West Bengal SIR Hearing

কোলে করে শুনানিতে ৯১ বছরও

বাঁকুড়ার জয়পুরের ৯১ বছরের বৃদ্ধা আশালতা আচার্যকে কোলে করে শুনানির ঘরে নিয়ে যান নাতি সুব্রত আচার্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২৩
শুনানিতে কালনার গীতারানি দাস। ছবি: জাভেদ আরাফিন মণ্ডল

শুনানিতে কালনার গীতারানি দাস। ছবি: জাভেদ আরাফিন মণ্ডল

স্বজনের সাহায্য বা লাঠি। ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের শুনানি-পর্বে হাজিরা দিতে ভরসা সেটুকুই। শুনানিতে যাওয়া অতি প্রবীণ, অসুস্থ, অন্তঃসত্ত্বা, বিশেষ ভাবে সক্ষমদের কেন হয়রান হতে হবে— সোমবার দিনভর সেই ক্ষোভের আঁচ মিলেছে রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে। এ দিন সন্ধ্যায় ৮৫ বছরের ঊর্ধ্বে, অসুস্থ বা বিশেষ ভাবে সক্ষমদের বাড়িতে গিয়ে শুনানির বিষয়টি নিয়ে আদেশনামা প্রকাশ করে কমিশন। তার আগে ভোগান্তি নিয়ে বিজেপি-বিরোধী সব পক্ষই অবশ্য মুখ খুলেছে।

বাঁকুড়ার জয়পুরের ৯১ বছরের বৃদ্ধা আশালতা আচার্যকে কোলে করে শুনানির ঘরে নিয়ে যান নাতি সুব্রত আচার্য। সুব্রত বলেন, “হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার টোটোয় চড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন ঠাকুমা।” বছর নব্বইয়ের মুক্তিবালা প্রামাণিক ও তাঁর মেয়ে, বছর পঁয়ষট্টির যশোদা হাজরা, দু’জনই হাঁটতে পারেন না। মোটরভ্যানে তাঁদের পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া ১ ব্লক অফিসে শুনানিতে হাজির করেন পরিজন। যশোদার ক্ষোভ, “ভোটার তালিকায় নাম রাখার জন্য এই শীতের মধ্যে আমাদের এ ভাবে হাজির হতে হবে কেন?”

বহরমপুরের ২ নম্বর বানজেটিয়ার ৯২ বছর বয়সি নমিতা দাসকে কোলে করে বহরমপুরে ব্লক অফিসে শুনানিতে হাজির করান তাঁর ছেলে-মেয়ে। বৃদ্ধার মেয়ে ইলা দাসের আক্ষেপ, “প্রশাসন বাড়িতে শুনানির ব্যবস্থা করলে মাকে এ কষ্ট করতে হত না।” মালদহের মনস্কামনাপল্লির বাসিন্দা নব্বই ছুঁইছুঁই ঝর্না দাস আর পক্ষাঘাতজনিত সমস্যায় আক্রান্ত তাঁর মেয়ে অঞ্জনা দাসকে মালদহ জেলা স্কুলের শুনানিকেন্দ্রে ডাকা হয়েছিল। মা আর বোনকে কোনও মতে সেখানে নিয়ে যান খোকন দাস। মহকুমাশাসকের (শিলিগুড়ি) দফতরের তিন তলায় শুনানিকেন্দ্রে যাওয়া শিলিগুড়ির ফুলেশ্বরীর কল্পনা পাল, দেশবন্ধুপাড়ার জ্যোৎস্না সরকার বলেন, “হাঁটুর সমস্যায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারছি না। এরা কি আমাদের মানুষ ভাবে না!” বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লক অফিসে ক্যাথিটার লাগানো অবস্থায় গাড়িতে হাজির হন ৮৭ বছরের ভাগবত বরাট। গাড়ি থেকে নামতে পারেননি। ব্লক অফিসের কর্মীরা গাড়িতেই সই সংগ্রহ করেন।

বীরভূমের সিউড়ি ১ ব্লকের রহিম শা টোটোয় ব্লক অফিস চত্বরে পৌঁছে নামতে পারেননি টোটো থেকে। বাড়ির লোকেরা জানান, ২০ ডিসেম্বর থেকে সিউড়ি সদর হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ভর্তি ছিলেন রহিম। ২৩ ডিসেম্বর মেলা শুনানির নোটিসে বলা হয়, সিউড়ি ১ ব্লকে হাজিরা দিতে আসতে হবে। রবিবার হাসপাতাল থেকে ঝুঁকি নিয়ে ছুটি করিয়ে রহিমকে শুনানিতে আনা হয়। কালনা শহরের ৯০ বছরের গীতারানি দাস কয়েক দিন আগে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় এ দিন পরিজনের কাঁধে ভর দিয়ে তিনিও শুনানিতে হাজির হন।

উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট ২ ব্লকের নদিয়া গ্রাম থেকে আসা অন্তঃসত্ত্বা সুপ্রিয়া মণ্ডল শুনানিকেন্দ্রে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে অসুস্থ হন। মা মুক্তি মণ্ডল বলেন, “ছ’ঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়ে থেকে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটা অসুস্থ হয়েছে।” পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে শুনানিতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়া এক মহিলাকে নিয়ে যেতে হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নদিয়ার চাকদহেও শুনানিতে আসা এক প্রবীণ অসুস্থ হন। বছর বাহাত্তরের বাবাকে নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল ব্লক অফিসে এসেছিলেন বিমল পাল।

বললেন, “৬০ বছরের পর থেকেই প্রবীণদের জন্য নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা আছে। অথচ, ৮৫ বছর বয়স না হলে কমিশনে বাড়িতে গিয়ে শুনানি করবে না। যাঁরা অশক্ত, অসুস্থ তাঁদের জন্য ৮৫-র নীচেও বিশেষ ব্যবস্থা হলে ভাল হত।”

তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন সমাজমাধ্যমে ষাটোর্ধ্বদের শুনানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন।

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর মতে, “বাড়িতে প্রবীণ নাগরিকদের শুনানির ব্যবস্থা করতে কিসের অসুবিধা?” প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি শুভঙ্কর সরকার বলেছেন, “যাঁরা অসুস্থ, বয়স্ক, তাঁদের কাছে মোবাইল ভ্যান, আধিকারিকদের পৌঁছনো জরুরি।” এসইউসিআই (কমিউনিস্ট)-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক চণ্ডীদাস ভট্টাচার্যর বক্তব্য, “শুনানির নামে সাধারণ মানুষের হয়রানি অত্যাচারের পর্যায়ে পৌঁছেছে।”

তবে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “কোথাও ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সেটা দেখার জন্য নির্বাচন কমিশন আছে। এ রাজ্যে তৃণমূলের মতো আমরা নির্বাচন কমিশনকে পরিচালনা করি না। যদি কারও কিছু বলার থাকে, তার জন্য সুপ্রিম কোর্টের দরজাখোলা আছে।”

আরও পড়ুন