপূরণ হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই মনে করছেন ধুরন্ধর কূটনীতিকেরা।
গ্রেট লেক্স অঞ্চলটিকে আফ্রিকার ‘হৃৎপিণ্ড’ বলা যেতে পারে। সেখানে রয়েছে মিষ্টি জলের একাধিক হ্রদ। এর মধ্যে সর্ববৃহৎটির নাম ভিক্টোরিয়া। আফ্রিকার অন্যতম বিখ্যাত এই হ্রদটির আয়তন ৫৯ হাজার ৯৪৭ বর্গ কিলোমিটার। দ্বিতীয় স্থানে টাঙ্গানিকা হ্রদ। ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তার। গ্রেট লেক্স অঞ্চলকে ঘিরে রেখেছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির ১০টি রাষ্ট্র। সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল ডিআরসি এবং রোয়ান্ডা।
এ-হেন গ্রেট লেক্স অঞ্চলের দু’টি দেশের সীমান্ত সংঘর্ষ থামাতে হঠাৎ কেন উঠেপড়ে লাগলেন ট্রাম্প? সরকারি তথ্য বলছে, রোয়ান্ডা সীমান্ত লাগোয়া ডিআরসি ভূখণ্ডে মজুত রয়েছে দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি কোবাল্ট ও কোল্টন। এ ছাড়া সোনা, তামা এবং লিথিয়ামের মতো খনিজ সম্পদের বিরাট ভান্ডার রয়েছে সেখানে। অভিযোগ, স্থানীয় বিদ্রোহীদের কাজে লাগিয়ে সেগুলি কব্জা করার মতলব করছে চিন। আর তাই চুপ করে বসে না থেকে শান্তিচুক্তির অছিলায় আফ্রিকায় ‘দাবার চাল’ দিল ওয়াশিংটন, বলছেন কূটনীতিকেরা।
বর্তমানে বিশ্বের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কোবাল্ট সরবরাহ করে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি)। কিন্তু মধ্য আফ্রিকার দেশটির ৮০ শতাংশ কোবাল্ট খনির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বেজিঙের সরকারি সংস্থার হাতে। তামা উত্তোলনের ছবিটাও একই রকম। ডিআরসির তাম্র এবং কোল্টন খনির ৮০ শতাংশ দখল করে রেখেছে ড্রাগন সরকার। পাশাপাশি সোনা, লিথিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ দ্রব্যের উত্তোলন এবং ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বিপুল লগ্নি রয়েছে চিনের।
পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, আফ্রিকার ওই এলাকার খনিজ সম্পদ হাতে পেতে ৪৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে বেজিং। মাটির গভীর থেকে উত্তোলনের পর কোবাল্টকে সরাসরি ব্যবহার করা যায় না। সেগুলিকে পাঠাতে হয় শোধনাগারে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ডিআরসির অধিকাংশ কোবাল্ট শোধনাগার চালায় চিন। সেখান থেকেই সারা বিশ্বের ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ বিশুদ্ধ কোবাল্ট সরবরাহ করে ড্রাগনভূমির একাধিক সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা।
আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোবাল্ট, কোল্টন এবং লিথিয়ামের মতো বিরল ধাতুগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। ইলেকট্রিক ভেহিকল বা ইভির ব্যাটারি নির্মাণে এগুলি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নির্মাণ বা মহাকাশ গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রে বিরল ধাতুকে কাজে লাগান বিজ্ঞানীরা। মোবাইল ফোন, কম্পিউটার বা ল্যাপটপের মতো নিত্যদিনের ব্যবহার্য বৈদ্যুতিন সামগ্রী তৈরিতেও কাজে লাগে কোবাল্ট, কোল্টন ও লিথিয়াম।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, ডিআরসির বিরল ধাতুর খনিজ সম্পদ কব্জা করায় চিন একরকম ‘জ্যাকপট’ পেয়েছে। কিন্তু, তার পরেও অতিরিক্ত ‘লোভের’ কারণে বেজিঙের উপর যথেষ্ট ক্ষুব্ধ মধ্য আফ্রিকার ওই দেশ। ডিআরসির সাউথ কিভু প্রদেশের ৪৫০টির বেশি বেআইনি খনি থেকে লাগাতার ড্রাগনের সংস্থাগুলি কোবাল্ট উত্তোলন এবং পাচার করছে বলে অভিযোগ। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেখানে শিশু শ্রমিকদের কাজ করানোর প্রমাণ মিলেছে।
