Mithun Chakraborty’s Politics Fiasco

‘রিটেক’ নেই, চিত্রনাট্য অজানা, রাজনীতির মাঠের ‘জলকাদায়’ বারবার নাজেহাল মিঠুন! তৃতীয় ইনিংসেও গ্রাস করছে বিরক্তি

তবে রাজনীতির তৃতীয় ইনিংসে অভিনেতা মিঠুনের কিছু ‘প্রাপ্তি’ তো হয়েইছে। ২০২৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পেয়েছেন। সেই বছরেই পেয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’। ‘বড় অভিনেতা’ হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘বড় নেতা’ হিসাবে?

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৯
No ‘Retake’ to correct ‘NG Scenes’, Is Bollywood Superstar Mithun Chakraborty facing rough weather in political ground once again

মিঠুন চক্রবর্তী। —ফাইল চিত্র।

এখনও পর্যন্ত ৩৮০টি ছবি করেছেন। তাই কে অভিনয় করছেন আর কে ঠিক বলছেন, তা তিনি বুঝতে পারেন। বলেছেন মিঠুন চক্রবর্তী। বলেছেন নেতার ভূমিকা পালন করতে গিয়ে। ঈষৎ ‘বিরক্তি’ নিয়ে। বিজেপি নেতা-কর্মীদের ধারণা তেমনই। পদ্মশিবিরের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে মিঠুনের বিরক্ত হওয়ার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্ত রয়েছে মেজাজ হারানোরও।

Advertisement

সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহে বৈঠক ছিল বিজেপি নেতা মিঠুনের। বৈঠকে কারা থাকবেন, কারা পারবেন না, তা নিয়ে শুরু থেকেই জটিলতা তৈরি হয়েছিল। জটিলতা থেকে বিশৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খলা থেকে হাতাহাতি। পরিস্থিতি দেখে মিঠুন এতটাই বিরক্ত হন যে, প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে পাশের অফিস ঘরে গিয়ে বসে ছিলেন। পরে তাঁকে অনুরোধ-উপরোধ করে বৈঠকে ফেরানো হয়। সে ফেরাও খুব মসৃণ হয়নি। কারণ, প্রসঙ্গ ওঠে ভোটের সময়ে কর্মীদের হওয়া খরচপত্র জেলা নেতৃত্ব মিটিয়ে দিয়েছেন কি না। মিঠুনকে শুনতে হয় ‘টাকা পাইনি’ এবং ‘টাকা পেয়েছি’— দু’রকম বয়ান। পরিস্থিতি দেখে বলিউডের সুপারস্টার বিস্ময় গোপন করেননি। জেলা স্তরের এক নেতাকে মৃদু কটাক্ষও করেন।

অগস্টে বর্ধমানের কর্মিসভাতেও একই পরিস্থিতি। দাবি-পাল্টা দাবিতে তপ্ত সভায় বিরক্তি লুকোতে পারেননি মিঠুন। বলে ফেলেন, তিনি ৩৮০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ফলে কে অভিনয় করছেন আর কে ঠিক বলছেন, তা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয় না।

কিন্তু মিঠুন নিজে কি বুঝতে পারছেন যে, তিনি ‘অভিনয়’ করছেন না ‘ঠিক’ করছেন?

তিনি কি বুঝতে পারছেন, এই পরিসরে কোনও ‘রিটেক’ নেই। ‘এনজি’ হয়ে গেলে তা শুধরোনোর সুযোগ নেই? কিছু দিন আগে এক সাংবাদিক বৈঠকে তৃণমূলের নেতা কুণাল ঘোষের নাম শুনে দৃশ্যতই মেজাজ হারিয়েছিলেন মিঠুন। কুণাল সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি এতটাই বিরক্ত হয়েছিলেন যে, প্রশ্নকারী সাংবাদিককে ঘর থেকে বার করে দেন। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের চ্যানেলের ‘বুম’ হাতে তুলে নিয়ে ধমকের সুরে বলেন, ‘‘আর এখানে আসবেন না আমার কাছে! যান, আপনি চলে যান!’’

