অভ্যুত্থান: রোমানিয়ার বন্দরে নোঙর করা আসল জাহাজটি। ছবি: গেটি ইমেজেস।
এখানে এরা যা কাণ্ড করছে তার ভালোমন্দ বিচার করবার পূর্বে সর্বপ্রথমেই মনে হয়, কী অসম্ভব সাহস। সনাতন বলে পদার্থটা মানুষের অস্থিমজ্জায় মনে-প্রাণে হাজারখানা হয়ে আঁকড়ে আছে... এরা তাকে একেবারে জটে ধরে টান মেরেছে; ভয় ভাবনা সংশয় কিছু মনে নেই। সনাতনের গদি দিয়েছে ঝাঁটিয়ে, নূতনের জন্যে একেবারে নূতন আসন বানিয়ে দিলে। পশ্চিম মহাদেশ বিজ্ঞানের জাদুবলে দুঃসাধ্য সাধন করে, দেখে মনে মনে তারিফ করি। কিন্তু এখানে যে প্রকাণ্ড ব্যাপার চলছে সেটা দেখে আমি সব চেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। শুধু যদি একটা ভীষণ ভাঙচুরের কাণ্ড হত তাতে তেমন আশ্চর্য হতুম না... কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, বহুদূরব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগৎ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে গেছে। দেরি সইছে না; কেননা জগৎ জুড়ে এদের প্রতিকূলতা, সবাই এদের বিরোধী— যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে— হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে, এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়। হাজার বছরের বিরুদ্ধে দশ-পনেরো বছর জিতবে বলে পণ করেছে। অন্য দেশের তুলনায় এদের অর্থের জোর অতি সামান্য, প্রতিজ্ঞার জোর দুর্ধর্ষ।”
১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে সোভিয়েট রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এ তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’র অংশ। ১৯১৭-র বিপ্লবের মাত্র তেরো বছর পেরোচ্ছে তখন, বলশেভিকদের নেতৃত্বে গোটা সোভিয়েট রাশিয়া সমাজতন্ত্রী আবেগ ও কর্মময়তায় ফুটছে টগবগ করে, তার মধ্যে গিয়ে পড়েছেন প্রাচ্যসন্ত, ভারতমনীষী রবীন্দ্রনাথ। বিদেশের বড় অতিথি কলকাতায় এলে আমরা যেমন তাঁকে বাংলা ও বাঙালির শ্রেষ্ঠ, সরেস ফসল দেখাই গর্বভরে, তেমনই রবীন্দ্রনাথকেও দেখানো হল সেকালের বিখ্যাত রুশ থিয়েটার, ব্যালে। এবং সমকালীন সেরা সিনেমা— সের্গেই আইজ়েনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’। তার মাত্র পাঁচ বছর আগে তৈরি যে ছবি তত দিনে ইউরোপ মহাদেশ জয় করে, সিনেমা ও সেই সূত্রে শিল্প-সমাজ-রাজনীতিভাবনার জগতেও হেউঢেউ ফেলে দিয়েছে।
‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবির তিন সিংহ। ছবি: গেটি ইমেজেস।
সিনেমা নিজেই তখন সদ্যযুবা এক শিল্পমাধ্যম। বিনোদনের বেশি তার আর কিছু মূল্য আছে কি না সে প্রশ্নটা যখন সবে একটু দানা বাঁধছে, তখনই একটা প্রবল বিস্ফোরণের মতো অভিঘাত তৈরি করেছিল আইজ়েনস্টাইনের এই ছবি। সিনেমা যে অনতিদূর বা সুদূরের বিপ্লবকে পর্দায় তুলে ধরে নিজেই সমকালের বিপ্লবসঙ্গী হয়ে উঠতে পারে, হতে পারে সুযোগ্য ও সার্থক প্রচার-‘প্রোপাগান্ডা’র হাতিয়ার, সেকালের বলশেভিক পার্টির কেষ্টবিষ্টুরা তা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ১৯০৫ সালে ঘটে গেছে যে ‘বিপ্লব’, কুড়ি বছর পূর্তিতে তার স্মরণে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি একগুচ্ছ সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্তে সায় দেয়। এই পরিকল্পনারই অঙ্গ আইজ়েনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫), সেভোলোদ পুদভকিনের ‘মাদার’ (১৯২৬)-এর মতো যুগান্তকারী ছবি— লিখেছেন মারি সিটন, তাঁর লেখা আইজ়েনস্টাইনের বায়োগ্রাফিতে।
১৯২৫-১৯২৬, তার মানে ঠিক একশো বছর পেরিয়েছে ছবিদুটো তৈরি হওয়া ইস্তক। শতবর্ষ আগে এমনই এক ডিসেম্বরে মুক্তি পেয়েছিল ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’; ২১ আর ২৪ ডিসেম্বর, প্রথম প্রদর্শনের দুটো তারিখ মেলে, সেই সঙ্গে ১৯২৬-এর জানুয়ারির দুটো তারিখও। আজ ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, শতবর্ষ পরেও ‘পোটেমকিন’ ঘিরে আবেগ-উত্তেজনার কমতি নেই। বিশ্বের বহু দেশে, নানান চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান ও উৎসব কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে হয়ে চলেছে এই ছবির শতবর্ষ উদ্যাপন: তার রেস্টোরড ভার্সন দেখানো হচ্ছে, সিনে-পণ্ডিতরা আলোচনা করছেন এই ছবি নিয়ে, নানা দেশের নানা গানের দল এই ছবির মিউজ়িক করছে নতুন করে— সে-ই তাদের অর্ঘ্য, ঐতিহাসিক এক সিনেমার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করার আকুলতা। সঙ্গে জুড়েছে বিতর্কও: গত সপ্তাহেই তিরুঅনন্তপুরমে কেরল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলতে চলতে হঠাৎ খবর এল, উৎসবের অন্তর্ভুক্ত ১৯টা ছবি কেন্দ্রের সেন্সর-অনুমোদন পায়নি, তার মধ্যে ছিল ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ও! সিনেপ্রেমীরা নিজস্ব আড্ডায় মুচকি হেসেছেন তা দেখে: রাষ্ট্র কি একশো বছর পরেও বিপ্লবের ভূত দেখছে এ ছবিতে? যাক, সিনেমার জোর আছে বলতে হবে!
অতিথি: ১৯৩০-এর রাশিয়া সফরে মস্কোয় হাউস অব ইউনিয়নস-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জোর যে আছে, ইতিহাসই তার সাক্ষী। আইজ়েনস্টাইনের ছবিটা তৈরি জোসেফ স্তালিনের জমানায়, তাতেও পরে স্তালিনের চক্ষুশূল হয়ে ওঠা আটকায়নি। পরিচালকেরই ‘অক্টোবর’ ছবিটা স্তালিনের কোপে পড়েছিল, ১৯১৭-য় রুশ জনতার হাতে স্বৈরতন্ত্রী জ়ার-জমানা উৎখাত হওয়ার ‘ইতিহাস’ সিনেমায় দেখে যদি আবার স্তালিন-জমানার জনতা বিদ্রোহ করে বসে! ব্রিটেনেও তো বহুকাল নিষিদ্ধ ছিল ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’, ওই গণবিপ্লবেরই ভয় ও আশঙ্কায়। সিনেমার ঈশ্বরের এ এক অদ্ভুত পরিহাস— এক রাজনৈতিক সময়ে যা দেশপ্রেমের নিদর্শন, অন্য রাজনৈতিক জমানায় তা-ই দেশদ্রোহের। এর বিপ্লবী ওর বয়ানে সন্ত্রাসবাদী। আইজ়েনস্টাইন যেমন তাঁর ছবির জন্য এক জীবনেই হিরো বনেছেন, তেমনই ভিলেনও; রাষ্ট্রশক্তির কাছে ক্ষমা-টমাও চাইতে হয়েছে পরে। ইতিহাস সে সব মনেও রাখেনি, ধরে রেখেছে ছবিটাকে।
