ঘটনাস্থল: ১৮৭৫ সালে কানপুরে প্রতিষ্ঠিত ‘অল সোলস চার্চ’, বর্তমানে যা ‘কানপুর মেমোরিয়াল চার্চ’ নামে পরিচিত। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
আপনারা অল সোলস চার্চটা দেখতে যাবেন তো? আপনারা হয়তো জানতে চাইবেন, কেন? কী আছে সেখানে?
এমনই ফাঁক রয়ে গিয়েছে ইতিহাস পাঠে। কানপুর গিয়েও মনে হয়নি এই গির্জায় যাওয়ার কথা। ভাগ্যিস এক অধ্যাপক বন্ধু নিয়ে গেলেন। লাল ইটে তৈরি বেশ বড়সড় গির্জা। ভারী দরজা ঠেলে ঢুকলে স্বাগত জানায় মৃদু সুগন্ধ। বাইরের চড়া রোদ থেকে ভিতরের আধো-অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে দেখা যায়, সেখানে থমকে রয়েছে এক অশান্ত, বেদনাবিদ্ধ সময়। দেওয়ালে দেওয়ালে প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি করে লাগানো একের পর এক মার্বেল-ফলক। কোনওটায় বাহারি কারুকাজ, কোনওটা নেহাত সাদামাটা। সাদা পাথরে কালো অক্ষর, যেন আর্তনাদ খোদাই করা।
একটার বয়ান, “এই সনদ তৈরি করেছেন অ্যাডমিরাল মার্টিন ও মিসেস মার্টিন, তাঁদের অত্যুৎকৃষ্ট পুত্রের (এক্সেলেন্ট সন) স্মৃতিতে। জন নিকলসন মার্টিন, লেফটেন্যান্ট, বেঙ্গল আর্টিলারি, শৌর্যের সঙ্গে নিজের কর্তব্যপালন কালে বিশ্বাসঘাতক বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিল ২৭ জুন, ১৮৫৭ সালে, জীবনের আঠারোতম বছরে।” উপরে খোদাই করা একটি কামান। নীচে লেখা ধর্মগ্রন্থের বাক্য, “দ্য লর্ড গেভ অ্যান্ড দ্য লর্ড হ্যাথ টেকন অ্যাওয়ে, ব্লেসড বি দ্য নেম অব দ্য লর্ড।” প্রভু দিয়েছিলেন, প্রভুই ফিরিয়ে নিয়েছেন, প্রভুর জয় হোক। সর্বহারার সান্ত্বনা। যা আঁকড়ে এই দম্পতি বেঁচেছিলেন আরও অন্তত আঠারো বছর, কারণ এই গির্জা তৈরি হয়েছিল ১৮৭৫ সালে। এখন এর পরিচয়, কানপুর মেমোরিয়াল চার্চ।
এই সেই জমি, যেখানে দেওয়াল-পরিখা দিয়ে ঘিরে ‘এনট্রেঞ্চমেন্ট’ তৈরি করে সপরিবার আশ্রয় নিয়েছিল ইংরেজরা। তাদের মধ্যে সেনা ছিল শ’তিনেক, আরও তিনশো জন মহিলা ও শিশু, প্রায় দেড়শো জন ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য। কানপুরের ব্রিটিশ জেনারেল হিউ হুইলার ভারতীয় মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন, স্থানীয় ভাষা জানতেন, জনপ্রিয় ছিলেন। তিনিই আরও সুরক্ষিত জায়গার চেয়ে এই জমি বেছে নিয়েছিলেন। নানা দিক থেকে সিপাইদের বিদ্রোহ করার খবর আসছে। ইংরেজদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছে, হত্যা করছে দেখলেই।
শিল্পীর তুলিতে সতীচৌরার ম্যাসাকার ঘাট, এখন এর সরকারি নাম ‘নানা রাও ঘাট’। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
এখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করা যায়, ইতিহাসের কত মুখ, কত রকম মানে। সিপাহি বিদ্রোহকে আমরা এখন বলি ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ। ইতিহাসবিদ রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, আগে বিদ্রোহ ঘটেছে, তার পর চলেছে নেতার খোঁজ। সিপাইরা বিদ্রোহ না করলে, আর শহর-গ্রামের অগণিত মানুষ সেই বিদ্রোহে যোগ না দিলে, বাহাদুর শাহ জ়াফর, নানা সাহেব বা রানি লক্ষ্মীবাইয়ের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখাই হত না। এই সিপাইদের ‘হিরো’ মনে করতেই আমরা ভালবাসি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন রাজশক্তি দখল করে নিয়েছে দিল্লিতে, ভারতের সর্বত্র স্বাধীন রাজাদের একের পর এক পরিণত করছে পেনশন-প্রাপক কাঠপুতুলে, তখন উত্তর ভারতে কেবল নিজের বন্দুকের ভরসায় ইংরেজ হঠানোর লড়াই শুরু করেছিলেন দরিদ্র সিপাইরা। এ তো মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা! তাঁদের রক্তের ধারায় যে খাত কাটা হয়েছিল, সেই পথ দিয়েই কি আসেনি ভারতের স্বাধীনতা? তা তো বটেই। তবু লাল ইটে তৈরি এই গির্জা মনে করায়— এক দিক থেকে যা বীরত্ব, অন্য দিক থেকে দেখলে তা-ই বিশ্বাসঘাতকতা, কাপুরুষতা। এই জমিতে যা ঘটেছিল, যার সাক্ষ্য দিচ্ছে সারি সারি মার্বেল-ফলক, তা পড়লে গর্বে বুক ফুলে ওঠার বদলে কেঁপে ওঠে বেশি।
১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাটে সিপাইরা বিদ্রোহ করে— এনফিল্ড রাইফেলের নতুন কার্তুজ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন পঁচাশি জন সিপাই। ইংরেজ প্রভুরা তাঁদের কয়েদ করলে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ১১ মে বিদ্রোহী সিপাইরা যমুনা পেরিয়ে লাল কেল্লায় পৌঁছে ঝরোখার নীচে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তোলে— দোহাই বাদশা। গানে, শায়রিতে দিন-কাটানো বৃদ্ধ মোগল সম্রাটকে এক রকম বাধ্য করে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করতে, বিদ্রোহকে স্বীকৃতি দিতে। দিল্লিতে ব্রিটিশদের ঘরে ঘরে অবাধ লুটতরাজ, আগুন লাগানো হয়, দেখামাত্র সাদা-চামড়াদের কচুকাটা করা হয়। দিল্লির পতন হয়েছে, খবর আসতেই বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেনা ছাউনিগুলোতে— ২০ মে আলিগড়, ২৩ মে এটাওয়া, মৈনপুরী, ৩০ মে লখনউ।
স্মৃতিচিহ্ন: বিবি ঘর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে নির্মিত দেবদূতীর ভাস্কর্য, বর্তমানে চার্চের প্রাঙ্গণে। ছবি: লেখক।
