লুলুং। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
শীত ভ্রমণ কি সব সময় পরিকল্পনা মাফিক হয়? হুট বললেই বেড়িয়ে পড়া যায় এমন ঠিকানাও তো লাগে! সঙ্গে গাড়ি থাকলে ভাল, না থাকলে ভরসা ট্রেন-বাস, টোটোই। ছুটি অল্প? তা হলে যাবেন কোথায়, যেখান থেকে একরাশ ভাললাগাকে সঙ্গী করে ফিরতে পারেন?
লুলুং: নামটি ভারি সুন্দর লাগছে না? লুলুং-পলপলা নদী বয়ে গিয়েছে অরণ্যের ভিতর দিয়ে। লাল পাথুরে মাটি আর চারপাশে বুনো গন্ধ। ছোট ছোট পাহাড় জায়গাটির শোভা বাড়িয়েছে। শীতের হাওয়ায় যখন গাছের পাতা একটা একটা করে ঝরে পড়ে— সেই দৃশ্যও মন ভাল করে দেয়। পলপলা নদীতে মাঝেমধ্যেই জল খেতে আসে বুনো জন্তুর দল।
ভাবছেন, এমন জায়গা কোথায়? ওড়িশার সিমলিপাল জাতীয় উদ্যান সংলগ্ন স্থান এই লুলুং। জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করতে হলে অনুমতির দরকার হয়, তবে লুলুং পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষেত্রে তেমন নিয়ম নেই। অরণ্য হলে কী হবে, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত রিসর্টও তৈরি হয়ে গিয়েছে এখানে।
লুলুং যেন চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি। এখান থেকেই ঘুরে নিতে পারবেন সীতাকুণ্ড, উস্কি ফলস, চাউলভাজা ওয়াটার ফলস, আলকাদুর-সহ ছোটখাটো অসংখ্য গন্তব্য। শীতের দিনে ঝরনা, ঝোরায় জল কম থাকলেও, আশপাশের পরিবেশ মন ভরিয়ে দেবে। তবে লুলুং গেলে সিমলিপাল জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের অনুমতিও নিয়ে নিন। ঘুরে নেওয়া যায় বরহিপানি এবং জোরান্ডা জলপ্রপাত। নিজেদের গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করতে হলে গাড়ির ‘গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স’ থাকা জরুরি।
লুলুং আসতে গেলে প্রবেশ করতে হবে পীথাবাটা গেট দিয়ে। তবে সিমলিপালের অরণ্য ঘোরা যায় কালিয়ানি প্রবেশদ্বার দিয়েও।
কোথায় থাকবেন?
লুলুং-এ বিভিন্ন মানের গেস্ট হাউস, রিসর্ট রয়েছে। সিমলিপালে বনবিভাগের থাকার জায়গাও আছে।
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে লুলুংয়ের দূরত্ব ২৪৪ কিলোমিটার। খানিক বিরতি নিয়ে এলেও ৬ থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন। সবচেয়ে ভাল হয় রাতে গাড়িতে যাত্রা করলে, ভোর ভোর পৌঁছবেন। আবার ট্রেনে বারিপদা বা বালেশ্বরে নেমেও গাড়ি ভাড়া করে বাকি পথটুকু চলে আসতে পারবেন। হাত ২-৩ দিন ছুটি থাকলেই বেশ ঘোরা যাবে।
কৈখালি: সাগর অভিসারী মাতলা, ম্যানগ্রোভের বন, আর গ্রামীণ প্রকৃতির অকৃত্রিম রূপ। এই সব কিছুর টানে বেড়িয়ে পড়ুন কৈখালির উদ্দেশ্যে।
উচ্ছল মাতলা, শান্ত নিমানিয়ার সঙ্গমস্থল। বাদাবন, বিস্তৃত জলরাশি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে এমন এক জায়গা যে কলকাতার অদূরে থাকতে পারে, বোঝাই দায়। সময়ের হিসাবে স্থানটির দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে জয়নগর-মজিলপুর ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট। তার পর সেখান থেকে নিমপীঠ ছুঁয়ে অটোয় একটানা কৈখালি চলে গেলে গেলে কমবেশি ঘণ্টা দেড়েক লাগবে।
থাকতে চাইলে অবশ্য আগে থেকে বন্দোবস্ত করে যাওয়া ভাল। মাতলার ধারেই যুবআবাস। থাকা-খাওয়ার সব ব্যবস্থাই সেখানে। চাইলে থেকে যেতে পাড়েন ঝড়খালিতেও। আগাম তেমন পরকিল্পনার দরকার হবে না।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৈখালিতে মাতলা পার হলেই ঝড়খালি। সেখানেই ব্যাঘ্র পুনর্বাসন কেন্দ্র। বরাত ভাল হলে, সেখানে গিয়ে রয়্যাল বেঙ্গলের হুঙ্কার শুনতে পাবেন।
তবে কৈখালি যাওয়ার আগে ছুঁয়ে যেতে পারেন নিমপীঠ রামকৃষ্ণ আশ্রম। আশ্রমে পা দিলেই মন শান্ত হয়ে যায়। পরিচ্ছন্ন চত্বর, যত্নে লাগানো গাছ। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলে মার্বেলের মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তি। স্বামী বিবেকানন্দ, সারদাদেবীর ছবি। মন্দিরের গঠনশৈলীতে বেলুড় মঠের সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়।