ঠিক কী দেখানো হয়েছে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’-এ? ১৯০৫-এর অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গের ইতিবৃত্ত তো সবার জানা। সে বছরই জুনে রাশিয়ার জ়ারের রয়্যাল ইম্পিরিয়াল নেভি-র একটা যুদ্ধজাহাজে— ইংরেজিতে যার নাম ‘প্রিন্স পোটেমকিন’— নাবিকেরা বিদ্রোহ করে জাহাজের উচ্চপদস্থ অফিসারদের বিরুদ্ধে। দেশেও তখন বিক্ষোভ চলছে— জ়ারের শাসনে, রুশ-জাপান যুদ্ধের পরিণাম হেতু আর্থ-সামাজিক দুর্দশায় রুশ জনতার প্রাণ ওষ্ঠাগত। যুদ্ধজাহাজ তো সম্রাটেরই, জাহাজের ঊর্ধ্বতন কর্তারাও জ়ারপন্থী নিপীড়ক। তাদের অত্যাচার ফুটে বেরোয় কখনও সারা দিন গায়েগতরে খেটে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাওয়া সাধারণ নাবিকের উপর গায়ের ঝাল মেটানোয়, কিংবা তাদের রান্না-খাওয়ার জন্য পোকা ধরে-যাওয়া পচা মাংসের ইচ্ছাকৃত জোগানে। রাজার আমলে যে অপশাসন চলছে, রাজার অধীন হয়েও তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই নাবিকেরা, তাদের মন পড়ে আছে মানুষের বিক্ষোভে। তারা মাংস খেতে অস্বীকার করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, অফিসাররা জাহাজের ডেকে বিদ্রোহী নাবিকদের দাঁড় করিয়ে সহ-নাবিকদের বলে ওদের গুলি করে খতম করতে। সেই আদেশ অমান্য করে নাবিকেরা উল্টে জাহাজের অফিসারদের উপরে চড়াও হয়, জাহাজের দখল নেয়। জলের বিদ্রোহ মিলে যায় স্থলের বৃহত্তর সংগ্রামে, দখল-নেওয়া জাহাজ বলশেভিকদের লাল পতাকা উড়িয়ে এগিয়ে আসতে থাকে কাছেই ওডেসা বন্দরের দিকে। ততক্ষণে নৌ-বিদ্রোহের খবর পৌঁছে গেছে শহরে, মানুষের কাছে।
দ্রষ্টা: সের্গেই আইজ়েনস্টাইন। ডানে, ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবির রুশ পোস্টার। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
পাঁচ অঙ্কে ভাগ করা এই ছবির চতুর্থ অঙ্ক, ‘দি ওডেসা স্টেপস’ ছবিতে আসে এর পরেই। এই অংশটিই আইজ়েনস্টাইনের ছবিকে অমরত্ব দিয়েছে, বললে ভুল হবে না। সকাল হতেই শতসহস্র রুশ জনতা জড়ো হতে থাকে সাগরতীরে, পাল-তোলা ছোট ছোট নৌকোয় তারা পাড়ি দেয়, একটু দূরে সাগরে থিতু জাহাজ আর তার বিদ্রোহী নাবিকদের একটুখানি চোখে দেখার জন্য, তাদের দিকে বিপ্লবী সমর্থনের হাতও বাড়িয়ে দিতে। অশক্ত, বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় কাবু যাঁরা নৌকোয় চড়তে পারছেন না, তাঁরা দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে থাকেন সাগরপাড়ে, ওডেসা শহরের বিখ্যাত সিঁড়ি থেকেই। এই সুখমুহূর্তই হঠাৎ পাল্টে যায় বিভীষিকায়, যখন দেখা যায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে জ়ারের সৈন্যদল, উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে। ছেলে-বুড়ো, মা ও শিশু, পুরুষ-মহিলা দলে দলে নামতে থাকেন সিঁড়ি বেয়ে নীচে, কেউ লুকিয়ে পড়েন উঁচু সিঁড়ির ধাপের আড়ালে, অনেকেই ওই সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন গুলিবিদ্ধ হয়ে। খানিক আগের সহর্ষ জনতা তখন সন্ত্রস্ত, প্রাণভয়ে ভীত। পলায়নরতা মায়ের হাত