মাত্র তিন মাসের ব্যবধান। তার মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওতে (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন) ফের নালিশ ঠুকল চিন। তবে এ বার আর বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) নয়। অপ্রচলিত শক্তির অন্যতম বড় উপাদান সৌর প্যানেলকে নিশানা করেছে বেজিং। পাশাপাশি, অভিযোগপত্রে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের চালু করা ‘উৎপাদনভিত্তিক উৎসাহ ভাতা’ বা পিএলআই (প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ) প্রকল্পটিকে তুলে ধরেছে ড্রাগন সরকার। ফলে এই ইস্যুতে আগামী দিনে নয়াদিল্লির সঙ্গে মান্দারিনভাষীদের টানাপড়েনের আশঙ্কা যে বাড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে সুইৎজ়ারল্যান্ড জেনেভায় ডব্লিউটিও-র সদর দফতরে দু’টি বিষয় নিয়ে নালিশ ঠোকে চিন। বেজিঙের অভিযোগ, সৌরশক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশীয় শিল্প সংস্থাগুলিকে বিশেষ ভর্তুকি দিচ্ছে মোদী সরকার। ফলে ভারতের বাজারে সৌর প্যানেল বিক্রিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে তো দাঁত ফোটানোই সম্ভব হচ্ছে না। এ-হেন ‘ভর্তুকি’ নীতি চালু রেখে নয়াদিল্লি ১৯৯৪ সালে ডব্লিউটিও-র তৈরি করা আইন ভাঙছে বলে দাবি করেছে ড্রাগন সরকার।
সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভিযোগপত্রে চিন লিখেছে, ‘‘আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে নয়াদিল্লি। ফলে সৌরপ্যানেল এবং তথ্যপ্রযুক্তি বাজারের ব্যবসা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’’ এই দুই ক্ষেত্রে লোকসান এড়াতে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি নিয়ম অনুযায়ী আলোচনার টেবলে বসতে চেয়েছে বেজিং। সেখানে সমাধানসূত্র বার না হলে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে শুল্ক-সংঘাত প্রত্যক্ষ করতে পারে গোটা দুনিয়া, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ভারতের বাজারে সৌর প্যানেল এবং তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কেন বিনা বাধায় ব্যবসা করতে চাইছে চিন? নয়াদিল্লির ‘ভর্তুকি নীতি’কেই বা ভয় পাওয়ার কারণ কী? এর নেপথ্যে অবশ্য একাধিক যুক্তি দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, বর্তমানে সৌরশক্তিতে এ দেশের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ এগিয়ে আছে বেজিং। মোদী সরকারের ‘উৎসাহ ভাতা’ ঠিকমতো কাজ করলে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারে নয়াদিল্লি। তখন দেশি সৌরপ্যানেলে ভারতের বাজার ছেয়ে যাবে।
বর্তমানে বিশ্বের মোট সৌরশক্তির ৮০ শতাংশ উৎপাদিত হয় চিনে। এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানের প্রয়োজন হয় তার নাম সৌরপ্যানেল। সেই প্যানেলের ৬৬ শতাংশ আজকের দিনে বসানো আছে ড্রাগনভূমির বিভিন্ন এলাকায়। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, ইতিমধ্যে মোট ১,১০০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পেরিয়ে গিয়েছে মান্দারিনভাষীরা। আগামী দিনে তা আরও বৃদ্ধি পাবে।
অন্য দিকে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ভারত। চিনের সঙ্গে তুলনায় তা অনেকটাই কম। কারণ, এ বছরের প্রথম ছ’মাসে (পড়ুন জানুয়ারি থেকে জুন) ২৫৬ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ তৈরি এবং সরবরাহ করেছে বেজিং। ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে এই অপ্রচলিত শক্তির উৎপাদন মাত্র ২৯.৫ গিগাওয়াট বৃদ্ধি করতে পেরেছে নয়াদিল্লি।
