Sperm and Egg

শুক্রাণুরা প্রতিযোগিতায় ছোটে না, বিজয়ীকে বেছে নেয় ডিম্বাণুই! কয়েকশো বছরের প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিল গবেষণা

ডিম্বাণু কেবল কোন শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হবে তা নির্ধারণই করে না, বরং ‘নাপসন্দ’ শুক্রাণুগুলিকে ডিম্বাণুর ধারেকাছে পৌঁছোনোর আগেই দূরে সরিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। ২০২০ সালে স্টকহোলম ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, ডিম্বাণু থেকে এমন এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা শুক্রাণুকে আকর্ষণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বাছাবাছির বিষয়েও প্রতিটি ডিম্বাণুর স্বাধীনতা রয়েছে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫১
Not competition, the egg chooses the winning sperm itself, scientist debunks widely believed myth

নিষেকের আগে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু। ছবি: শাটারস্টক।

এ যেন ঠিক রূপকথার গল্প! গল্পের শেষে ঘোড়া ছুটিয়ে সাত সমুদ্র, তেরো নদী, দত্যিদানো পেরিয়ে অবলা, ঘুমন্ত রাজকুমারীকে জয় করে রাজকুমার। ঠিক তেমনই ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনের নেপথ্য কাহিনীও সকলের জানা। কে আগে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছোবে, তা নিয়ে নাকি প্রতিযোগিতা চলে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণুর। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শুক্রাণুরা আগেই পিছিয়ে পড়ে। একে একে বাতিল হয়ে যায় বাকিরাও। লম্বা দৌড়ের পর শেষমেশ সকলকে পিছনে ফেলে ডিম্বাণুর বাইরের পর্দা ভেদ করে প্রবেশ করে ‘বিজয়ী’ শুক্রাণু! দুইয়ের মিলনে তৈরি হয় নতুন প্রাণ। এত দিন ধরে প্রচলিত ধারণা ছিল এমনটাই। এ বার ‘নতুন’ গবেষণায় ভেঙে গেল সেই ‘মিথ’!

Advertisement

এর আগেও অবশ্য বেশ কয়েক বার গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, প্রতিযোগিতায় নয়, বরং ‘যোগ্য’ শুক্রাণুকে বেছে নেয় ডিম্বাণুই। সম্প্রতি আরও এক বার সে কথা উঠে এসেছে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখিকা স্টার ভার্টনের সদ্য-প্রকাশিত বই ‘দ্য স্ট্রংগার সেক্স: হোয়াট সায়েন্স টেল্‌স আস অ্যাবাউট দ্য পাওয়ার অফ দ্য ফিমেল বডি’তে। বইয়ে এটি ছাড়াও নারীদেহ সম্পর্কে আরও নানা প্রচলিত ‘ভুল’ ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ভার্টন, যা থেকে আদতে প্রমাণ হয়, একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষার বিস্তর অভাব রয়ে গিয়েছে জনজীবনে!