ছাড়িয়ে শিশু রয়ে যায় পিছনে, বৃদ্ধা মহিলার চশমা ফুঁড়ে গুলি ঢুকে যায় চোখে, গুলিবিদ্ধা আর এক মায়ের শরীরের ভারে আলগা হয়ে সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে প্যারাম্বুলেটর, একরত্তি এক শিশু-সমেত! এই সব টুকরো টুকরো দৃশ্যে ঘনীভূত হয় সিনেম্যাটিক টেনশন— আর ইন্টারকাটে আমরা, দর্শকেরা আতঙ্কিত হয়ে দেখি সিঁড়ি বেয়ে এক লয়ে নেমে আসা সৈন্যদলের পা, আবার নীচে তখন জ়ারেরই বশংবদ ঘোড়সওয়ার ‘কোসাক’-এর দল অপেক্ষা করছে পরবর্তী আঘাত হানার জন্য।
শাসিতের উপর শাসকের হিংসায় নীরব থাকে না পোটেমকিনও। বিরাটকায় যুদ্ধজাহাজের গানফায়ারে গুঁড়িয়ে যায় শহরের সুদৃশ্য হর্ম্য, যেখানে চলছিল শাসক ও পারিষদদের মন্ত্রণাসভা। এই বিস্ফোরণের দৃশ্য পর্দায় আসার গায়ে গায়েই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে: পাথরের তৈরি এক সিংহমূর্তিকে জেগে উঠতে দেখা যায় প্রবল বিক্রমে। পর পর তিনটে শটে তিন প্রস্তরসিংহকে দেখান পরিচালক: একটি নিদ্রিত, ঘটনার আকস্মিকতায় চমকিত একটি, তৃতীয়টি উত্থিত। ১৯২৫ সালের, সিনেমা নামের নতুন এক শিল্পমাধ্যমের রসগ্রহণের পাঠশালায় নবাগত দর্শক-ছাত্রদের কাছে এ ছিল এক ‘এপিফ্যানি’র, ঋতমুহূর্ত উদ্ঘাটনের সমার্থক: কারও বুঝতে বাকি থাকেনি যে পরিচালক এই তিন সিংহের মধ্য দিয়ে আসলে দেখাচ্ছেন ‘গণ’ তথা ‘মাস’-এর উত্থান ও অভ্যুত্থান। সুপ্ত সিংহ আসলে নিদ্রিত গণচেতনা— রাষ্ট্রের নিপীড়নের পরিণামে যা জেগে ওঠে সিংহবিক্রমে, ফেটে পড়ে গর্জনে।
এর পাঁচ বছর পরেই রবীন্দ্রনাথ মস্কোয় দেখেছিলেন এই ছবি। পেরা আতাশেভা নামের এক রুশ তরুণী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সহায়ক দোভাষী। তাঁর বয়ানে মেলে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ দেখার সময় রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া— ওডেসার বিস্তৃত সিঁড়িতে জ়ারের সৈন্যদের হাতে গণহত্যার দৃশ্য দেখতে দেখতে নাকি কবির সৌম্য মুখমণ্ডল হয়ে উঠেছিল উদ্বেগে টানটান, উত্তেজনায় হাত এক বার মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছিল, পরক্ষণেই উন্মুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে এই তথ্যটিও যুক্ত করা যাক: এই পেরা আতাশেভাকেই বিয়ে করেন সের্গেই আইজ়েনস্টাইন।
গোড়ায় ছবিটার পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। ১৯০৫-এর গণবিপ্লবকে ধরা হবে আটটা পর্বের বিস্তৃত এক পরিসরে, তার একটা পর্বে থাকবে যুদ্ধজাহাজ পোটেমকিনের কথা— এ রকমই ঠিক ছিল। ১৯২৫-এর ১৯ মার্চ পার্টির সিদ্ধান্ত ও সবুজ সঙ্কেত এল, ৩১ মার্চ আইজ়েনস্টাইন ও তাঁর বন্ধু-সহযোগীরা শুটিং শুরু করলেন লেনিনগ্রাদে। অগস্টে আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করায় শুটিংয়ে তার প্রভাব পড়ল বটে, কিন্তু তত দিনে শুটিং-দলের সবাই এও বুঝতে পেরে গেছেন, তাঁরা আসলে অন্য একটা ছবি বানাতে চাইছেন— শুধু পোটেমকিনই যে ছবির প্রাণ, সে-ই শুরু ও শেষ। কনকনে উত্তুরে শীতের দেশ থেকে সবাই চলে গেলেন দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের দিকে, দেশের ওদিকটা তখনও সূর্যালোক-চুম্বিত। ওডেসাতে পৌঁছে ওই ঐতিহাসিক সিঁড়িগুলো দেখামাত্র আইজ়েনস্টাইন বুঝে যান, তিনি পেয়ে গেছেন তাঁর আসল ছবি। আগে ভাবা ও ক্যামেরায় তোলা যা-কিছু একেবারে ঝেড়ে ফেলে, নতুন করে লিখলেন চিত্রনাট্য।
