গৌতম গম্ভীর। —ফাইল চিত্র।
স্যর অ্যালেক্স ফার্গুসন কি এখন জেলে যেতেন? প্যাট্রিস এভরা তাই মনে করছেন। তিনি ফার্গুসনের ছাত্র। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন ফুটবলার এভরা বৃহস্পতিবার হঠাৎ বলে বসেন, ফার্গুসন যদি এখন কোচিং করাতেন তা হলে নির্ঘাত তাঁর জেল হত।
কথাটা এত দিন পর হঠাৎ বলেছেন এভরা, কিন্তু তাঁর ধারণাটা হঠাৎ নয়। ফার্গুসনের কোচিংয়ে যাঁরা খেলেছেন, তাঁরা অনেকেই একই কথা বলবেন। একই কথা কি প্রযোজ্য গৌতম গম্ভীরের ক্ষেত্রেও? না, ভারতীয় দলের নতুন কোচের হয়তো জেল হবে না, কিন্তু ক্রিকেটারদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হতেই পারে। জলজ্যান্ত উদাহরণ রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলির তড়িঘড়ি টেস্ট থেকে সরে যাওয়া। ‘কোচই বস্’ মন্ত্রের গুরুগম্ভীর আবহে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটার হালই ছেড়ে দিয়েছেন। ক্রিকেটবিশ্বে এই তালিকায় গম্ভীরের পর নতুন সংযোজন দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ শুকরি কনরাড। তাঁর ‘কোচই বস্’ মন্ত্রে নাভিশ্বাস উঠেছে শক্তিশালী আইপিএলেরও!
ফার্গুসনের পাশাপাশি আর্সেন ওয়েঙ্গারকেও দেখেছে ফুটবলবিশ্ব। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, আর্সেনালের ফুটবলার-কর্তাদের সাহস হত না ম্যানেজারদের উপরে কথা বলার। দল এবং ফুটবলের ব্যাপারে তাঁরাই ছিলেন শেষ কথা। আধুনিক যুগের পেপ গুয়ারদিওলা, যুরগেন ক্লপদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিন্তু এত দিন ক্রিকেটবিশ্বে তাঁদের মতো দাপট দেখাতে পারেননি কেউ। বদলে যাওয়া সময়ে আবির্ভাব গ্রেগ চ্যাপেল, অনিল কুম্বলেদের। এখন গম্ভীর, কনরাড। ক্রিকেটেও কোচেরা যে বস্ হয়ে উঠতে পারেন, প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সেই ধারণা। ক্রিকেটারদের সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন গম্ভীরেরা। কে কী বললেন, তা নিয়ে ভাবার সময় বা ইচ্ছা কোনওটাই নেই তাঁদের।
গম্ভীর ক্রিকেটবিশ্বে পরিচিত নাম। প্রায় আড়াইশো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজারের বেশি রান করেছেন। দু’টি বিশ্বজয়ী দলের সদস্য। অধিনায়ক হিসাবে আইপিএল জিতেছেন। মেন্টর হিসাবেও জিতেছেন। সেখানে কনরাড কে! গম্ভীরের মতো উজ্জ্বল অতীত নেই দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলের কোচের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটে নেই। কোচ হিসাবেও নেই। অথচ তিনিই সুর চড়িয়েছেন একেবারে আইপিএলের বিরুদ্ধে!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন ভারতের দাপট। একটা সময় পর্যন্ত এই আধিপত্য ছিল ইংল্যান্ডের। পরে সেখানে ভাগ বসায় অস্ট্রেলিয়া। এখন এই দু’দেশকে সরিয়ে ভারতই ক্রিকেটের প্রথম বিশ্ব। সময় যত এগিয়েছে ভারতের দাপট তত বাড়ছে। ভারতে ক্রিকেটের সফল বিপণন বদলে দিয়েছে সমীকরণ। বিসিসিআই হয়ে উঠেছে ক্রিকেটের মহাশক্তি। কনরাড সেই বিসিসিআইকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন! অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেট কর্তারাও বিসিসিআইকে খানিকটা সমঝে চলেন। সরাসরি বিরোধিতার পথে হাঁটেন না। অথচ কনরাড ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছেন।
বিসিসিআইয়ের আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম আইপিএল। কোভিড, নির্বাচন কিছুই ঠেকাতে পারেনি এই কোটিপতি লিগকে।
