মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে অমিত শাহের মন্তব্যে কি ভোট এগিয়ে আসার আভাস? ছবি: পিটিআই।
চলতি সরকারের মেয়াদ ফুরনোর কিছুটা আগেই কি এ বার মিটে যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন এবং সরকার গঠনের প্রক্রিয়া? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির অন্যতম সর্বোচ্চ নেতা অমিত শাহের মন্তব্যে তেমনই ইঙ্গিত পাচ্ছে রাজ্য বিজেপি। মঙ্গলবার কলকাতায় শাহ বারদুয়েক বলেছেন, এপ্রিলেই মিটে যাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোট। শুধু ভোট মিটে যাওয়াই নয়, আগামী এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নতুন সরকার গঠনও সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
শাহের ওই মন্তব্যের পরে ভোটের দিনক্ষণ এবং দফা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অন্দরে। রাজ্য বিজেপির কর্মীদের শাহ আগাম ভোটের জন্য তৈরি হওয়ার বার্তা দিতে চেয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে মঙ্গলবার শাহ সাংবাদিক বৈঠক করেন। সেখানে নিজের কথা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি বলেন, ‘‘এপ্রিলে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হতে চলেছে। ভয়, দুর্নীতি, অপশাসন আর অনুপ্রবেশের বদলে পরম্পরা, উন্নয়ন আর গরিব কল্যাণের মজবুত সরকার গঠনের জন্য বাংলার মানুষের সংকল্প সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি।’’ এই মন্তব্যের অব্যবহিত পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী নির্ঘণ্টের আভাস দেন। তিনি বলেন, ‘‘২০২৬ সালের ১৫ এপ্রিলের পরে যখন বিজেপি সরকার হবে, তখন বঙ্গগৌরব, বঙ্গসংস্কৃতির পুনর্জাগরণের শুরু হবে। স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমবাবু, গুরুদেব আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্নের বাংলা বানানোর চেষ্টা করব।’’
এত দিন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, মে মাসের ৪ তারিখে চলতি মন্ত্রিসভার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এসআইআর প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের বাধার অভিযোগ প্রসঙ্গেই শুভেন্দু ওই কথা বলছিলেন। তিনি দাবি করছিলেন, এসআইআর প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হলে ভোটার তালিকা তৈরি আটকে থাকবে। ভোটার তালিকা তৈরি না-হলে ভোট পিছিয়ে যাবে। ২০২৬ সালের ৪ মে-র মধ্যে ভোট করানো না-গেলে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হবে। কিন্তু মঙ্গলবার শাহের কথায় ইঙ্গিত মিলল, ভোট পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং এ বার ভোট আগেভাগে মিটে যেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, ভোটগ্রহণের দফাও কমতে পারে। কারণ, এপ্রিল মাসে ভোট হলে এবং ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ভোটগ্রহণ, গণনা, ফলপ্রকাশ মিটিয়ে সরকার গঠনের কাজও হয়ে গেলে এক বা দুই দফাতেই ভোটগ্রহণ সেরে ফেলতে হবে। সে ক্ষেত্রে আগের নির্বাচনগুলির মতো ছয়, সাত বা আট দফায় ভোটগ্রহণ না-হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ, অতগুলি দফায় ভোট নেওয়া হলে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে নতুন সরকার গঠন করা কঠিন।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোটগ্রহণ হয়েছিল আট দফায়। ২৭ মার্চ ছিল ভোটগ্রহণের প্রথম তারিখ। ২৯ এপ্রিল ছিল অষ্টম তথা শেষ দফার ভোটগ্রহণ। ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোট নেওয়া হয়েছিল সাত দফায়। ২০১৯ সালে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয়েছিল ১১ এপ্রিল তারিখে আর সপ্তম দফা ১৯ মে। ২০২৪ সালে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ হয়েছিল ১৯ এপ্রিল তারিখে এবং সপ্তম দফা ১ জুন। যদিও লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের নির্ঘণ্টের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সরকার গঠনের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু গত দেড় দশকে লোকসভা হোক বা বিধানসভা, পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও নির্বাচনই এপ্রিল-মে মাস জুড়ে চলেছে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শেষ দফার ভোট হয়েছিল ৫ মে তারিখে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শেষ দফার ভোট হয়েছিল ১০ মে তারিখে। গণনা তথা ফলপ্রকাশ হয়েছিল ১৩ মে।
২০২৬ সালে ১৫ এপ্রিলের পরে পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে বলে যে মন্তব্য শাহ করেছেন, তা ‘কথার কথা’ না-হলে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা যে অন্যান্য বছরের চেয়ে আগেই হয়ে যাবে, তা বলা বাহুল্য। এসআইআর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হবে। তার আগে ভোট ঘোষিত হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি সরকার গঠনের প্রক্রিয়া সেরে ফেলতে হলে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে ভোট ঘোষণায় বেশি দেরি করতে পারবে না নির্বাচন কমিশন। খুব দেরি করলেও মার্চের শুরুর দিকেই দিনক্ষণ ঘোষণা করতে হবে। এবং অন্যান্য বছরের চেয়ে কম দফায় ভোটগ্রহণ করতে হবে। তবে সে সব নিয়ে কোনও সবিস্তার মন্তব্য শাহ করেননি। ভোট এগনো বা দফার সংখ্যা কমে যাওয়া সংক্রান্ত বিষয়টি এখনও বিজেপি নেতাদের মধ্যে চলতে থাকা জল্পনার স্তরেই রয়েছে।
এসআইআর প্রক্রিয়া নিয়ে মতুয়া সমাজের কোনও দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলেও শাহ মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠক থেকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। আনন্দবাজার ডট কমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মতুয়াদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যে শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক। এটা বিজেপির প্রতিশ্রুতি। তাঁদের কেউ ক্ষতি করতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পারবেন না।’’ মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরকে পাশে নিয়েও শাহ এই আশ্বাসবাণী শোনান। বিজেপি সূত্রের খবর, এ বিষয়ে শান্তনুর সঙ্গে শাহ আলাদা করেও কথা বলেছেন। এসআইআর প্রক্রিয়ায় যে মতুয়াদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় রাখার জন্য কোনও পন্থার কথা ভাবা হচ্ছে বলে শান্তনুকে শাহ আশ্বস্ত করেছেন বলে বিজেপির একটি সূত্রের দাবি।