ডিম্বাণুর জন্মবৃত্তান্ত

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের প্রজননের বৈশিষ্ট্য হল, ডিম্বাশয়ে একসঙ্গে একাধিক ডিম্বাণু আগে থেকেই তৈরি থাকা। ‘উজেনেসিস’ নামের এই ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া নারীর জন্মের আগেই শুরু হয়ে যায়। জন্মের সময় নারী শরীরে ১০ থেকে ২০ লক্ষ ডিম্বাণু থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে সেই সংখ্যা, কমত থাকে ডিম্বাণুর গুণমানও। বয়ঃসন্ধিকালে তা তিন থেকে চার লক্ষে গিয়ে ঠেকে। যদিও তার বেশির ভাগ ডিম্বাণুই বাতিল হয়ে যায়। নারীর প্রজননক্ষম বছরগুলিতে সব মিলিয়ে সাকুল্যে ৩০০ থেকে ৪০০টি ডিম্বাণু নিষেকের যোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু একবারে একটি মাত্র ডিম্বাণুই প্রস্তুত করে নারীশরীর। স্তন্যপায়ী প্রাণীর এই প্রজনন কৌশল এসেছে দফায় দফায় অভিযোজনের মাধ্যমে। ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক লিনেট সিভার্ট বলছেন, এর আগেকার পদ্ধতিটি ছিল জীবদ্দশায় এক সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু তৈরি করা। এখনও মাছ, উভচর প্রাণী এবং সরীসৃপদের প্রজনন হয় সেই চিরাচরিত পদ্ধতিতেই। স্ত্রী মাছ এবং ব্যাঙেরা তাদের ডিম্বাণুর সমস্তটাই জলে ফেলে দেয়। সেই ডিম্বাণুর দিকে তাদের শুক্রাণু নিক্ষেপ করে পুরুষ মাছ ও ব্যাঙেরা। ক্রমে নিষিক্ত ডিম্বাণুগুলি বিকশিত হয়। কোনও কোনওটি নষ্ট হয়ে যায় প্রতিকূল পরিবেশের কারণে। কোনওটির আবার খাদ্যশৃঙ্খলের উপরের দিকে থাকা প্রাণীদের পেটে জায়গা হয়! সামুদ্রিক কচ্ছপেরা আবার যৌন মিলন করে, কিন্তু তারাও একসঙ্গে কয়েকশো নিষিক্ত ডিম পাড়ে। ওভিপেরাস সাপেরাও তাই। এই সব প্রাণীদের জন্য প্রজনন হল সংখ্যার খেলা! অগুন্তি ডিম্বাণু, অগুন্তি শুক্রাণু, অগুন্তি নিষিক্ত ডিম এবং— অগুন্তি সন্তান! মানুষের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে অনেক শুক্রাণু উৎপাদনের এই কায়দা পুরুষদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু নারী শরীর সে রকম নয়। আর সেখানেই রয়েছে আসল রহস্য।

Not competition, the egg chooses the winning sperm itself, scientist debunks widely believed myth

শুক্রাণুর ‘প্রতিযোগিতা’। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

ডিম্বাণু বড়ই ‘খুঁতখুঁতে’!

লিনেটের কথায়, ‘‘মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাছের প্রজননের কায়দাই রপ্ত করেছে পুরুষেরা। তারা এখনও এক সঙ্গে লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু উৎপাদন করে। অথচ তারা যে কেবল সেরা শুক্রাণুগুলিই বেছে বেছে বার করে দিচ্ছে, এমনটা কিন্তু নয়! বরং মাছের মতো কোনও বাছবিচার না করেই সমস্ত শুক্রাণু বার করে দেয় তারা।’’ এ বার প্রশ্নটা হল, তা হলে নারীদের ক্ষেত্রে কেন সেই নিয়ম খাটে না? লিনেট বলছেন, ‘‘এখানেই রয়েছে জীববিজ্ঞানের এক অমীমাংসিত প্রশ্ন, যে প্রশ্নের উত্তর মেলে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, এমন কিছু পরিবর্তন হয়েছিল, যা পৃথক করেছে দুই লিঙ্গের প্রজনন কৌশলকে।’’

তবে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না মিললেও এই রহস্যের একটি সম্ভাব্য উত্তর অনুমান করে নেওয়াই যায়— নিয়ন্ত্রণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্ত্রী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে নিষেক হয় তাদের দেহের অভ্যন্তরেই। অথচ উভচর, সরীসৃপ কিংবা মাছেদের ক্ষেত্রে তা নয়। সে কারণেই এই অবশ্যম্ভাবী সংখ্যানিয়ন্ত্রণ। তবে মাছ কিংবা ব্যাঙেদের ক্ষেত্রেও যে বিপুল সংখ্যক অপত্যের সকলেই বেঁচে থাকে তা নয়। প্রতিকূল পরিবেশ, শিকারীর নজর, জলের লবণাক্ততা, দূষণের মতো নানা পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে স্থির হয়, শেষমেশ কে কে বেঁচে থাকবে আর কে মারা যাবে। স্পষ্টত, উভয় কৌশলই কার্যকর। স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিষয়টা একই রকম। এখানে কেবল কোন অপত্য বেঁচে থাকবে আর কে থাকবে না, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গর্ভধারণের আগেই নিয়ে ফেলে নারীশরীর! ফলে স্বভাবতই কোন বিশেষ ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মিলন হবে, তা-ও স্থির হয়ে যায় নিষেকের আগেই।