আন্তর্জাতিক বাজারে সৌর প্যানেল এবং সোলার সেল তৈরিতে চিনের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশ্বের ৮০ শতাংশ সৌরপ্যানেল এবং প্রায় ৯৮ শতাংশ সোলার সেল ঘরোয়া শিল্প সংস্থাগুলির মাধ্যমে তৈরি করে বেজিং। এর দ্বিমুখী সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, এ ব্যাপারে বিদেশি নির্ভরশীলতা না থাকায় দ্রুত গতিতে সৌরশক্তি উৎপাদন করতে পারছে ড্রাগন সরকার। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ বা পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া, সর্বত্রই অপ্রচলিত শক্তি প্রকল্পে পরোক্ষ ভাবে আধিপত্য থাকছে মান্দারিনভাষীদের।
বিশ্লেষকদের দাবি, এ-হেন পরিস্থিতিতে মোদী সরকার সৌরশক্তি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়ায় এ দেশের বাজার দখল করতে উঠেপড়ে লাগে চিন। প্রথম পর্যায়ে সৌরপ্যানেল এবং সোলার সেল ভালই রফতানি করছিল বেজিং। কিন্তু, গত দু’-তিন বছর ধরে পিএলআই প্রকল্পকে সামনে রেখে ঘরের মাটিতেই এগুলির উৎপাদন বাড়াতে শুরু করে নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট সৌরপ্যানেল বা সোলার সেলের কাঁচামালও অভ্যন্তরীণ ভাবে তৈরির উপর জোর দিয়েছে কেন্দ্র। এতে সাফল্য পেলে ভারতের বাজারে একচেটিয়া ব্যবসার স্বপ্ন যে মাঠে মারা যাবে তা ভালই জানে ড্রাগন।
২০২০ সালে পিএলআই প্রকল্প চালু করে কেন্দ্র। এর মূল লক্ষ্য হল বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিন গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সৌরশক্তির মতো মোট ১৪টি ক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি। আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলি ব্যাপক হারে রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে নয়াদিল্লির। আর তাই এগুলি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত দেশীয় সংস্থাগুলিকে নানা ভাবে উৎসাহ ভাতা দিচ্ছে মোদী সরকার। কর থেকে ঋণ বা লগ্নি টানার মতো বিষয় নিয়েও চিন্তামুক্ত থাকার আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন। এর জেরে চিনের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে চিনকে ঢুকতে না দেওয়ার নেপথ্যে আবার অন্য কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ‘ডিজিটাল ভারত’ প্রকল্পের জেরে আমজনতার বহু তথ্য বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইটে তুলে রেখেছে কেন্দ্র। বর্তমানে খুচরো লেনদেনের বড় অংশই চলছে ‘ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস’ বা ইউপিআইয়ের মাধ্যমে। জাতীয় সুরক্ষার প্রশ্নে এই ক্ষেত্রে বেজিংকে প্রবেশাধিকার দেওয়া তাই কঠিন।
চিনের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধ, হ্যাকিং, তথ্য এবং প্রযুক্তি চুরির ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া ভারত বা আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশগুলির হাঁড়ির খবর পেতে কম্পিউটার সিস্টেমে ম্যালঅয়্যার ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও যে বেজিঙের গুপ্তচরেরা করবেন না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেই কারণেই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রটিকে আলাদা করে ‘সুরক্ষাকবচ’ দিতে চাইছে মোদী সরকার, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
এ বছরের ১৫ অক্টোবর ইভির বাজারে প্রতিযোগিতার বিষয়টি সামনে এনে ডব্লিউটিওতে অভিযোগ দায়ের করে চিনের বাণিজ্য মন্ত্রক। সেখানে বেজিং বলেছে, অন্যায্য ভাবে বৈদ্যুতিন গাড়ি এবং ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থাগুলিকে ভর্তুকি দিচ্ছে নয়াদিল্লি, যেটা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন এবং ড্রাগনের বাণিজ্যিক স্বার্থের পরিপন্থী।
ওই সময় এই বিষয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে হুমকি দিয়েছে চিন। বেজিং জানিয়েছে, ইভিতে ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে ভারত সরকার বা ডব্লিউটিও কোনও ব্যবস্থা না নিলে ‘দ়়ৃঢ় পদক্ষেপ’ করবে তারা। ড্রাগনের পদক্ষেপ কী হতে পারে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বাজার গবেষণা সংস্থা রো মোশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইভি বাণিজ্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রয়েছে মান্দারিনভাষীদের দখলে।