কানপুরে তার শুরু ২ জুন। ইংরেজদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে পাঁচিল তুলতে, পরিখা বানাতে দেখে সিপাইদের সন্দেহ বাড়ল। গুজব রটল, ওই পরিখা বারুদে ভর্তি করেছে ইংরেজ, পার হতে গেলেই আগুন দেবে। এই শঙ্কাতিক্ত সময়ে মঞ্চে এলেন নানা সাহেব। পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাওয়ের দত্তক পুত্র নানা রাওকে শাসক বলে স্বীকার করেনি কোম্পানি। মহারাষ্ট্র থেকে অপসারিত নানা বাস করছিলেন কানপুরের কাছে বিঠুরে। ইংল্যান্ডের রানির কাছে নিজের হকের জন্য আবেদন-নিবেদন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ইংরেজ তাকে ‘কাছের লোক’ মনে করত, তাই তিনি যখন লোকজন নিয়ে কানপুরের অস্ত্রাগারে প্রবেশ করেন, তখন তাঁকে অস্ত্রাগার রক্ষার ভার দেয়।
নানা সাহেব অস্ত্রাগারটি দখল করে বিদ্রোহী সিপাইদের দলে টেনে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন। ৬ মে থেকে তাঁদের কামান ও গুলিবর্ষণ শুরু হল ইংরেজদের ডেরায়। ও দিক থেকেও নাগাড়ে উত্তর আসতে লাগল। যুদ্ধ চলল, কিন্তু জুনের প্রবল গরমে ইংরেজরা মরতে লাগল জলের অভাবে, কলেরা, ডায়রিয়া, গুটিবসন্তে। মাটি গরমে কাঠ, কবর খোঁড়া অসম্ভব। একটা কুয়োয় মৃতদেহ ফেলে দিত ইংরেজরা। ২৩ মে, ১৮৫৭ ছিল পলাশির যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয়ের একশো বছর পূর্তি। দিনটির মাহাত্ম্য মনে রেখে সারা দিন প্রবল গোলা, বোমাবর্ষণ করল নানা সাহেবের দলবল। তবু ব্রিটিশদের ডেরায় ঢুকতে পারল না। যে ক’জন ঘোড়সওয়ার কাছাকাছি গেল, ইংরেজদের ‘ক্যানিস্টার শট’ (বড় গোলায় ভরা অনেক ছোট গুলি) খেয়ে মরল।
নিহতদের স্মৃতিতে চার্চের দেওয়ালে বসানো মার্বেল-ফলক। ছবি: লেখক।
দু’তরফেরই দশা তখন সঙ্গিন। জল, খাবার, ওষুধ, অস্ত্রের অভাবে ইংরেজরা ধুঁকছে। নানা সাহেবের বাহিনী টানা সতেরো দিন গোলাগুলি চালিয়েও বাগে আনতে পারেনি ইংরেজদের। ২৪ জুন নানা সাহেব এক ইংরেজ মহিলাকে একটা চিঠি দিয়ে পাঠালেন ও পক্ষের কাছে। লেখা ছিল, ইংরেজরা যদি আত্মসমর্পণ করে, তা হলে তিনি তাদের নদী পেরিয়ে ইলাহাবাদে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। হুইলার প্রথম চিঠি খারিজ করে দেন, কারণ তাতে নানা সাহেবের সই ছিল না। পর দিন আর এক মহিলার হাত দিয়ে স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠালেন নানা সাহেব। ইংরেজদের ডেরায় এক দল বলল, লড়াই চলুক। এক দল বলল, নানা সাহেবের প্রস্তাব মেনে নেওয়া হোক।
শেষ অবধি হুইলার আত্মসমর্পণে রাজি হলেন। সবচেয়ে কাছের ঘাট সতীচৌরা। ২৭ জুন সে দিকে রওনা দিল ইংরেজরা। নানা সাহেব মালপত্রের জন্য হাতি, গরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। চল্লিশটা নৌকো অপেক্ষা করছিল। ইংরেজরা তাতে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে বিউগল। অমনি মাঝিরা ঝাঁপ দিয়ে পড়ল নদীতে, আর পাড় থেকে শুরু হল গুলি, কামানের গোলা বর্ষণ। খোলা তলোয়ার হাতে জলে নেমে পড়ল সিপাইরা। গুলি লেগে, কাটা পড়ে কয়েকশো ইংরেজ নারী, শিশু, পুরুষ সেখানেই মারা যান। তাদেরই এক জন হয়তো ছিলেন আঠারো বছরের জন নিকলসন মার্টিন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির একটি মার্বেল-ফলক থেকে দেখা যায়, তাদের সাত জন ইঞ্জিনিয়ার নিহত হয়েছিলেন ২৭ জুন। আর একটি ফলক বলছে, ওই দিন নিহত হয়েছিলেন জেন অ্যামেলিয়া জ্যাকসন, তাঁর স্বামী আর ভাই-সহ। সতীচৌরার ঘাটের নতুন নামকরণ হয়ে গেল ‘ম্যাসাকার ঘাট’। স্থানীয়রা এখনও বলেন ‘মাসকর ঘাট।’ সরকারি নাম ‘নানা রাও ঘাট’।
