যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মেসির অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা। মাঠে পড়ে থাকা এই জলের বোতলই ছুড়েছিলেন ক্ষুব্ধ দর্শকেরা। — ফাইল চিত্র।
কতটা গুরুত্ব দিয়ে করা হয়েছিল সমন্বয় বৈঠক? সাত বছর ধরে নিষিদ্ধ থাকা জলের বোতল কী ভাবে নীরবে ফিরে এল পাউচের বদলে?
গত শনিবার বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে লিয়োনেল মেসির অনুষ্ঠান ঘিরে চরম বিশৃঙ্খলা ও ভাঙচুরের ঘটনার পরে এই প্রশ্নই উঠে আসছে। বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, মেসির মতো এক জন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল তারকার নাম যখন অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে, তখন উদ্যোক্তা, পুলিশ ও ক্রীড়া দফতর-সহ সব পক্ষের একত্রে বৈঠক করে সামগ্রিক অনুষ্ঠানের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে ফেলার কথা। সেই বৈঠকেই স্পষ্ট হওয়ার কথা ছিল, স্টেডিয়ামের ভিতরে জলের বোতল বিক্রির বিষয়টি। মেসিকে ভাল করে দেখতে না পাওয়ার ক্ষোভে ২০ টাকার বদলে ২০০ টাকায় কেনা সেই জলের বোতলই মাঠে ছুড়ে মারেন দর্শকেরা।
যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের ভিতরে বিশৃঙ্খলা এড়াতেই জলের বোতল নিষিদ্ধ হয়েছিল সেই ২০১৭ সালে, অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের সময়ে। প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, যুবভারতীতে বড় দলের খেলা কিংবা বড় ফুটবল ম্যাচ থাকলে অ্যাডভান্স সিকিয়োরিটি লিয়াজ়ঁ মিটিং (এএসএল) নামে একটি সমন্বয় বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে খেলার উদ্যোক্তা, পুলিশ, ক্রীড়া দফতর, যুবভারতী কর্তৃপক্ষ-সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রতিনিধিরা হাজির থাকেন। খেলার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয় সেই বৈঠকে আলোচিত হয়। এক প্রকার খেলা পরিচালনার নকশা তৈরি হয় এএসএল বৈঠকে। তাই এক দিকে মেসি, অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, শাহরুখ খানের মতো ব্যক্তিত্বদের নাম যে শো-এর সঙ্গে জড়িত, সেখানে এএসএল হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
অতীতে যুবভারতীতে বড় খেলার দায়িত্বে থাকা, বর্তমানে প্রাক্তন এক পুলিশ আধিকারিক মনে করেন, স্টেডিয়ামে যে জলের বোতল ঢুকবে, সেটা পুলিশের অজানা থাকার কথা নয়। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের পর থেকে স্টেডিয়ামে যে কোনও খেলায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের তরফে জলের পাউচ দেওয়া হয়। কিন্তু মেসির আসার দিনে জলের বোতল বিক্রি হল। এএসএল যদি ঠিক মতো হয়ে থাকে, তবে পাউচের বদলে জলের বোতল এল, এই বড় পরিবর্তন প্রশাসনের অগোচরে থাকার কথা নয়।’’ তা হলে কি পাউচ থেকে বোতলের পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হয়নি? উঠছে প্রশ্ন।
কলকাতা তথা রাজ্যের নাম ডোবানো একটি ঘটনার তদন্তে এ পর্যন্ত সরকারি পদক্ষেপ বলতে উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত-সহ সাত জনের গ্রেফতারি, বিধাননগরের উপ-নগরপাল অনীশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত-সহ তাঁকে নিলম্বিত করা, বিধাননগরের নগরপাল শ্রী মুকেশ, রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারের কাছে কৈফিয়ত তলব এবং ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে সাময়িক ভাবে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া। মেসির অনুষ্ঠানের আগের দিন উপ-নগরপাল অনীশ সরকার দর্শকদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়েছিলেন, স্টেডিয়ামে পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা থাকবে। কাউকে জলের বোতল নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মেসির মতো এক জন খেলোয়াড়ের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে হওয়া অনুষ্ঠানের এএসএল বৈঠক বিধাননগর পুলিশের সর্বস্তরের কর্তাদের উপস্থিতিতে হওয়ার কথা। তাই সেখানে পাউচের বদলে জলের বোতল— এই পরিবর্তন নিয়ে যদি আলোচনা হয়ে থাকে, তবে তাতে সিলমোহর দিয়েছে কমিশনারেটের শীর্ষ মহল। প্রশ্ন হল, জল পাউচে না কি বোতলে পাওয়া যাবে, তা না জেনেই কি বিধাননগরের কমিশনারেটের দ্বিতীয় সারির পদমর্যাদার এক কর্তা পর্যাপ্ত জলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? যার পরিণতি, স্টেডিয়ামের ভিতরে পানীয় জল আর খাবারের অবাধ কালোবাজারি! ২০ টাকার জলের বোতল ২০০ টাকায় বিক্রির ছাড়পত্র দেওয়া!
উত্তর মেলেনি বিধাননগর কমিশনারেটের থেকে। ‘তদন্ত চলছে’, এই বর্মের আড়ালে গিয়ে মেসি-কাণ্ড নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে কমিশনারেট। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, এএসএল বৈঠকেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা, মাঠে কত জন দর্শককে প্রবেশাধিকার দেবে পুলিশ। মেসি কিংবা মুখ্যমন্ত্রী যেখানে থাকবেন, সেখানে তাঁদের নিরাপত্তার কারণেই খুব বেশি দর্শকের প্রবেশ করার কথা ছিল না।
সূত্রের খবর, বিধাননগরের এক দাপুটে নেতাকে দু’দফায় পুলিশ মাঠে ঢোকার টানেল থেকে তাঁর নির্ধারিত জায়গায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার পরে কী ঘটল? পুলিশ কি অন্য ভাবে প্রভাবিত হল? রহস্য রয়ে যাচ্ছে।