১৯০৫ বিদ্রোহের অকুস্থল যে যুদ্ধজাহাজ, সেই আসল পোটেমকিনেই আইজ়েনস্টাইন তার ছবির শুটিং করেছিলেন কি না তা নিয়ে মতের এদিক-ওদিক আছে। মারি সিটন লিখেছেন, ১৯২৫-এও পোটেমকিন একটা প্রশিক্ষণ-জাহাজ হিসেবে সক্রিয় ছিল, এবং আইজ়েনস্টাইন এই জাহাজ ও তার ক্রু-দেরও কাজে লাগান কুড়ি বছর আগের এক বিদ্রোহকে পর্দায় ফের জীবন্ত করে তোলার কাজে। আবার আন্তর্জালের তথ্য বলছে, পোটেমকিন জাহাজটি ‘আউট অব সার্ভিস’ হয়ে যায় ১৯১৯-এই, আর পুরনো বা বাতিল জাহাজ ভেঙে ফেলার যে রীতি, সেই ‘স্ক্র্যাপিং’ও হয়ে যায় ১৯২৩-এই। আবার এই তথ্যও মেলে, ‘টুয়েলভ অ্যাপোসলস’ আর ‘কমিনটার্ন’ নামের আরও দুই জাহাজ মিলিয়ে আসলে ছবিটার শুটিং হয়েছিল, পর্দার পোটেমকিন আসলে এরাই। তবে পরিচালকের প্রস্তুতি ও গবেষণা ছিল সুগভীর। ওডেসার সিঁড়িতে ঘটে যাওয়া গণহত্যার সাক্ষী ছিলেন এক ফরাসি শিল্পী, তাঁর আঁকা কিছু ছবি দেখেছিলেন আইজ়েনস্টাইন; এমনকি খুঁজে বার করে কথা বলেছিলেন সেদিনের গণহত্যার ‘সারভাইভার’দের সঙ্গেও। ছবির এই প্রস্তুতিপর্ব থেকেই একপ্রকার পাকা হয়ে যায় এই সিদ্ধান্তটি— এ ছবির কোনও আলাদা নায়ক বা মুখ্যচরিত্র নেই, ‘গণ’ বা ‘মাস’ই এ ছবির নায়ক। ১৯১৭-র বিপ্লবোত্তর নতুন সোভিয়েট রাশিয়া গড়ে তোলার নতুন কাজে বলশেভিক পার্টিরও ঠিক এটাই দরকার ছিল, নতুন ‘গণ’কে কুড়ি বছর আগের ‘গণ’-এর উদাহরণে উজ্জীবিত, উত্তেজিত করা।
এরও পর আছে। বিদ্রোহী জনতাকে ছত্রভঙ্গ ও হত্যা করা হল, বিদ্রোহী জাহাজকে কি ছেড়ে কথা বলবে শাসক? পোটেমকিনকে শিক্ষা দিতে আসছে জ়ারের নৌ-বহরের বাকি জাহাজগুলো, ছবির শেষ অঙ্কে এই ইঙ্গিতে ফের ঘনায় আশঙ্কার মেঘ। লাল পতাকা পতপতিয়ে পোটেমকিন মুখোমুখি হয় তাদের, সঙ্গে বার্তা: আমরা পরস্পরের শত্রু নই, আমরা একই পথের সহযাত্রী, তোমরাও সঙ্গী হও সে পথে। আর কী আশ্চর্য, ছবির শেষে হয়ও তা-ই, জ়ারের স্কোয়াড্রনের বাকি জাহাজগুলো পোটেমকিনকে আক্রমণ করে না, গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দেয় না, বরং নৌ-বহরের মধ্যমণি হয়ে পেরিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয় সৌভ্রাত্রের পরম উদাহরণ হিসেবে। বিপ্লবের জয় হয়।
ঠিক এমনটাই কি হয়েছিল, সত্যিই? ইতিহাস হিসেবে যে ছবি সামনে এসে দাঁড়ায়, তাকে নতুন চোখে দেখতে গিয়ে একশো বছর পরের দর্শকপ্রজন্ম এই প্রশ্ন করতেই পারেন। উত্তরটা— না। চিত্রপরিচালকেরা নিজেদের ইচ্ছা, ভাবনা, বিশ্বাস, সর্বোপরি সিনেমার প্রয়োজন অনুযায়ী ইতিহাসের ঘটনাক্রম পাল্টে নেন, নিয়েছেন— বার বার। আর ১৯২৫-এর সোভিয়েট রাশিয়ায়, বলশেভিক ‘প্রোপাগান্ডিস্ট’ রাজনৈতিক ও শিল্পদর্শন মোতাবেক ইতিহাসকে খানিক