CAA Camp

‘নথি না-থাকলেও সমস্যা হবে না’! সিএএ প্রক্রিয়ার নয়া ব্যাখ্যা সামনে আনল বিজেপি, আবেদন জমা নিতে সহযোগিতা শিবিরও

এই উদ্যোগ এত দিন পরে কেন? নাগরিকত্ব প্রশ্নে মতুয়াদেরও হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে দেখেই কি বিজেপি-র টনক নড়ল? না কি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বাজিয়ে দিয়ে মমতা যে ভাবে ‘বাঙালি অস্মিতা’র ধ্বজা উড়িয়েছেন, তা দেখেই তড়িঘড়ি পাল্টা ‘সিএএ তাস’ তুলে ধরার চেষ্টা শুরু হল?

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫৭
BJP starts CAA Camps to help out applicants, Lack of documents will also not be hindrance, New claim surfaces

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ভিন্‌রাজ্যে বাংলাভাষীদের হেনস্থার অভিযোগ তুলে ক্রমশ সুর চড়াচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাল্টা ভাষ্য তুলে বিজেপি বলছে, ধরপাকড়ের মুখে যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা কেউ ভারতীয় নন, তাঁরা বাংলাদেশি অথবা রোহিঙ্গা। কিন্তু মমতা বা তৃণমূল শুধু ভাষ্যে আটকে নেই। বাঙালি অস্মিতার প্রশ্নে জনমত তৈরিতে শাসক শিবির লাগাতার পথে নামতে শুরু করেছে। তাই বিজেপি-কেও নামতে হয়েছে পাল্টা জনসংযোগে। মিছিল বা জনসভা করে নয়, উদ্বাস্তুপ্রধান এলাকায় ‘সিএএ সহযোগিতা শিবির’ খুলে নাগরিকত্বের আবেদনপত্র জমা করানো শুরু করেছে বিজেপি। সিএএ বিধির কয়েকটি দিক বার বার প্রচারে এনে উদ্বাস্তু এলাকায় ‘আতঙ্ক’ কাটানোর প্রচেষ্টাও শুরু করেছে তারা।

Advertisement

সিএএ (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন) কার্যকর হওয়ার পর থেকেই মতুয়া মহাসঙ্ঘ উত্তর ২৪ পরগনা এবং নদিয়ার উদ্বাস্তু এলাকায় আবেদনপত্র জমা নেওয়া শুরু করেছিল। ‘অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসঙ্ঘ’-এর সঙ্ঘাধিপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর তখনই ঘোষণা করেছিলেন, উদ্বাস্তুদের ‘হিন্দু’ পরিচয় নিশ্চিত করতে মতুয়া মহাসঙ্ঘের তরফে শংসাপত্র দেওয়া হবে। যাঁরা নিজেরা আবেদন জমা দিতে অক্ষম, তাঁদের হয়ে ফর্ম পূরণও মতুয়া মহাসঙ্ঘই করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। রবিবারই ঠাকুরনগরে আয়োজিত ‘মতুয়া ছাত্র-যুব সম্মেলনে’ শান্তনু ঘোষণা করেছেন, সংগঠনের তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আয়োজন হচ্ছে, যাতে তাঁরা সিএএ আবেদনকারীদের সাহায্য করতে পারেন। এতদিন ওই কাজ কখনও দ্রুত, কখনও ঢিমেতালে চলছিল। এ বার সে কাজে বিজেপি-ও সরাসরি ময়দানে নেমে পড়ল। শুধু আবেদনপত্র পূরণ করানোই নয়, আনুষঙ্গিক নথি জোগাড়ের কাজেও সক্রিয় ভাবে মাঠে নামানো হল বিজেপি কর্মীদের।

রাজ্যে মতুয়া জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা বিধানসভা কেন্দ্রে। সেখানেই সর্বাগ্রে ‘সিএএ সহযোগিতা শিবির’ খোলা হয়েছে। রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) অমিতাভ চক্রবর্তীর পূর্বতন আপ্ত সহায়ক গোপাল গয়ালির উদ্যোগে বাগদায় ওই শিবির শুরু হয়েছে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোপালেরই ভাই তথা বাগদা পঞ্চায়েত সমিতির বিরোধী দলনেতা সৌরভ গয়ালি। কিন্তু এই উদ্যোগ এত দিন পরে কেন? নাগরিকত্ব প্রশ্নে মতুয়াদেরও হেনস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে দেখেই কি বিজেপি-র টনক নড়ল? না কি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বাজিয়ে দিয়ে মমতা যে ভাবে ‘বাঙালি অস্মিতা’র ধ্বজা উড়িয়েছেন, তা দেখেই তড়িঘড়ি পাল্টা ‘সিএএ তাস’ তুলে ধরার চেষ্টা শুরু হল?

রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য একে ‘তাস’ বলে মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, ‘‘সিএএ আমরা এনেছি। বাস্তবায়নের দায়িত্বও আমাদের। বিজেপি কর্মীরা সর্বত্রই এই কাজে উদ্বাস্তু সমাজকে সহযোগিতা করবেন।’’

সিএএ পাশ হয়েছিল ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। সেই মাসেই আইনটিকে ‘কার্যকর’ বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তখনও আইনটির আওতায় নির্দিষ্ট বিধি তৈরি হয়নি। ২০২৪ সালে সেই বিধি তৈরির কাজ শেষ হয়। তার পরেই অনেকে সিএএর আওতায় নাগরিকত্বের আবেদন জমা দেওয়া শুরু করেন। আবার অনেকেই জমা দেনওনি। কিন্তু সম্প্রতি নাগরিকত্ব প্রশ্নে দেশজোড়া যে ধরপাকড় শুরু হয়েছে, উদ্বাস্তু এলাকায় তার প্রভাব পড়েছে। পরিস্থিতি আঁচ করে বিজেপি আসরে নেমে পড়েছে আবেদনকারীদের ‘সহযোগিতা’ করতে।

বাগদা শুধু নয়, বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রেও এক দিনের জন্য ওই সহযোগিতা শিবির আয়োজিত হয়েছিল। সেখানে আবার শিবির বসানোর তোড়জোড় চলছে। ঠাকুরবাড়ি সূত্রের দাবি, মতুয়া মহাসঙ্ঘের সদর ঠাকুরনগরে কাজের গতি সম্প্রতি বেড়েছে। হরিণঘাটা এলাকাতেও মতুয়া মহাসঙ্ঘের তরফে ‘সিএএ সহযোগিতা শিবির’ করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু প্রধান এলাকাতেও শীঘ্রই ওই শিবির চালু করা হবে বলে বিজেপি সূত্রের দাবি।

ওই সব ‘সহযোগিতা শিবির’ বা ‘কর্মী প্রশিক্ষণ শিবিরে’ নাগরিকত্ব সংক্রান্ত আইনটির কয়েকটি দিক জোর দিয়ে তুলে ধরার কাজও হচ্ছে। সিএএ যে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, কেড়ে নেওয়ার নয়, সে তত্ত্ব বিজেপি ২০১৯ সাল থেকেই লাগাতার বলছে। কিন্তু তৃণমূল-সহ বিভিন্ন এনডিএ-বহির্ভূত দলের লাগাতার প্রচারে উদ্বাস্তুদের একাংশে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, বিজেপি-র ওই তত্ত্ব তাকে পুরোপুরি কাটাতে পারেনি। বিজেপি-র তরফে এ বার তাই আইনের আরও কয়েকটি অংশ তুলে ধরে প্রচার চালানো হচ্ছে। বাগদার বিজেপি নেতা গোপালের কথায়, ‘‘সিএএ আবেদনপত্রের সঙ্গে যে ছ’টি নথি জমা দিতে হচ্ছে, তার একটিও যদি কারও কাছে না থাকে, তা হলেও আবেদন জমা নেওয়া হবে। পরে জেলা স্তরের কমিটির সামনে শুনানির সময় নথি জমা দিলেও চলবে।’’ যদি কেউ তখনও নথি জোগাড় করতে না পারেন, তা হলেও তাঁকে দফায় দফায় আবার সময় দেওয়া হবে। বিজেপির তরফে যাঁরা শিবির চালাচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্য, সিএএ আইনের ১০-ডি অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে যাঁরা (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, খ্রিস্টান) ভারতে এসেছেন, নথি না থাকার অজুহাতে তাঁদের কাউকে দেশ থেকে তাড়ানো যাবে না। ২০১৫ সালেই সরকারি বিজ্ঞপ্তি (জিএসআর ৬৮৫, ৬৮৬-২০১৫) জারি করে নরেন্দ্র মোদীর সরকার সে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে যাঁরা ভারতে এসেছেন এবং নাগরিকত্বের আবেদন জমা দিয়েছেন, তাঁদের ‘আশ্রয়প্রার্থী’ হিসেবে ধরা হবে বলে সেই বিজ্ঞপ্তিতেই স্পষ্ট করা হয়েছিল। ফলে নির্দিষ্ট সময় ভারতে কাটানোর পরে তাঁরা এমনিতেই (ন্যাচরালাইজ়েশন) ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। যে দিন ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, সেই দিন থেকে তাঁদের নাগরিকত্ব কার্যকর বলে ধরা হবে।

সিএএ বিধির এই সব অংশকে বেশি করে তুলে ধরে উদ্বাস্তু সমাজের ‘আতঙ্ক’ দূর করার চেষ্টা করছে বিজেপি। পাশাপাশিই চলছে তৃণমূলের ‘পাল্টা ভাষ্য’ নির্মাণ।

Advertisement
আরও পড়ুন