বিজেপি থেকে তৃণমূলে পার্নো মিত্র (বাঁ দিকে), তৃণমূল থেকে বিজেপিতে তাপস রায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
নতুন ‘নজির’ গড়ল বরাহনগর। নজির গড়ল দলবদলের রাজনীতিতে। তা-ও মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে। যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিরলের মধ্যে বিরলতম।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বরাহনগরে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে জিতেছিলেন তাপস রায়।। তৃণমূলের তাপসের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন অভিনেত্রী পার্নো মিত্র। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তৃণমূলের সেই তাপস যোগ দেন পদ্মশিবিরে। বিধায়কপদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উত্তর কলকাতা লোকসভা আসনে। জেতেননি। তবে সক্রিয় ভাবে এখনও বিজেপিই করছেন প্রবীণ রাজনীতিক। আর সেই পার্নো শুক্রবার যোগ দিলেন তৃণমূলে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে বরাহনগরে যিনি যে দলের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, আরও একটি বিধানসভা ভোটের আগে সেই তাঁরাই পারস্পরিক দল বদলে ফেলেছেন। সাড়ে চার বছর আগে যে দলের বিরুদ্ধে তাঁরা সরব ছিলেন, তাঁরা এখন সেই দলেই! নির্বাচনের ময়দানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নারী নিরাপত্তা নিয়ে সরব ছিলেন পার্নো। বিজেপির বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে বিঁধেছিলেন তাপস। সাড়ে চার বছরের মধ্যে উলটপুরাণে ‘পাল্টে গেল মত, বদলে গেল পথ’।
তৃণমূল সূত্রের খবর, মাসখানেক আগে পার্নোই শাসকদলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে দলে যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। তার পর দলের প্রথম সারির নির্দেশ যায় এক নেতার কাছে। বলা হয়, পার্নোর যোগদানের কর্মসূচিতে তাঁকে থাকতে হবে। কারণ, তাঁর সঙ্গে টলিউডের ‘সখ্য’ রয়েছে, তাই টলিউড সংক্রান্ত গুরুদায়িত্ব তাঁর কাঁধে। কিন্তু ওই নেতা দলীয় নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ করেন, তাঁর বদলে বরং কোনও মন্ত্রীকে দিয়ে পার্নোকে দলে যোগদান করালে ভাল। সেই অনুরোধ রাখা হয়েছে। পার্নোকে দলে যোগদান করিয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এবং রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার।
তৃণমূলে যোগ দিয়ে পার্নো বলেছেন, ‘‘মানুষ মাত্রেই ভুল করে। সেই ভুল সংশোধনের সময় এসে গিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করে নিজেকে ধন্য মনে করছি।” এ-ও বলেছেন, ‘‘আমি সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না।’’ তাপস অবশ্য দলবদলের রাজনীতি নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পার্নোর তৃণমূলে যোগদান সম্পর্কে কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘‘তৃণমূল দলটা তো এখন অভিনেতা-অভিনেত্রীতেই ভরা। কয়েক দিন পর ওটা আর রাজনৈতিক দল থাকবে না। অভিনেতাদের দল হয়ে যাবে।’’
২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে আসার পরে রাজ্য রাজনীতিতে মৌলিক বদলগুলির অন্যতম সূচক এই দলবদলের সংস্কৃতি। যা অতীতে পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ছিল না। বরং ‘আয়ারাম-গয়ারাম’ সংস্কৃতি দুগ্ধবলয়ের বলেই কথিত ছিল রাজনীতিতে। দলবদলের রাজনীতিকে যিনি এই রাজ্যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি একদা তৃণমূলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ মুকুল রায়। যিনি নিজেও পরে বিজেপিতে গিয়ে আবার তৃণমূলে ফিরেছিলেন। দলত্যাগ বিরোধী আইনে সম্প্রতি তাঁর বিধায়কপদও খারিজ হয়েছে আদালতের নির্দেশে।
তবে গত ১৪ বছরে পশ্চিমবাংলায় দলবদল যে ভাবে জলভাতে পরিণত হয়েছে, তাতে বিস্ময়ের উপাদান খুব একটা থাকে না। দলবদলের পরে গুরু-শিষ্যের লড়াই দেখেছে শিলিগুড়ি। সিপিএমের অশোক ভট্টাচার্য বনাম সিপিএম থেকে বিজেপি-তে যোগ দেওয়া শঙ্কর ঘোষের লড়াই হয়েছিল ২০২১ সালের নির্বাচনে। দলবদলের আরও নানা প্রকার দেখা গিয়েছে। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া বা বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া তো লেগেই রয়েছে। বাম সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রীরাও গত দেড় দশকে তৃণমূল এবং বিজেপিতে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। তৃণমূলে গিয়ে মমতা সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন অধুনাপ্রয়াত রেজ্জাক মোল্লা। আবার রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী বঙ্কিম ঘোষ এখন বিজেপি পরিষদীয় দলের অন্যতম সদস্য। রানাঘাট দক্ষিণের মুকুটমণি অধিকারী এবং রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণী একই মেয়াদে প্রথমে বিজেপি এবং তার পরে উপনির্বাচনে জিতে তৃণমূলের বিধায়ক হয়ে নজির গড়েছেন। তবে একটি বিধানসভা নির্বাচনে মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দু’জন আর একটি বিধানসভা ভোটের আগে একেবারে পারস্পরিক উল্টো মেরুতে চলে গিয়েছেন, তা পশ্চিমবাংলার রাজনীতি দেখেনি।
বরাহনগর একটা সময়ে ছিল ‘লালদুর্গ’। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্র থেকে জিতেই বিধানসভায় গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। তার পরে ১৯৭২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই আসন ছিল সিপিআই এবং আরএসপি-র দখলে। আবার ২০১১ থেকে টানা তিন বার তৃণমূলের হয়ে জিতেছিলেন তাপস। তাঁর ইস্তফার পরে উপনির্বাচনে জিতে এখন বরাহনগরের বিধায়ক তৃণমূলের আর এক অভিনেত্রী মুখ সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশ্চর্য নয় যে, পার্নোর তৃণমূলে যোগের সঙ্গে সঙ্গেই শাসকদলের অন্দরে কৌতূহল তৈরি হয়েছে— তাঁকেও কি বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী করবে দল? করলে কোথায়?