পাল্টে দেওয়া বা নেওয়া দোষের কিছু ছিল না। সত্যি-পোটেমকিন, বিদ্রোহী পোটেমকিন ১৯০৫-এ রোমানিয়ার এক বন্দরে ভিড়ে রাজনৈতিক আশ্রয় বা ‘অ্যাসাইলাম’ চেয়েছিল। আর ওডেসার জনবিদ্রোহও তো আগেই শক্ত হাতে দমন করেছিল সেকালের শাসক। সুতরাং, ঐতিহাসিক সত্য হল এই, ১৯০৫-এর একটি জাহাজের ওই বিদ্রোহ শেষ বিচারে ছিল বিপ্লবের এক অসফল প্রয়াস। রাষ্ট্র জাহাজটাকে পরে ঠিকই কব্জা করে, তার নাম পাল্টে ফেলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও পরে ব্যবহার করা হয় জাহাজটা, জার্মানদের হাতে ধরাও পড়েছিল সে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর ফের আসে মিত্রশক্তির হাতে।
তাতে কী? অতীতকে কোন চোখে দেখা হবে, তা তো ঠিক করে বর্তমানের শাসক। সে তার প্রয়োজনমতো, রাজনৈতিক ও অন্য স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যেই ইতিহাসের পাত্রপাত্রী, ঘটনাচক্র পাল্টে দেবে— আজও কি তা চোখের সামনে জ্বলজ্বলে নয়? তবে কিনা, ১৯২৫ আর ২০২৫-এর যুগসত্য এক নয়, সেকাল আর একালের ‘প্রোপাগান্ডা’তেও আসমান-জমিন ফারাক। সেই ছানবিন না হয় রাজনীতি-সমাজনীতির বিশেষজ্ঞরা করুন, আমরা বরং একশো বছর পরে ফের টিভি, কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের পর্দায় ফিরে দেখতে পারি ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবিটা। একটু পড়ে দেখতে পারি সিনেমার নির্মাণ-দর্শন ও মনস্তত্ত্বকে দিয়ে যাওয়া আইজ়েনস্টাইনের মহামূল্য উপহার, ‘মন্তাজ তত্ত্ব’ নিয়ে। ভাবতে পারি, কেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় এ ছবিকে বলেছিলেন সিনে-এডিটরদের হ্যান্ডবুক।
আর হ্যাঁ, এই সূত্র ধরেই এক বার ‘রাশিয়ার চিঠি’ ফিরে পড়লেও মন্দ হবে না। কারণ, সেখানে শুধু রাশিয়া-মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথকেই পাব না, রাশিয়ার সমালোচক রবীন্দ্রনাথকেও পাব। শিক্ষা কৃষি স্বাস্থ্য শিল্প-সহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেকালের রাশিয়া যে পথে চলছিল, তার মধ্যে ‘গুরুতর গলদ’ও বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: “ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না— সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।” এই রবীন্দ্রনাথ তত দিনে ‘রক্তকরবী’ লিখে ফেলেছেন, ‘তাসের দেশ’ লেখা তখনও বাকি। এই দু’টি রচনার সমান্তরালে ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ছবিটাকে রাখলে আশ্চর্য হতে হয়— আইজ়েনস্টাইনের ছবি তাঁকে পরাধীন স্বদেশের প্রকৃত, সার্থক ‘গণ’ বিপ্লব-সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। এ ছবি দেখতে দেখতে উত্তেজনায় তাঁর মুখের ভাব পাল্টে যাওয়া, হাত মুঠো করা আর খোলা, সে কি শুধুই তাৎক্ষণিক মনোদৈহিক প্রতিক্রিয়া? নাকি মস্কোর প্রেক্ষাগৃহে ছবির ওই দৃশ্যকল্প, এডমান্ড মেইজ়েলের ওই উচ্চমার্গীয় ফিল্ম-মিউজ়িকের সঙ্গত তাঁর চোখে অতীতের এক রুশ যুদ্ধজাহাজকে করে তুলেছিল ভবিষ্যতের ভারত-স্বপ্নপোতও!