ICC Women ODI World Cup 2025

বিজ্ঞাপন বা প্রচারে খামতি নেই, কিন্তু স্মৃতি-হরমন-জেমাইমার ব্যাটে রান-খরা! বিশ্বকাপে মাথা কাটা যাচ্ছে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের

ভারতের টপ অর্ডারের তিন ব্যাটারেরই রানের খরা চলছে। যে টপ অর্ডারকে ‘মহাতারকা’ ধরা হয়, তাঁরাই এখন দলের ‘দুর্বলতম’ জায়গা হয়ে উঠছেন। ব্যানার, বিজ্ঞাপনের মুখ হচ্ছেন বটে। কিন্তু দলের জয়ের মুখ হয়ে উঠতে পারছেন না।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৫৭
Smriti Mandhana, Harmanpreet Kaur, Jemimah Rodrigues

(বাঁদিক থেকে) স্মৃতি মন্ধানা, হরমনপ্রীত কৌর, জেমাইমা রদ্রিগেজ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম

স্মৃতি মন্ধানাকে তিনি বলেন ‘স্মৃতিদিদি’। হরমনপ্রীত কৌর তাঁর ‘হ্যারিদিদি’। তা, বিশ্বকাপে দুই দিদির পথেই চলেছেন জেমাইমা রদ্রিগেজ। স্মৃতিদিদি এখনও পর্যন্ত তিন ম্যাচে করেছেন ৫৪ রান। হ্যারিদিদি ৪৯। বোন জেমাইমার হাল তার চেয়েও খারাপ। তিন ম্যাচে করেছেন মাত্র ৩২ রান। শেষ দু’টি ম্যাচে শূন্য! অর্থাৎ, একটি ম্যাচে ৩২ রানই এখনও পর্যন্ত তাঁর সম্বল। সে ম্যাচেও ৭ রানে ফিরতে পারতেন। আউট হয়ে গিয়েছিলেন। ‘নো বল’ হওয়ায় বেঁচে যান।

Advertisement

বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচে ভারতের টপ অর্ডারের এই তিন ব্যাটার ব্যর্থ। আক্ষরিক অর্থেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের ‘মাথা’ কাটা যাচ্ছে! ‘মহাতারকা’ ব্যাটারেরা ব্যানার, বিজ্ঞাপনের মুখ হচ্ছেন বটে। কিন্তু দলের জয়ের মুখ হয়ে উঠতে পারছেন না। বস্তুত, ভারতের ম্যাচ চলাকালীন স্মৃতিকে যতক্ষণ ওভারের বিরতিতে বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, ততক্ষণ তাঁকে টানা ক্রিজে দেখা যায় না। হাসিখুশি জেমাইমাকে ভারতের মহিলা ক্রিকেটের ‘ভবিষ্যৎ’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। খেলার মধ্যে মাঠে সতীর্থ ও দর্শকদের সঙ্গে মশকরা করেন। মাঠের বাইরে নাচ, গান, গিটার বাজিয়ে ভিডিয়ো দেন সমাজমাধ্যমে। ফিল্ডার হিসাবেও জেমাইমা নির্ভরযোগ্য। ব্যাটে রান না থাকলেও বিশ্বকাপে সেই সুনাম এখনও পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রেখেছেন তিনি।

Harmanpreet Kaur

রানের অপেক্ষায় ভারত অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর। — ফাইল চিত্র

সেই টানা ব্যর্থতার আবহেই রবিবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (বস্তুত, সাতবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন) অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হচ্ছে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আগের ম্যাচ হেরে এমনিতেই নড়বড়ে গোটা দল। তার উপর ব্যাটিংয়ের ‘মাথা’ বলে কিছু নেই। প্রতি ম্যাচে ‘লেজ’ বাঁচাচ্ছে দলকে। ফলে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কার্যত অগ্নিপরীক্ষায় নামবেন স্মৃতি-হরমন-জেমাইমা।

ঘটনাচক্রে, বিশ্বকাপের অব্যবহিত আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজ়ে জোড়া শতরান করেছিলেন স্মৃতি। তার মধ্যে একটি মাত্র ৫০ বলে। ভারতের পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্রুততম শতরান। কিন্তু বিশ্বকাপে তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, ‘সেট’ হওয়ার আগেই মারতে যাচ্ছেন। স্ট্রোক করতে গিয়ে হাতে ব্যাট ঘুরে যাচ্ছে। শরীরের মধ্যে বল করলে অস্বস্তিতে পড়ছেন। ব্যাটিংয়ে খারাপ ফর্মের ছাপ পড়েছে তাঁর ফিল্ডিংয়েও। দক্ষিণ আফ্রিকার নাদিন ডি’ক্লার্কের সহজ ক্যাচ ফস্কেছেন স্রেফ দেরিতে দৌড় শুরু করে। ঘটনাচক্রে, সেই নাদিনের ব্যাটেই জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। হরমন ম্যাচের আগে যতগুলো বল ‘নকিং’ করেন, ম্যাচে তত বল টেকেন না। জেমাইমার শক্তি ছিল সুইপ শট। কিন্তু বিশ্বকাপে দু’টি ম্যাচে সেই সুইপ মারতে গিয়েই আউট হয়েছেন তিনি। কারণ, প্রতিপক্ষের স্পিনারেরা বুঝে গিয়েছেন, স্পিনারকে সুইপ ছাড়া আর কিছু মারতে পারেন না জেমাইমা। সেই ফাঁদেই বারবার তাঁকে ফেলা হচ্ছে।