এ বার ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষও আইপিএল বন্ধ করতে পারেনি। নিরাপত্তার স্বার্থে এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল মাত্র। আবার ১৭ মে থেকে শুরু হবে খেলা। নতুন করে তৈরি হয়েছে সূচি। আইপিএল চলবে ৩ জুন পর্যন্ত। আগের সূচি অনুযায়ী ফাইনাল ছিল ২৫ মে। সংঘাতটা ঠিক এখানেই। নতুন ‘গম্ভীর’ হয়ে দেখা দিয়েছেন কনরাড। দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ বলে দিয়েছেন, তিনি তাঁর দলের ক্রিকেটারদের ২৫ মে-র পর আর আইপিএল খেলতে দেবেন না। কারণ, ১১ জুন থেকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি তাঁর দল। শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবরে যদিও জানা যাচ্ছে, ভারতের কাছে নতিস্বীকার করে দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ড তাদের প্রস্তুতি শিবির পিছিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ‘গম্ভীর’ কনরাড সাহস দেখিয়েছেন আইপিএলের বিরুদ্ধে যাওয়ার।
কনরাড বলেছেন, ‘‘আইপিএল এবং বিসিসিআইয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ২৫ মে ফাইনালের পর ২৬ মে ক্রিকেটারেরা ফিরে আসবে। আমাদের দিক থেকে কোনও কিছু পরিবর্তন করা হয়নি। এখনও পর্যন্ত সেটাই ঠিক আছে। আমি চাই আমাদের ক্রিকেটারেরা যেন ২৬ মে দেশে ফিরে আসে। ৩১ মে-র মধ্যে ইংল্যান্ডের মাটিতে সম্পূর্ণ টেস্ট দলকে দেখতে চাই।’’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুধু উগান্ডার কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা থাকা ৫৮ বছরের কনরাড ভারতীয় ক্রিকেটকে চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন! ভারতের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে বিশ্বের তাবড় ক্রিকেট-কর্তারাও আমতা-আমতা করেন। কনরাড আসলে ‘গম্ভীর’ ধাতুতে গড়া। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে তিনিই এখন ‘বস্’। ঠিক যেমন ভারতের গম্ভীর। বিসিসিআইয়ের কাছে গম্ভীর নাকি জাতীয় দলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা চেয়ে নিয়েছেন। দল নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন তাঁর। গম্ভীরের কড়া মনোভাব দেখা গিয়েছে গত কয়েক মাসে। অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ফেরার পর বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের রঞ্জি ট্রফি খেলতে বাধ্য করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিডনি টেস্টের আগে রোহিতের বদলে নিজে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন। ফর্মে না থাকা অধিনায়ক রোহিতকে অস্ট্রেলিয়ায় শেষ টেস্টে প্রথম একাদশ থেকে ছেঁটে ফেলেছেন। গম্ভীরের কঠোর মনোভাবে টেস্টজীবন সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য হয়েছেন কোহলি, রোহিত। অস্ট্রেলিয়া সফরের মাঝেই অবসর নিতে হয়েছে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে! গম্ভীর বিসিসিআই কর্তাদের কাছ থেকে এক রকম ‘স্বায়ত্তশাসন’ পেয়ে গিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছামতোই তিন ধরনের ক্রিকেটে তৈরি হবে ভারতীয় দল। শেষ কথা বলবেন তিনিই। এখন টিম ইন্ডিয়ার ‘বস্’ গম্ভীর।
গম্ভীর আধুনিক কোচিংয়ের ফার্গুসন। যদিও ফার্গুসনের ছাত্র, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রাক্তন ফুটবলার প্যাট্রিস এভরা দাবি করেছেন, এখন কোচিং করালে জেলে যেতে হত ফার্গুসনকে। ম্যান ইউয়ে দীর্ঘ দিন খেলেছেন এভরা। পাঁচটি লিগ খেতাব জিতেছেন। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছেন। তাঁর মতে, ফার্গুসন যে ভাবে কোচিং করাতেন তা আজকালকার দিনে অচল। এভরার কথায়, “ফার্গুসন এখন কোচিং করালে হয়তো জেলে যেতে হত। যে ভাবে কাজ করতেন তাতে ওঁকে জেলে পাঠানো ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা পাওয়া যেত না। আপনারা জানেন ওঁর জন্য কত জন ফুটবলারকে চোখের সামনে কাঁদতে দেখেছি?”