সমীক্ষকদের দাবি, দুই এবং চার চাকা মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৩ লক্ষ বৈদ্যুতিন গাড়ি বিক্রি করে চিন। সংশ্লিষ্ট যানগুলি নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিরল খনিজ, যার বিশাল ভান্ডার রয়েছে বেজিঙের হাতে। এই বিরল খনিজের ব্যাপারে ড্রাগনের উপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। সেই রফতানি মান্দারিনভাষীরা বন্ধ করলে কেন্দ্রের মোদী সরকার যে বিপাকে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ইভি নির্মাণশিল্পে ভারত সরকার কী পরিমাণে ভর্তুকি দিচ্ছে, তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে নীতি আয়োগের পোর্টালে। সেখানে বলা হয়েছে, দু’চাকার গাড়ি বা দুই কিলোওয়াট/ঘণ্টা ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টায় ১৫ হাজার টাকা বা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মিলবে ছাড়। এ ক্ষেত্রে যেটা বেশি সেই হিসাবে ভর্তুকি পাবে সংশ্লিষ্ট ইভি নির্মাণকারী সংস্থা।
তিন চাকার ইভি বা বৈদ্যুতিন রিকশার ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টায় ছাড়ের মাত্রা ১০ হাজার টাকা। পাঁচ কিলোওয়াট/ঘণ্টা আকারের ব্যাটারি পর্যন্ত এই ছাড় বহাল রাখছে সরকার। একই ভাবে চার চাকার গাড়িতে ১০ হাজার টাকা ছাড় মিলছে। এতে অবশ্য ১৫ কিলোওয়াট/ঘণ্টার ব্যাটারিতে ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্র।
এ ছাড়া ভর্তুকি রয়েছে ই-বাসের ক্ষেত্রেও। সেখানে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা হিসাবে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে সরকার। এতে আবার ২৫০ কিলোওয়াট/ঘণ্টা আকারের ব্যাটারি পর্যন্ত ছাড় পাবেন নির্মাতারা। এই ভর্তুকির মাধ্যমে ঘরোয়া বাজারে ইভির দাম মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে রাখতে চাইছে কেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আগামী দিনে জীবাশ্ম জ্বালানির গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে মোদী প্রশাসনের।
এ দেশের ঘরোয়া বাজারে বিদেশি সংস্থাগুলির বৈদ্যুতিন গাড়ি বিক্রির অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কে কোনও ছাড় দিচ্ছে না সরকার। ফলে বিদেশি ইভির দাম সব সময়েই থাকে চড়া। আরও স্পষ্ট করে বললে মধ্যবিত্তের প্রায় নাগালের বাইরে। গত বছর অবশ্য এসএমইসি নামের একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বিদেশি গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা এ দেশে কারখানা খুললে আমদানি শুল্কে ছাড় পাবে।
গত আর্থিক বছরে (২০২৪-’২৫) চিনে এ দেশের পণ্য রফতানির পরিমাণ ১৪.৫ শতাংশ কমে ১,৪২৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২৩-’২৪ সালে তা ছিল ১,৬৬৬ কোটি ডলার। অন্য দিকে, গত আর্থিক বছরে বেজিং থেকে আমদানি বৃদ্ধি পায় ১১.৫২ শতাংশ। সেখানকার পণ্যের জন্য ১১ হাজার ৩৪৫ কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে নয়াদিল্লিকে। ফলে বাণিজ্যিক ঘাটতি বেড়ে ৯,৯২০ কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়।
মোদী সরকারের যুক্তি, এই সূচক হ্রাস করতেই পিএলআই প্রকল্প এনেছে সরকার। তা ছাড়া ঘরোয়া ইভি নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে থাকে চিনও। বৈদ্যুতিন গাড়ি সংক্রান্ত গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি অর্থানুকূল্য পায় তারা। ফলে ডব্লিউটিওতে এই বিষয়টিও তোলার সুযোগ থাকছে ভারতের হাতে। শেষ পর্যন্ত কোনও সমাধানসূত্র বার না হলে শুল্কবৃদ্ধির নির্দেশ দিতে পারে ওই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
সব ছবি: সংগৃহীত।