দেশের মাঠে বিশ্বকাপের মতো ‘বড়’ প্রতিযোগিতার চাপ কি নিতে পারছেন না তাঁরা? বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তা মনে করছেন না। তাঁর কথায়, “আমার মনে হয় না বিশ্বকাপের চাপ ওদের উপর আর আছে। এত বছর ধরে খেলছে! তবে তিনটে ম্যাচ দেখেই সমালোচনা করা উচিত নয়। পরের ম্যাচেই ওরা রান করতে পারে। আমি অন্তত আশাবাদী।”

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম

একই অভিমত ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক তথা স্মৃতি-হরমনের প্রাক্তন সতীর্থ ঝুলন গোস্বামীরও। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওদের যোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের কোনও জায়গা নেই। প্রত্যেকেই নিজেকে বহু বার প্রমাণ করেছে। রান পাওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।’’ বস্তুত, ঝুলন মানতে চান না যে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাঁর বরং যুক্তি, ‘‘এটা লম্বা প্রতিযোগিতা। সবে তো তিনটে ম্যাচ হয়েছে। শুরুর দিকে যে কোনও ব্যাটারেরই খারাপ পারফরম্যান্স হতে পারে। আবার বলছি, ওরা যে কোনও ম্যাচে রান পাবে। বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তো স্মৃতি অসাধারণ খেলেছে। বিশ্বকাপে বিভিন্ন ধরনের উইকেটে খেলতে হয়। প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষও বদলে যায়। ফলে অনেক সময় নিজেকে মানিয়ে নিতেও একটু সময় লাগে।’’ স্মৃতি-হরমনের প্রাক্তন অধিনায়কের মতে, প্রতি ম্যাচে এতগুলি ‘ডট বল’ হচ্ছে মানিয়ে নিতে সময় লাগছে বলেই। তাঁর কথায়, ‘‘উইকেট কিছুটা মন্থর। বল আসছে না ঠিকমতো। তাই অত ডট বল হচ্ছে। উইকেট ধরে রেখে খেলার চেষ্টা করছে ভারতীয় দল। তাতে ভুল কিছু নেই।’’

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম

বাংলার ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদার মনে করছেন, তিন ব্যাটারই শুরু থেকে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক খেলতে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এটা টি-টোয়েন্টি নয়। ৫০ ওভারের খেলা। ফিল্ডার কোথায় আছে, কোন বোলারকে মারব, কাকে দেখে খেলব— এসব মাথায় রেখে পরিকল্পনা করে খেলতে হয়। সেটা ওরা করছে না বলেই মনে হচ্ছে। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের চাপ আছে বলেও মনে হচ্ছে।’’ বাংলার অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের মূল্যায়ন, ‘‘একদিনের ক্রিকেটে এক জন ব্যাটার ইনিংসে ৩০ শতাংশ ডট বল খেললে সেটা ঠিকঠাক বলে ধরা হয়। সেখানে ভারত ইনিংসে ৬০ শতাংশ ডট বল খেলছে। এটা অনেক। এক ফলে নিজেরাই নিজেদের চাপে ফেলে দিচ্ছে।’’

গ্রফিক: আনন্দবাজার ডট কম

ঘটনাচক্রে, টপ অর্ডারের লাগাতার ব্যর্থতা বিশ্বকাপের সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মিতালি রাজ যা বলেছেন, তার সঙ্গে মিল আছে অনুষ্টুপের বক্তব্যের। মিতালির ব্যাখ্যা, ‘‘ওরা তাড়াহুড়ো করছে। এটা ৫০ ওভারের খেলা। একটু দেখে নিয়ে হাত খুললে ভাল।’’ তিন ব্যাটারের রান পাওয়া নিয়ে ‘আশাবাদী’ সম্বরণও মনে করছেন, তাড়াহুড়ো করছেন মন্ধানারা। সেটাই সমস্যায় ফেলছে। তাঁর কথায়, “ওদের দেখে মনে হচ্ছে বেশি ছটফট করছে। সময় নিচ্ছে না। বাজে শট খেলে আউট হচ্ছে। এত ছটফট করলে হবে না।”