গত ৪ জানুয়ারি সোনা পাচারের অভিযোগে তিন জন চিনা নাগরিককে গ্রেফতার করে ডিআরসি প্রশাসন। তাঁদের থেকে অন্তত ১০টি সোনার বার এবং নগদ চার লক্ষ ডলার উদ্ধার হয়। এর পর বীতশ্রদ্ধ ডিআরসির প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গত মার্চে ওয়াশিংটনের কাছে ‘খনিজের বিনিময়ে নিরাপত্তা’র প্রস্তাব দেন তিনি। এর পরই রোয়ান্ডার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষ বন্ধ করতে উদ্যোগী হন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ওয়াশিংটনে শান্তিচুক্তি হলেও আফ্রিকার ওই এলাকায় রক্তপাত বন্ধ হওয়া খুব সহজ নয়। কারণ, দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন, আর্থিক সঙ্কট, গৃহযুদ্ধ এবং একাধিক জনজাতির মধ্যে লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ডিআরসি এবং রোয়ান্ডার। জার্মানি এবং বেলজিয়ামের একাধিক নীতি মহাদেশটির গায়ে তৈরি করেছে একের পর এক ক্ষতচিহ্ন। নিম্ন মানের প্রশাসনিক কাঠামো এবং দুর্বল শাসনব্যবস্থার নেপথ্যে ইউরোপের ওই দুই দেশের ‘হাতযশ’কেই দায়ী করে থাকেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
আফ্রিকার জনজাতিগুলির মধ্যে শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে ‘হামিটিক তত্ত্ব’-এ বিশ্বাসী ছিল জার্মানি। সেই নিয়ম মেনে ‘টুটসি’কে উন্নত জাতিগোষ্ঠী হিসাবে দেগে দেয় ইউরোপের ওই দেশ। জার্মানরা মনে করতেন, তথাকথিত ‘বর্বর’দের সভ্য করতে ইথিয়োপিয়ার উচ্চ ভূমিখণ্ড থেকে গ্রেট লেক্স এলাকায় পা পড়েছিল ‘টুটসি’দের। এই ধারণার ফলে সেখানে বৃদ্ধি পায় জাতিবিদ্বেষ। আর এক জনজাতি ‘হুটু’দের চিরশত্রুতে পরিণত হয় এই ‘টুটসি’রা।
এ-হেন জার্মান তত্ত্বের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে স্থলবেষ্টিত দেশ রোয়ান্ডার উপর। উপনিবেশ-পরবর্তী সময়ে ‘টুটসি’ ও ‘হুটু’দের মধ্যে জাতি সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে গ্রেট লেক্স অঞ্চলের এই রাষ্ট্র। ১৯৯৪ সালে সেখানে সংঘটিত হয় গণহত্যা।
১৯৬২ সালে স্বাধীনতার সময়ে দেশের ক্ষমতা দখল করে ‘হুটু’রা। কুর্সিতে বসেই ‘টুটসি’দের সমূলে বিনাশ করার চেষ্টা করতে থাকে আফ্রিকার এই জনজাতি। ফলে বার বার গণহত্যার শিকার হন তাঁরা। প্রাণ বাঁচাতে ‘টুটসি’দের একটা বড় অংশ প্রতিবেশী উগান্ডা এবং তানজ়ানিয়ার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এই গোষ্ঠীর সাবেক রাজ এবং রাজপরিবারের সদস্যরাও। দীর্ঘ সময় তাঁদেরও শরণার্থী শিবিরে কাটাতে হয়েছিল।
পরবর্তী কালে ‘রোয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ বা আরপিএফ নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্ম দেন ‘টুটসি’ শরণার্থীরা। নেতৃত্বে ছিলেন পল কাগামে। মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য ‘হুটু’ পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধই ঘোষণা করেন তাঁরা। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে শাসক ‘হুটু’দের একাংশ তৈরি করেন একটি আধা সামরিক সংগঠন, স্থানীয় ভাষার যার নাম ‘ইন্টারাহামওয়ে’। কথাটির অর্থ হল একসঙ্গে আক্রমণকারীদের একটি দল।
