দক্ষিণ কলকাতার চড়িয়াল খাল ভরেছে কচুরিপানা ও প্লাস্টিক বর্জ্যে। —নিজস্ব চিত্র।
অনেক কিছুই হতে পারত। কিন্তু হয়নি।
এক দশক আগে ভিআইপি রোডের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কেষ্টপুর খালে লঞ্চ চালানো হয়েছিল অল্প কিছু সময়ের জন্য। উদ্দেশ্য ছিল মূলত দু’টি। প্রথমত, ওই খাল দিয়ে গঙ্গার জল নিয়ে গিয়ে নিউ টাউনে জল প্রকল্প তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, সল্টলেক এবং কলকাতার মধ্যে জলপথে সংযোগ গড়ে তোলা। কিন্তু সেই জলের মান এতটাই খারাপ ও দূষিত ছিল যে, শেষ পর্যন্ত দু’টি প্রকল্পই মুখ থুবড়ে পড়ে। আর জলের এই খারাপ মানের অন্যতম কারণই ছিল, কেষ্টপুর ও তার লাগোয়া উল্টোডাঙা অঞ্চলের নিউ কাট খালের দু’ধারের বেআইনি বসতি। অনেকেই মনে করেন, ওই দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কলকাতা শহরে বিদেশের মতো সুন্দর পরিবেশ তৈরি হত। কিন্তু অভিযোগ, ভোটের রাজনীতির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই শহরের গা বেয়ে বইতে থাকাসার্কুলার খাল, নিউ কাট খাল, চড়িয়াল খাল-সহ ছোট-বড় বিভিন্ন খাল নিকাশি নালার বেশি কিছু হয়েউঠতে পারেনি। যে কারণে খালপাড়ে বাঁশ, অ্যাসবেস্টসের বাড়ি তৈরি করে বসা জবরদখলকারীদের নিয়ন্ত্রণেরও কোনও চেষ্টা হয়নি কখনও। উল্টে ওই জবরদখলকারীদের অনেকেরই নাম স্থানীয় এলাকার ভোটার তালিকায় উঠিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোর পথ সুগম করেছেন রাজনীতির কারবারিরা, এমনই অভিযোগ।
কলকাতার চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়েকটি খালের আশপাশে ঘুরে দেখলেই বোঝা যায়, যাঁরা খালের জমি কিংবা খালের পাড় দখল করে বসতি স্থাপন করেছেন, তাঁরা বিন্দুমাত্র ভাবিত নন এ সব নিয়ে।শাসকদলও জানে, পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে, তাতে ওই সমস্ত বেআইনি বসতি উচ্ছেদ করে খালের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক আধারের হাল ফেরানো আদৌ হয়তো আর সম্ভব নয়। তাই তারাও আর এ নিয়ে ভাবিত নয়। সেচ দফতরের এক প্রাক্তন আধিকারিকের দাবি, ‘‘সেচদফতর কোটি কোটি টাকা খরচ করে খাল সংস্কারের কাজ করে। যদিও বাস্তবে এই উদ্যোগ পরিণত হয় খালপাড়ের বাসিন্দাদের পরিষ্কার জলের জোগান দেওয়া। যে জলফের কয়েক দিনেই তাঁরা নোংরা করে ফেলেন। এক বার খাল কাটা হলে বছর দশেক সেটির নাব্যতাবজায় রাখা যায়, যদি সেই খাল নোংরা না করে ঠিক মতো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কলকাতার প্রতিটি খালে প্লাস্টিক-সহ এত আবর্জনা ফেলা হয় যে, পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে আবার খাল না কেটে উপায়থাকে না।’’
উত্তরের নিউ কাট খাল কিংবা দক্ষিণের চড়িয়াল খালের ধারে দাঁড়ালে দেখা যায়, কী ভাবে প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য খালের জলের দিকের অংশে শৌচাগার কিংবা খাটা পায়খানা তৈরি করেছেন জবরদখলকারীরা। একই ছবি দেখা যাবে উত্তর কলকাতায় গঙ্গার মূল স্রোতের অদূরে থাকা সার্কুলার খালের ভিতরের পাড়ের দিকে নজর দিলেই। সেখানে আবার জবরদখলকারীরা দোতলা বাড়িও তৈরি করে ফেলেছেন। ওই খাল যখন রাজাবাজার এলাকায় ঢুকছে, তখন দেখা যাচ্ছে, কী ভাবে খালের জল বয়ে যাওয়ার অংশে ছাগলপট্টির আবর্জনা জমে খাল সঙ্কীর্ণ হয়ে গিয়েছে। বাগজোলা (নিম্ন) খালটি গিয়ে পড়ছে কুলটি গাঙে। কেষ্টপুর থেকে নিউ টাউন অভিমুখে ওই খালটির পাড় এ পর্যন্ত দখলমুক্ত করা যায়নি। সেখানেও দেখা যায়, খালের উপরে বাঁশের তৈরি শৌচাগার। খালের পাড় জুড়ে রয়েছে বসতি আর বাজার।
সেচ দফতরের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘এক দশক আগে কেষ্টপুর খালে প্রথম যে দিন লঞ্চ নেমেছিল, সে দিন নিউ কাট খালে সেটি প্রবেশের পরেই বিপত্তি ঘটে। ওই খালের জলে ডুবে থাকা টায়ার লঞ্চের নীচের প্রপেলারে জড়িয়ে যায়। সবাইকে নিয়ে দীর্ঘ সময় লঞ্চ সেই খালেই আটকে ছিল। আজও প্রতিটি খালে যখনই সংস্কারের কাজ হয়, জল থেকে টায়ার, বাঁশের তক্তা, প্লাস্টিকের আবর্জনা বিপুল পরিমাণে তোলা হয়।’’
সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার দাবি, খালের পাড় এ ভাবে বামফ্রন্টের আমল থেকেই দখল হয়ে রয়েছে। তৃণমূলের আমলে হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘সবার আগে মানুষকে সচেতনহতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষ সচেতন নন। এত মানুষের বসবাসের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে সংবেদনশীলতার সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে, জনপ্রতিনিধিদেরও খাল পরিষ্কার রাখতে সচেতনতার প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। সেচ দফতর সাহায্য করতে তৈরি। খাল প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কোনও ভাবে খালের জলের প্রবাহে বাধা দেওয়া যাবে না। আমরা সকলের কাছে সে দিকে খেয়াল রাখতে অনুরোধ করছি।’’
(চলবে)