ছোট ঘাট, শাণ-বাঁধানো সিঁড়ির নীচে খানিকটা কাদামাটির পাড়, তার পর গঙ্গা। তাতে রঙিন নৌকো। বধূবেশ-পরা এক মাঝবয়সি মহিলাকে দেখা গেল, সম্ভবত গঙ্গাতীরে কোনও আচার-রীতি পালন করতে এসেছেন। এই শান্ত ঘাটে দাঁড়িয়ে কল্পনা করতে হয় প্রায় ১৭০ বছর আগের এক দিন। সকাল ন’টা, কাদার চড়ায় আটকানো নৌকো হাতে ঠেলে জলে ভাসানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন পুরুষেরা, নদীর পাড়ের ঝোপঝাড়ের পিছন থেকে ছুটে আসছে গুলি, কামানের গোলা। গ্রামবাসীরাও লাঠি-মুগুর হাতে নেমে পড়েছে জলে। সিপাইরা পাদ্রিকে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছে, মেয়েদের গাঁথছে বেয়নেটে, শিশুদের পা ধরে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে জলে।
গুলিচালনার নির্দেশ দিয়েছিল কে? কেউ বলে নানা সাহেব, কেউ বলে নানার সেনানায়ক তাঁতিয়া টোপে। কেউ বলে নানার নিয়ন্ত্রণ ছিল না, সিপাইরা নিজেরাই আক্রমণ করেছিল। রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় অবশ্য লিখেছেন, ঘটনার দু’দিন আগে রীতিমতো শলাপরামর্শ করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই উন্মুক্ত হিংসা-প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় মানুষকে দেখানো— ইংরেজদের দিন শেষ।
ইংরেজদের অধিকাংশ নৌকো কাদার চড়ায় আটকেই রইল। কয়েকটা জলে ভেসে পালানোর চেষ্টা করে, পিছনে ধাওয়া করে যায় সিপাইরা। বালির চড়ায় নৌকো লেগে যেতে শুরু হয় হাতাহাতি লড়াই। শেষ অবধি মাত্র চার জন পুরুষ সে যাত্রা বাঁচতে পেরেছিলেন। তাঁদের এক জন, ক্যাপ্টেন মোব্রে টমসন, লেখেন ‘দ্য স্টোরি অব কানপুর’ (১৮৫৯)। বইটি ইন্টারনেট আর্কাইভ-এ রয়েছে, বিনা খরচে পড়া যায়। তাতে পাওয়া যায় বিবরণ— মাঝিরা দাঁড় জলে ফেলে, খড়ের ছইতে আগুন লাগিয়ে পালিয়েছে। আহত, অসুস্থরা নৌকোতেই পুড়ে মরছে। মেয়েরা প্রাণভয়ে নৌকো থেকে ঝাঁপ দিয়ে গলাজলে দাঁড়িয়ে। গুলিতে, তরোয়ালে মারা পড়ছে নারী-পুরুষ-শিশু।