এভরা উল্লেখ করেছেন ফার্গুসনের বিখ্যাত ‘হেয়ারড্রায়ার ট্রিটমেন্ট’-এর কথা। অর্থাৎ, হেয়ারড্রায়ার থেকে যে ভাবে জোরালো এবং শব্দ করে হাওয়া বার হয়, সে ভাবেই ফার্গুসনের মুখ থেকে ফুটবলারদের উদ্দেশে তীব্র স্বরে আওয়াজ এবং শব্দের বন্যা বেরিয়ে আসত। অনেকেই তা সহ্য করতে পারতেন না। লিভারপুলের মাঠে হওয়া একটি ম্যাচের কথা উল্লেখ করেছেন এভরা। সেই ম্যাচে লিভারপুলের জেমি ক্যারাঘারের ট্যাকলে জোরে আঘাত পেয়েছিলেন ম্যাঞ্চেস্টারের নানি। তিনি মাঠেই কাঁদতে শুরু করেছিলেন। তাঁকেও ছাড়েননি ফার্গুসন। এভরার কথায়, “ফার্গুসন ওকে বলেছিলেন, ‘মনে হয় তোমার পা ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু ইউনাইটেডের ফুটবলারেরা কখনও অ্যানফিল্ডে (লিভারপুলের ঘরের মাঠ) এসে কাঁদে না। যদি রক্ত পড়ছে বলে তুমি কাঁদো, তা হলে তুমি শেষ। তুমি আর আমাদের অংশ নও।”
ফার্গুসনের আত্মজীবনী ‘ম্যানেজিং মাই লাইফ’ বা ‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’ গম্ভীর পড়েছেন কি না জানা নেই। কিন্তু এভরার কথা কি কোনও ভাবে প্রভাবিত করবে গম্ভীরকেও? ভারতের কোচ এখন কড়া হাতে দলের রাশ নিয়েছেন। ফার্গুসনের মতোই তিনিও দলের খেলোয়াড়দের অনুশাসন, শৃঙ্খলা এবং দলীয় সংস্কৃতি মেনে চলার দিকে জোর দেন। অনেকেই মনে করছেন, গম্ভীরের এই আগ্রাসন কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এমনকি ভবিষ্যতে ক্রিকেটারদের বিদ্রোহের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কুম্বলেকে সরে যেতে হয়েছিল কোহলিদের বিদ্রোহের আঁচে। গ্রেগ শুরুতে নিজের কার্যসিদ্ধিতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর জন্য অধিনায়কত্ব গিয়েছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের। শেষে অবশ্য গ্রেগকেও ছাঁটাই হতে হয়।
গম্ভীরের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যা-ই ঘটুক, সেটা সময় বলবে। কিন্তু এত দিন পর্যন্ত ক্রিকেটে যেখানে দাপট দেখা যেত ক্রিকেটারদের, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্তাদের, সেই ধারা বদলাতে শুরু করেছে। কোচেরাই এখন নতুন ‘বস্’। তাঁরাই শেষ কথা বলছেন। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, কর্তারা শুনছেন। গম্ভীর, কনরাড দু’জনেই কড়া ধাঁচের। নিজের ক্রিকেট দলের স্বার্থে কড়া মন্তব্য করতে বা পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করেন না। তাতে কাদের কী হল, তার তোয়াক্কা করেন না। নিজেদের পরিকল্পনার সঙ্গে আপস করেন না। কোনও চাপের মুখে পিছিয়ে যান না। তাঁদের সামনে তাই চুপসে যান তাবড় ক্রিকেটারেরা। তাঁরাই এখন ক্রিকেটের ফার্গুসন, ওয়েঙ্গার। গম্ভীর, কনরাডদের হাত ধরেই হয়তো শুরু হয়ে গেল নতুন সমীকরণ।