Not competition, the egg chooses the winning sperm itself, scientist debunks widely believed myth

একক শুক্রাণু। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

আর যখন একসঙ্গে অগুন্তি অপত্যের বদলে মাত্র একটি বা দু’টি সন্তান জন্মের প্রশ্ন ওঠে, তখন এটি নিশ্চিত করাও প্রয়োজন হয়ে পড়ে যে সেই সন্তানের বেঁচে থাকার সর্বোত্তম সম্ভাবনা রয়েছে কি না। সে কারণেই চলে ‘যোগ্য’ শুক্রাণু বাছাই!

বিজ্ঞান বনাম সমাজ

ডিম্বাণু কেবল কোন শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হবে তা নির্ধারণই করে না, বরং ‘নাপসন্দ’ শুক্রাণুগুলিকে ডিম্বাণুর ধারেকাছে পৌঁছোনোর আগেই দূরে সরিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। ২০২০ সালে স্টকহোলম ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছিলেন, ডিম্বাণু থেকে এমন এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা শুক্রাণুকে আকর্ষণ করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, বাছাবাছির বিষয়েও প্রতিটি ডিম্বাণুর স্বাধীনতা রয়েছে। আলাদা আলাদা ডিম্বাণুর আলাদা আলাদা ধরণের শুক্রাণুকে পছন্দ হয়। কেবল মাত্র সেই ধরনের শুক্রাণুকেই রাসায়নিক সঙ্কেত পাঠায় সে। সব শেষে শুরু হয় ‘স্বয়ম্বর’!

তবে ডিম্বাণুই যে বেছে নেয় শুক্রাণুকে, এ সত্য কিন্তু অতীতেও ‘আবিষ্কৃত’ হয়েছে বহু বার, সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই! তবু এই সাধারণ জৈবিক সত্যকে মেনে নিতে এত অনীহা কেন? কোথা থেকেই বা এল এই ‘দুরন্ত, দুর্দমনীয় শুক্রাণু এবং গোবেচারা, অপেক্ষারতা ডিম্বাণু’র গল্প?

সেই কোন ১৯৯১ সালে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন এমিলি মার্টিন তাঁর গবেষণাপত্র ‘দ্য এগ অ্যান্ড দ্য স্পার্ম: হাউ সায়েন্স হ্যাজ কন্সট্রাক্টেড আ রোম্যান্স বেস্‌ড অন স্টিরিয়োটিপিক্যাল মেল-ফিমেল রোল্‌স’-এ। আসলে, উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে সমাজের প্রচলিত লিঙ্গবৈষম্যেই। সমাজে মেয়েরা আজও ‘দুর্বলতা’, ‘নিষ্ক্রিয়তা’-র নামান্তর। সে বৈষম্যের বীজ এতটাই গভীরে প্রোথিত যে কখনও কখনও চিরাচরিত ধারণার বিপরীতে জৈবিক, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা গ্রহণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ’৯০-এর দশকের আবিষ্কার ‘পুনরাবিষ্কৃত’ হয় ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল পড়ুয়া আবার সেই তথ্যই আবিষ্কার করেন ‘নতুন’ গবেষণায়। প্রবন্ধের মুখবন্ধে লেখা হয়, ‘‘এ এক অপ্রত্যাশিত আবিষ্কার!’’

আবার, কখনও কখনও ঘটে উল্টোটাও! যুগ যুগ ধরে বৈষম্যের এ হেন আত্মীকরণে কখনও কখনও না চাইতেই প্রভাবিত হয়ে যায় বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা। বিজ্ঞানচিন্তায় নারীবাদী দর্শনের অন্যতম পথিকৃৎ ইভলিন ফক্স কেলার দেখিয়েছিলেন, জীববিজ্ঞানের সরল থেকে সরলতম সংজ্ঞাও কী ভাবে লিঙ্গবৈষম্যের পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে। আর ঠিক সে কারণেই এত আলোচনার পরেও বিজ্ঞান বইয়ের পাতায় এখনও লেখা থাকে, ছুটে গিয়ে অপেক্ষারত ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে যোগ্যতম শুক্রাণুই।

Advertisement
আরও পড়ুন