জনশ্রুতি, রাজনীতিতে নিজের প্রথম ইনিংস মিঠুন খেলেছিলেন সত্তরের দশকে নকশালপন্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে। তার ফলেই নাকি তিনি মুম্বই পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার পর থেকে অন্তত চার দশক সক্রিয় রাজনীতিতে পা রাখেননি। তবে বাংলার শাসকদলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থেকেছে। সিপিএমের দাপুটে মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ঘনিষ্ঠ তো ছিলেনই। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে তিনি সম্বোধন করতেন ‘জ্যোতি আঙ্ক্‌ল’ বলে। কিন্তু তাঁকে কোনও সরকারি স্বীকৃতি সিপিএম দেয়নি। কেন্দ্রীয় স্বীকৃতিও জোটেনি। বলিউডে তাঁর চেয়ে জুনিয়রেরা পদ্মসম্মান পেলেও মিঠুনের ঝুলি ফাঁকা ছিল। অনেকে বলেন, তখনই কুণাল তাঁকে বুঝিয়েছিলেন, মিঠুন যে ‘স্বীকৃতি’ খুঁজছেন, তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিতে পারেন। মমতা-মিঠুন বৈঠকও করিয়েছিলেন কুণালই। অতঃপর ২০১৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে মিঠুন যান রাজ্যসভায়। এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় রাজ্যসভার সাংসদের মনোনয়ন পেশ করার পরে নবান্নে মমতার ঘরে গিয়ে তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেছিলেন।

পরিস্থিতি বদলে যায় বাংলা জুড়ে চিটফান্ড হাহাকার শুরু হওয়ার পরে। সে বিতর্কে মিঠুনের নাম জড়িয়ে যায়। কেন্দ্রীয় এজেন্সির নজর পড়ে তাঁর উপরে। বেশ কিছু দিনের জন্য অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন মিঠুন। অবশেষে তৃণমূলের সাংসদ পদের মেয়াদ অর্ধেক পেরোনোর আগেই ২০১৬ সালের শেষ দিকে ইস্তফা দিয়ে ফের রাজনীতি থেকে প্রস্থান করেন।

রাজনীতিতে মিঠুনের তৃতীয় ইনিংস শুরু হয়েছে ২০২১ সালে। সিপিএমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং তৃণমূলের সাংসদ হওয়ার পরে এ বার বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির হয়ে গোটা রাজ্যে ‘রোড শো’ করেছিলেন মিঠুন। বিজেপি বাংলার ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। জাদুসংখ্যার অনেক আগে থেমে গিয়েছিল। তবে তাতে বিজেপির অন্দরে মিঠুনের ‘দাম’ কমেনি। তাঁকে দলের জাতীয় কর্মসমিতি এবং রাজ্য কোর কমিটির সদস্য করা হয়। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রচারে অন্যতম ‘তারকা মুখ’ ছিলেন তিনি। সে বছর বাংলায় শোচনীয় ফল হয়েছিল বিজেপির।

তবে তাতেও মিঠুনের ‘দাম’ কমেনি। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে আবার আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। নিজেই জানিয়েছিলেন, তিনি দলকে সময় দিতে ‘ইচ্ছুক’। ফলে দল থেকে তাঁকে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ দিকে কলকাতা এবং জেলায় একাধিক কর্মিসভা করেছেন। অগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ জুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়। কিন্তু সে সব কর্মিসভায় সব কিছু ‘প্রত্যাশা’ মতো ঘটছে না। তাতে তাঁর বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছে। গোলমালটা কোথায় হচ্ছে, জানতে মিঠুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল আনন্দবাজার ডট কম। তাঁর আপ্ত সহায়ক লিখিত প্রশ্ন চেয়েছিলেন। তা পাঠানোও হয়েছিল। এক সপ্তাহেও জবাব আসেনি। তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক রাজ্যের এক নেতা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, ‘‘মিঠুনদা ভেবেছিলেন, তাঁর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা-ভালবাসার কারণে তিনি সংগঠনের অনেক সমস্যা সামলে দিতে পারবেন। রোড শো বা জনসভায় তাঁর নামে এখনও ভিড় হয়। মানুষ তাঁকে এখনও দেখতে আসে। কিন্তু কর্মিসভা বা সংগঠন সামলানো আলাদা। সাংগঠনিক বৈঠকে বন্ধ দরজার আড়ালে কেউ কাউকে রেয়াত করে না। ফলে মিঠুন চক্রবর্তীকে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে।’’ সমস্যা মেটাতে পারছেন মিঠুন? ওই নেতার কথায়, ‘‘তেমন খবর তো আসছে না। হয়তো ফিল্মি ডায়লগে বা নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে পরিস্থিতি ধামাচাপা দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে সংগঠনের লাভ কিছু হচ্ছে না।’’

তবে রাজনীতির তৃতীয় ইনিংসে অভিনেতা মিঠুনের কিছু ‘প্রাপ্তি’ তো হয়েইছে। ২০২৪ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পেয়েছেন। সেই বছরেই পেয়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে’। ‘বড় অভিনেতা’ হিসাবে সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ‘বড় নেতা’ হিসাবে?

মিঠুন সম্যক বুঝতে পারছেন। বুঝতে পারছেন, এখানে ‘রিটেক’ নেই। বাঁধানো চিত্রনাট্যও নেই।

Advertisement
আরও পড়ুন