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম

কিংবদন্তি ক্রিকেটার সুনীল গাওস্করের টোটকা, টেস্ট ম্যাচে প্রথম ঘণ্টা বোলারকে দাও। পরের পাঁচ ঘণ্টা তুমিই ব্যাটটা করবে। এখনকার টি-টোয়েন্টি দুনিয়ায় এক দিনের ম্যাচ কার্যত টেস্টের মতো। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দর্শকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। সেই ধৈর্যহীনতার প্রভাবই কি ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটারদের উপর পড়ছে? নইলে প্রথম বল থেকেই শট খেলার প্রবণতা কেন? বিশেষত, ইনিংস শুরু করে? এমনও নয় যে, ‘পাওয়ার প্লে’-তে ব্যাট চালিয়ে প্রচুর রান তুলতে পারছেন স্মৃতি। তাঁর চেয়ে তুলনামূলক ভাবে সফল তাঁর ওপেনিংয়ের জুড়ি প্রতীকা রাওয়াল।

ক্রিকেটের ফর্ম্যাট যত লম্বা হয়, দৌড়ে রান নেওয়ার গুরুত্ব তত বাড়ে। টি-টোয়েন্টি চার-ছক্কার খেলা হলেও এক দিনের ক্রিকেট ও টেস্ট ক্রিকেটে এক রান-দু’রানেই ইনিংসের ভিত তৈরি হয়। যেমন করেন বিরাট কোহলি। কিন্তু তাঁর দেশের মহিলা ক্রিকেটারদের দৌড়ে রান নেওয়ার অনিচ্ছা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারত ১৮০টি ডট বল (যে বলে কোনও রান হয় না) খেলেছে। অর্থাৎ, ৫০ ওভারের মধ্যে ৩০ ওভারে কোনও রানই হয়নি। ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার অঞ্জুম চোপড়া সম্প্রচারকারী চ্যানেলে বলেছেন, “৩০ ওভার কোনও রান হয়নি। এক দিনের ক্রিকেট কেন, টেস্টেও এই ছবি দেখা যায় না। কোনও দল এত ডট বল খেললে রান কী ভাবে হবে? দৌড়ে রান নেওয়াটাও শিখতে হবে। শুধু বড় শটের উপর ভরসা করলে হবে না। মনে রাখতে হবে, এ বার দেশের মাঠে খেলা। ভারতীয় দল সুবিধা পাবে এমন পিচই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও ওরা রান করতে পারছে না।”

দেশের মাঠে বিশ্বকাপ অভিযানে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৮ রান করেছিলেন স্মৃতি। পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁর রান ২৩ এবং ২৩। হরমন শ্রীলঙ্কা ম্যাচে করেছেন ২১, পাকিস্তান ম্যাচে ১৯ এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে ৯ রান।

একদিনের ক্রিকেটে অবশ্য স্মৃতি-হরমনের পরিসংখ্যান ঈর্ষণীয়। ১১১টি ম্যাচে স্মৃতির রান ৪,৯৪২। গড়৪৭.০৬। ১৩টি শতরান। হরমন ১৫৫ ম্যাচে করেছেন ৪,১৯৮ রান। সাতটি শতরান আছে তাঁর। কিন্তু বিশ্বকাপে গোলমাল করে ফেলেন। স্মৃতি ২০১৭ থেকে বিশ্বকাপ খেলছেন। এখনও পর্যন্ত ১৯টি ম্যাচে তাঁর মোট রান ৬১৩। গড় ৩৪। বিশ্বকাপে মাত্র দু’টি শতরান আছে তাঁর। ২০১৭ এবং ২০২২ সালে। হরমনের বিশ্বকাপ গড় অবশ্য স্মৃতির তুলনায় ভাল। তবে তিনি ম্যাচও বেশি খেলেছেন। ২৯টি। ৯২৫ রান করেছেন। তিনটি শতরান। ২০১৭ সালের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৭১ রান ছিল তাঁর। স্মৃতির মতো তিনিও ২০২২ সালের বিশ্বকাপে একটিই শতরান করেছিলেন।

জেমাইমা এ বারই প্রথম বিশ্বকাপ খেলছেন। এখনও পর্যন্ত ৪১টি একদিনের ম্যাচ খেলে ১,০৮৯ রান করেছেন। গড় ২৯.৪৩। একটিই শতরান আছে তাঁর।

মিতালি এবং ঝুলনের অবসরের পর হরমন এবং স্মৃতি ভারতের মহিলা ক্রিকেটের ‘পোস্টার গার্ল’। ধীরে ধীরে তাঁদের পাশে জায়গা করে নিয়েছেন জেমাইমাও। সব বিজ্ঞাপনে তাঁরা। সমস্ত ব্যানার-হোর্ডিংয়েও তাঁরা। বোর্ডের অনুষ্ঠানে রোহিত শর্মা-হার্দিক পাণ্ড্যদের পাশে মঞ্চে তাঁদের স্থান। বিশ্বকাপে শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া ‘থিম সং’-এর ভিডিয়োতেও রয়েছেন এই তিন তারকা।

রবিবার তাঁদের প্রমাণ করার দিন যে, তাঁরা শুধুমাত্র সম্প্রচারকারী চ্যানেলের ‘চলতা-ফিরতা’ বিপণনের উপাদান বা ওভারের বিরতিতে বিজ্ঞাপনের ‘মডেল’ নন।

Advertisement
আরও পড়ুন