এর পর যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের বন্দি করে আনা হল। পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হল। তরুণ নিকলসন এঁদের মধ্যে ছিলেন, এমনও হতে পারে। বাকি মহিলা ও শিশু, সংখ্যায় যাঁরা ছিলেন ২১০, তাঁদের প্রথমে নানা সাহেবের নিজের বাড়ির একটা ঘরে, আর তার পর অত্যন্ত ছোট একটি বাড়িতে, ১৮০০ বর্গফুটের মতো জায়গায়, ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। এই ‘বিবি ঘর’কে টমসন কলকাতার ‘ব্ল্যাক হোল’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। যে মেমসাহেবরা এত দিন হুকুম চালিয়েছে, এখন তারা হুকুমের দাস, বোঝাতে উন্মুক্ত অঙ্গনে তাদের দিয়ে ভুট্টার দানা পেষানো হতে লাগল। এক বেলা ডাল-চাপাটি দিয়ে যেত এক মেথর। প্রচণ্ড গরমে বদ্ধ ঘরে বন্দি, ক্ষত বিষিয়ে গিয়ে, কলেরা হয়ে মৃত্যু শুরু হল। তার মধ্যেই পাওয়া যায় বিবরণ, ওই মেয়েরা কেমন করে নিজেদের গাউন, স্কার্টের কাপড় ছিঁড়ে শিশুদের জন্য হ্যামক বানিয়েছিলেন। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই শিশুদের লুকিয়ে নিতেন গাউনের তলায়। হয়তো আশা ছিল, ইংরেজ সৈন্য এসে উদ্ধার করবে। শেষরক্ষা হল না। ১৫ জুলাই প্রতিটি মেয়ে আর শিশুকে কুপিয়ে হত্যা করে, ফেলে দেওয়া হল কাছের এক কুয়োতে। কানপুর পতনের পর ১৭ জুলাই সকালে সেই ‘হাউস অব হররস’-এ প্রবেশ করে জেনারেল হেনরি হ্যাভলক দেখলেন রক্তে-ভাসা মেঝে, ইতস্তত ছড়ানো রক্তাক্ত জামা-জুতো, টুপি, রক্তের ছিটে লাগা বাইবেল, দেওয়ালে রক্তাক্ত হাতের ছাপ, লম্বা চুল। এর পর ইংরেজদের স্লোগান হয়ে উঠল, ‘রিমেমবার কানপুর।’
কেন এই নিষ্ঠুরতা? আবারও, কোনও নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না। তথ্য বলছে, ১৫ জুলাই নাগাদ যুদ্ধ ঘুরে গিয়েছে— নানা সাহেবের সেনা পিছু হঠছে, যুদ্ধে জিততে জিততে এগোচ্ছেন হ্যাভলক। সে দিন তিনি কানপুর থেকে ২৪ মাইল দূরে। ১৬ জুলাই হ্যাভলকের সঙ্গে যুদ্ধে নামবেন স্বয়ং নানা সাহেব। তার আগে এই নারীমেধ, শিশুমেধ কি কেবল নিষ্ফল ক্রোধ? নাকি এই আশায় যে বন্দিরা মরে গিয়েছে জানলে ইংরেজ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবে? রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায় আর একটা সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। উত্তর ভারতের বিদ্রোহের খবর পৌঁছতে কলকাতা থেকে পাঠানো সেনা পাঠানো হয় ব্রিগেডিয়ার জেমস জর্জ নিল আর জেনারেল হ্যাভলকের অধীনে। ইলাহাবাদ পৌঁছে ব্রিগেডিয়ার নিল এলাকা ‘শান্ত’ করতে উদ্যোগী হলেন। উপায় ছিল খুব সহজ, পথের দু’পাশে গ্রাম কে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, বৃদ্ধ, শিশু-সহ নির্বিচারে হত্যা। দু’দিনের মধ্যে বিয়াল্লিশ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছ থেকে। ব্রিটিশ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করলে কী হতে পারে, শিক্ষা দিতে দিতে এগোচ্ছিলেন তাঁরা। সতীচৌরা ঘাটে ‘ম্যাসাকার’-এর অনেক আগে থেকে ইংরেজের এই বর্বরতার খবর পৌঁছচ্ছে কানপুরে। সমান হিংস্রতা, সমান রক্তপাত ছাড়া আর কী ভাবে নিজেদের শক্তি দেখাত বিদ্রোহীরা?