কৈখালি যাওয়ার সময় নিমপীঠ হয়ে যাওয়ার আর একটি কারণ রয়েছে। কৈখালিতে যে পর্যটক আবাস বা যুব আবাস রয়েছে, সেটি নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত। আগাম বুকিং করা হলেও, এখানে এসে এক বার মহারাজের সঙ্গে কথা বলে যেতে হয়। সেই সঙ্গে আবাসে আসা অতিথিরা মধ্যাহ্নভোজন সারেন প্রসাদ খেয়ে। এক-দুই পদ নয়। এখানে অতিথি আপ্যায়নে কার্যত পঞ্চব্যাঞ্জন সাজিয়ে দেওয়া হয়।
কৈখালি। —ফাইল চিত্র।
বালিচুয়া-চিটিপাহাড়: এক সময় মাওবাদী কার্যকলাপে ত্রস্ত বেলপাহাড়িতে এখন পর্যটনের প্রসার হয়েছে। যে বেলপাহাড়ির নাম শুলনেই লোকে কাঁপতেন, সেখানেই এখন ঝাঁ-চকচকে রিসর্ট। শীতের দিনে আগাম বুকিং ছাড়া গেলে থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হতে পারে, অবস্থা এখন এমনই। সেই ভিড় এড়িয়ে একটু অন্য ভাবে ঘুরতে চাইলে বরং চলুন বালিচুয়া। ঘুরে নিন চিটিপাহাড়। বেলপাহাড়ি থেকে দূরত্ব খুব বেশি নয়। তবে বালিচুয়া এখনও পর্যটক মহলে তেমন জনপ্রিয় হয়নি।
পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ২ নম্বর ব্লকের ছোট্ট গ্রাম বালিচুয়া। ঢেউখেলানো টিলা যেন গ্রামকে বেড় দিয়ে রেখেছে। ঢালাই সড়কের দু’পাশে ক্ষেত। জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসা গ্রামের পুরনো ছবি আবার ফিরিয়ে দেবে বালিচুয়া। থাকার জায়গা বলতে একটি হোম স্টে রয়েছে এখানে।
বালিচুয়া থেকে খানিক হাঁটাপথ পাড়ি দিলে পৌঁছে যাবেন চিটিপাহাড়। ছোট্ট টিলা, ভারি মনোরম চারপাশ। সেই টিলায় ওঠার পথ খুঁজে বার করতে পারলে, চলুন তার মাথায়। বিশেষত বিকেল বিকেল এলে পড়ন্ত সূর্যালোকে গ্রামের দৃশ্য মন ভাল করে দেবে।
বালিচুয়ার পরিবেশ এতটাই সুন্দর, পায়ে হেঁটে গ্রাম ঘুরেই একটি দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। হাতে সময় থাকলে ঝাড়গ্রাম বা বেলপাহাড়ি, দুই দিকেই যেতে পারেন।
বেলপাহাড়ি থেকে ঘুরে নিতে পারেন বেশ কয়েকটি স্থান।
চিটি পাহাড়। —নিজস্ব চিত্র।
গাড়রাসিনী পাহাড়: জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়। উঠে গিয়েছে পাথুরে রাস্তা। গাছপালা ঘেরা সেই পথে উঠলে প্রথমেই পড়বে বাসুদেব মন্দির। তার পাশ দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে চারপাশের রূপ।
ঢাঙ্গিকুসুম : পাথরের উপর দিয়ে কুলু কুলু শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। তবে বর্ষায় এখানে না এলে উপভোগ্য মনে হবে না।
ঘাঘরা জলপ্রপাত: জলপ্রবাহ এখানে গিরিখাতের সৃষ্টি করেছে। জলের তোড়ে পাথরের বিভিন্ন জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে। তার মধ্যেই জল জমে থাকে। এখানকার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভিন্ন রকম।
তারাফেনি জলাধার: ঘাঘরার কাছেই রয়েছে তারাফেনি জলাধার। সবুজের মাঝে টলটলে জলের এই জলাধার দেখতে বেশ লাগে।
এ ছাড়াও চাতন পাহাড়, খেঁদারানি জলাধার, তালবেড়িয়া, ড্যাম, সুতানের জঙ্গল দেখা যায়। এত জায়গা ঘুরতে হলে ৩ দিনেক সময় রাখতেই হবে। তবে দু'দিনে বালিচুয়া, চিটিপাহাড় ঘুরে আসা সম্ভব।
কোথায় থাকবেন
বালিচুয়ায় হোম স্টে রয়েছে। এ ছাড়া বেলপাহাড়ি, ঝিলিমিলিতে থাকার অনেক জায়গাই মিলবে।
কী ভাবে যাবেন?
ধর্মতলা থেকে সরাসরি বেলপাহাড়ির বাস পাওয়া যায়। হাওড়া থেকে ট্রেনে গেলে ঝাড়গ্রাম বা চাকুলিয়া স্টেশনে নামতে হবে। ঝাড়গ্রাম থেকে বালিচুয়া যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। চাকুলিয়ায় নামলে অটো রিজার্ভ করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। পুরো পথটা কলকাতা বা যে কোনও স্থান থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতেও যেতে পারেন। গাড়ির রাস্তা ভালই।