১৯৯৪ সালের রোয়ান্ডা গণহত্যার নেপথ্যে ছিল কুখ্যাত ‘ইন্টারাহামওয়ে’র হাত। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ‘টুটসি’ ও তাঁদের প্রতি সহানুভূতিশীল ‘হুটু’ উপজাতিদের আট লক্ষ নিরীহ মানুষকে খুন করেন তাঁরা। আরপিএফ ক্ষমতা দখলের পর বন্ধ হয় সেই রক্তের হোলি খেলা। গত তিন দশক ধরে কঠোর হাতে রোয়ান্ডা শাসন করছে আরপিএফ।
মধ্য আফ্রিকার দেশটিতে ওই পালাবদলের পর সেখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চম্পট দেয় ‘হুটু’রা। প্রতিবেশী ডিআরসিতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা। কঙ্গোকে অবশ্য তখন সকলে চিনত জাইরে নামে। গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে যে কোনও মুহূর্তে আরপিএফ হামলা করতে পারে বলে আতঙ্কে ভুগছিল ‘হুটু’রা। দেশছাড়া হওয়ার বিষয়টিকেও ভাল চোখে দেখেনি ওই জাতিগোষ্ঠী। আর তাই কয়েক বছরের মধ্যেই ডিআরসিতে গড়ে ওঠে ‘হুটু’ বিদ্রোহীদের দল ‘ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস ফর দ্য লিবারেশন অফ রোয়ান্ডা’ বা এফডিএলআর।
‘হুটু’দের লক্ষ্য ছিল ‘টুটসি’দের সরিয়ে ফের রোয়ান্ডার ক্ষমতা দখল। এর জন্যই এফডিএলআর গড়ে তোলে তারা। অন্য দিকে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় মার্চ ২৩ বা এম২৩ নামের পৃথক একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করে ‘টুটসি’রাও। পরবর্তী দশকগুলিতে একরকম যুদ্ধেই জড়িয়ে পড়ে এফডিএলআর এবং এম২৩। এতে অবশ্য রোয়ান্ডা মদতপুষ্ট গোষ্ঠীটির পাল্লা ভারী থাকায় বিপাকে পড়ে ডিআরসি।
ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর পূর্ব দিকের এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে ‘টুটসি’দের এম২৩-এর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ নেমেছিল ‘হুটু’দের এফডিএলআর। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় ডিআরসির ওই এলাকায় ঢুকে বেশ কিছু জায়গা দখল করে নিয়েছে এম২৩। বিশ্লেষকদের দাবি, রোয়ান্ডা ছাড়াও উগান্ডার সরকার এবং সেনার থেকে সাহায্য পাওয়ায় লড়াইয়ে পর পর সাফল্য মিলতে থাকে তাদের।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডিআরসির সর্ববৃহৎ শহর গোমা দখল করে এম২৩। এর পর একতরফা ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলেও ওই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধারা থেমে থাকেননি। এই অবস্থায় শান্তি ফেরাতে বিদ্রোহীদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানান পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকান ব্লকের রাষ্ট্রনেতারা। তাতে কাজ কিছু না হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হন ডিআরসির প্রেসিডেন্ট শিসেকেদি।
শান্তিচুক্তির শর্তে রোয়ান্ডাকে দখল করা ডিআরসির জায়গা থেকে এম২৩ বিদ্রোহীদের সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সমঝোতাপত্রে কোথাও এফডিএলআর বা এম২৩কে ভেঙে দিতে বলা হয়নি। আফ্রিকার ওই এলাকায় মাটির নীচে রয়েছে ২৪ লক্ষ কোটির খনিজ সম্পদ। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করার পিছনে ছুটছে চিন, আমেরিকা, তুরস্ক এবং রাশিয়ার মতো বিশ্বশক্তি। ফলে ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এর হ্রদ এলাকায় রক্তের হোলি খেলা খুব দ্রুত বন্ধ হওয়ার নয়, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।