ইংরেজ পর্যবেক্ষকরাও লিখেছেন, বিদ্রোহ দমন করতে যে হারে অত্যাচার করেছিল কোম্পানির সেনাবাহিনী, নিরপরাধ মানুষদের যে ভাবে যথেচ্ছ হত্যা করেছিল, সিপাইদের কামানের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছিল, তা সিপাইদের হিংসার মাত্রার চাইতে বেশি বই কম নয়। কানপুরে প্রবেশের পর ইংরেজ সেখানকার নিরীহ মানুষদের যে দশা করেছিল, ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। সেই সব হতদরিদ্র, অসহায় মানুষদের নাম-পরিচয় কে লিখে রেখেছে, কোন মন্দির-মসজিদে? তাদের সৌধ পথের ধুলো, নদীর জল।
মেমসাহেবদের হত্যা করার আদেশ নানা সাহেব নিজে দিয়েছিলেন, না আর কেউ, তা-ও জানা যায় না। বিঠুরে নানা সাহেবের প্রাসাদের জায়গায় এখন তৈরি হয়েছে তাঁর একটা মস্ত মূর্তি, পার্ক। ফটকের বাঁ দিকের দেওয়ালে লেখা রয়েছে আজিজনবাইয়ের কথা— এক জন তওয়াইফ, যিনি ইংরেজ খদ্দেরদের খবর গোপনে জোগাতেন সিপাইদের, যুদ্ধও করেছিলেন পুরুষের বেশে। এই আজিজনই নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন বিবি ঘরের হত্যার। আরও এক মহিলার নাম পাওয়া যায়, নানা সাহেবের ঘনিষ্ঠ হুসেইনি খানুম। বছর তিরিশেকের হুসেইনিকে নানা সাহেব বিবি ঘরের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। হুসেইনি সব রকম ভাবে বন্দিদের জীবন অতিষ্ঠ করেছিল, শেষ অবধি নাকি নিজের লোকদের দিয়ে তাদের কোতল করিয়েছিল। নানা রাওকে ‘হিরো’ বানানোর তাগিদে এই মেয়েদের ভূমিকা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয় কি না, কে জানে! তবে নানার অগোচরে এত বড় ঘটনা ঘটতে পারে, তা মেনে নেওয়া কঠিন। ইংরেজের কাছে যুদ্ধে হেরে, অস্ত্রাগারে আগুন লাগিয়ে নানা সাহেব নিখোঁজ হয়ে গেলেন। ইতিহাসের পাতায় তাঁকে আর পাওয়া যায় না।
ইতিহাসের ফাঁক বোজায় সাহিত্য। কানপুরের সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে প্রথম ভারতীয় উপন্যাস লেখেন ঋষভ চরণ জৈন, হিন্দিতে— ‘গদর’ (১৯৩০)। সেখানে দেখা যায়, বিবি ঘর হত্যাকাণ্ডে বিবেকদংশনে জর্জরিত হচ্ছেন নানা সাহেব। সপরিবার পালিয়ে যাওয়ার পথে সকলে স্বেচ্ছায় গঙ্গায় নৌকো ডুবিয়ে জলে তলিয়ে মরছেন। বিদ্রোহীর এমন পরিণতি সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার বইটা নিষিদ্ধ করে দেয়। ইংরেজ আর ভারতীয়দের মধ্যে প্রভু-ভৃত্য, ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক ছাপিয়ে মানুষে-মানুষে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তার উপর বিদ্রোহের অভিঘাত নিয়ে লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। ‘চম্পা’ গল্প কানপুরের এক তরুণীকে নিয়ে, ভালবেসে এক মেমসাহেব যাকে নিজের গলার হার দিয়েছিলেন। সেই অলঙ্কারকে লুটের মাল মনে করে চম্পার বাড়ির পুরুষদের ফাঁসিতে চড়ায় ইংরেজ। মর্মস্পর্শী ‘লছমনের মা’ গল্পটিও, যেখানে ঝাঁসির এক ঘাস-কাটা মেয়ে তার বাড়িতে সিপাইদের থেকে বাঁচিয়ে এক ইংরেজ বালককে লুকিয়ে রাখে, কিন্তু ইংরেজদের হাতে মারা পড়ে তার নিজের ছেলে রাম।
সিপাই বিদ্রোহের কথা আজও দীর্ঘশ্বাস টেনে আনে বুকের ভিতর থেকে। নানার অন্তর্ধানের পর তাঁতিয়া টোপের সঙ্গে লড়াই হয় ইংরেজদের। ২৬ নভেম্বর, ১৮৫৭ সে যুদ্ধে হেরে যান তাঁতিয়া টোপে, কানপুর ইংরেজের দখলে আসে। লক্ষ্মীবাই যুদ্ধে প্রাণ দিলেন, ওয়াজিদ আলি শাহের (তালাক-দেওয়া) বেগম হজ়রত মহল লখনউ থেকে পালিয়ে গেলেন নেপালে, তাঁতিয়া টোপের ফাঁসি হয়ে গেল, বর্মায় নির্বাসিত হলেন শেষ ভারতসম্রাট বাহাদুর শাহ জ়াফর। কালের চাকা ঘুরেছিল ৯০ বছর পরে, যখন ইংরেজ চির-নির্বাসিত হল ভারত থেকে।
অট্টালিকার দেওয়ালে যেমন থাকে ছোট কুলুঙ্গি, কেবল একটি ছবি, মূর্তি কি বাতি নিয়ে, তেমনই ন’দশকের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিচিত্র ঘটনাবলির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে কানপুর মেমোরিয়াল চার্চ। পরাভবের বেদনাটুকু নিয়ে। বিবি ঘর থেকে স্ত্রীর স্মৃতিকে নিষ্কাশিত করতেই যেন লাল পাথরের অপরূপ ঝালর-দেওয়া সাদা মার্বেল-ফলক তৈরি করিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন জর্জ উইলিয়াম ফ্রেজ়ার— “প্রিয় পত্নী অ্যান ফসেট-এর স্মৃতিতে।” স্ত্রী, সন্তান, সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের নাম ঘোষণা করছে একের পর এক ফলক। চার্চের বিপরীতে বাগিচা, তাতে এক দেবদূতীর মূর্তি। তার মুখ বেদনাহত, চোখ নিমীলিত, দু’হাতে দুটি বড় পালক। আগে এটি ছিল বিবি ঘরে, এখন তুলে আনা হয়েছে গির্জার আঙিনায়। শ্বাসরুদ্ধ আতঙ্ক, বীভৎস হত্যার স্মৃতির উপরে স্থাপত্য, ভাস্কর্যের সৌন্দর্য-আবরণ। জয়-পরাজয়, লাভ-ক্ষতির হিসাব লেখে পাঠ্যবই। কিন্তু ইতিহাসের দরজা ফাঁক করে একটু উঁকি দিলেই দেখা যায় যে সর্বকালে, সর্বত্র, ন্যায়ের জন্য যুদ্ধের মধ্যেও ঢুকে থাকে প্রকাণ্ড সব অন্যায়। তখন সহসা ঠাহর করা যায় না, কিসে গর্ব, আর কিসেই বা লজ্জা। বহু যুগের ও-পার থেকে অসহায় বন্দিদের আর্তনাদ এসে মিলে যায় প্যালেস্টাইনে, ইউক্রেনে, সুদানে, মণিপুরে, কাশ্মীরে— নানা দেশে, নানা দ্বন্দ্বে নিয়ত-হন্যমান অসহায়ের আর্তরবে।