School Teacher

সাড়ে ২৮ বছর স্কুলে পড়িয়েছেন, ছুটি নেননি এক দিনও, অবসর নিয়ে সেই স্কুলেই বিনা বেতনে ইতিহাস পড়াচ্ছেন সুপর্ণা ঘোষ

১৯৯৭ সালের ২ মে স্কুলশিক্ষিকার কাজে যোগ দিয়েছিলেন সুপর্ণা। পড়িয়েছেন টানা সাড়ে ২৮ বছর। অবসর নেওয়ার পরেও পড়িয়ে চলেছেন। এই সাড়ে ২৮ বছরে পশ্চিমবঙ্গের ছবি বদলে গিয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি, ধর্মঘট, কোভিডের মতো নানা দুর্যোগ গিয়েছে। কিন্তু কোনও কিছুই সুপর্ণার স্কুলে যাওয়া থামাতে পারেনি। এক দিনও নয়!

Advertisement
শোভন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৪
School teacher Suparna Ghosh has not taken a single day off in 28 years, continues to teach without pay even after retirement

হুগলির শ্রীরামপুরের রাজ্যধরপুর নেতাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুপর্ণা ঘোষ। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

কবি ভাস্কর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিন মাস ঘুমিয়ে থাকব।’ শ্রীরামপুরের স্কুলশিক্ষিকা সুপর্ণা ঘোষ তাঁর হোয়াট্সঅ্যাপ বায়োতে লিখে রেখেছেন, ‘শীতকাল এসে গেছে সুপর্ণা’। ভাস্কর তিন মাস ঘুমোতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুপর্ণা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোনও ঋতুতেই ‘ঘুমোতে’ চাননি। জেগে থাকতে চেয়েছেন। চেয়েছেন জাগিয়ে রাখতেও।

Advertisement

হুগলির শ্রীরামপুরের রাজ্যধরপুর নেতাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সাড়ে ২৮ বছর পড়িয়েছেন ইতিহাসের শিক্ষিকা সুপর্ণা। কিন্তু এক দিনও ছুটি নেননি! একটি দিনও নয়। গত ৩১ অক্টোবর তিনি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু তার পরেও পড়িয়ে চলেছেন ওই স্কুলেই। বিনা বেতনে। ১৯৯৭ সালের ২ মে স্কুলশিক্ষিকার কাজে যোগ দিয়েছিলেন সুপর্ণা। পড়িয়েছেন সাড়ে ২৮ বছর। অবসর নেওয়ার পরেও পড়িয়েই চলেছেন। এই সাড়ে ২৮ বছরে পশ্চিমবঙ্গের ছবি বদলে গিয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি, ধর্মঘট, কোভিডের মতো নানা দুর্যোগ গিয়েছে। কিন্তু কোনও কিছুই সুপর্ণার স্কুলে যাওয়া থামাতে পারেনি। এক দিনও নয়!

কী করে পারলেন? সুপর্ণা বলছেন, ‘‘এটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। ঈশ্বর সহায় থাকায় আমি এটা করতে পেরেছি।’’ সাড়ে ২৮ বছর নেহাত কম সময় নয়। এই পর্বে পশ্চিমবঙ্গ তিন জন মুখ্যমন্ত্রী দেখেছে। এই দীর্ঘ সময়ে এক দিনও কি অসুস্থ হননি তিনি? সুপর্ণার জবাব, ‘‘হলেও আমল দিইনি। স্কুলে গিয়েছি। পড়িয়েছি। ওটাই আমার সব। স্কুলের জন্যই জীবনের বাকি স্বাচ্ছন্দ্য।’’

সুপর্ণার জন্ম, স্কুল এবং কলেজের পাঠ দুর্গাপুরে। তার পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর এবং চন্দননগর সরকারি কলেজ থেকে বিএড করেন তিনি। পড়া শেষে শুরু করেন পড়ানো। শিক্ষিকা হিসাবে হাতেখড়ি গিরিডির সেনা পাবলিক স্কুলে। কিন্তু তার পর তাঁর বিয়ে হয় হাওড়ার আমতায়। তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা, সেই সময়েই শ্রীরামপুরের স্কুলে চাকরির সুযোগ আসে। চলে যান শ্রীরামপুরে। শিশুকন্যা ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই যোগ দেন শিক্ষকতার কাজে। সদ্যোজাত কন্যাকে পরিচারিকার কাছে রেখেই স্কুলে পড়াতেন। মনখারাপ হত। কিন্তু নিজের নেওয়া চ্যালেঞ্জে হারতে চাননি। বলছেন, ‘‘অনেকে বলেন, আমি আমার কন্যার শৈশবকে অবহেলা করেছি। তা হয়তো একটু হয়েছে। তবে সে-ও নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।’’ সুপর্ণার কন্যা চন্দননগরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট থেকে স্কুলের পাঠ শেষে মায়ের বিষয় ইতিহাস নিয়েই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনিও পড়াচ্ছেন একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। সুপর্ণার স্বামী কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেছেন। অবসরের পরে আপাতত কর্মরত চেন্নাইয়ের একটি সংস্থায়।

রাজ্যধরপুর নেতাজি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধানশিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা চন্দের কথায়, ‘‘কোনও কাজেই আমাদের কোনও চিন্তা করতে হয় না। কারণ, আমরা জানি সুপর্ণাদি আছেন।’’ পাশাপাশি তিনি এ-ও বললেন, ‘‘এখন যখন দেখি, অনেকেই অকারণে ছুটি নিচ্ছেন, তখন মনে হয় সুপর্ণাদি কী ভাবে কাজ করেছেন! আমি ওঁকে গত ২২ বছর ধরে দেখছি। কখনও সময়ের আগে স্কুল থেকে বেরিয়ে যাননি। কখনও ছুটিও নেননি।’’ আর সুপর্ণা জানাচ্ছেন, পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে গেলেও পুজো বা গরমের ছুটিকে বেছে নিতেন। যখন স্কুল বন্ধ। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে বলতেন, একটা সিএল (ক্যাজ়ুয়াল লিভ) নিলে কী হয়? কিন্তু আমি নিইনি।’’

সাড়ে ২৮ বছরে ২৮ টি শীত পার করেছেন সুপর্ণা। কিন্তু এক দিনও স্কুল কামাই করেননি। তিন মাস ঘুমিয়ে থাকা তো দূরের কথা।

Advertisement
আরও পড়ুন