Pahalgam Victim Bitan Adhikari

পহেলগাঁওয়ে ‘শহিদ’ বিতানের স্ত্রী কি রাজনৈতিক আঙিনায়? সোহিনীর নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপি সক্রিয় হওয়ায় জল্পনা

কাশ্মীর থেকে কলকাতায় ফেরার পরে বিমানবন্দরে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে বিতানের স্ত্রী সোহিনী রায় আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন। পশ্চিমবঙ্গের এক ঝাঁক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সেখানে হাজির ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সোহিনীর আদান-প্রদান রাজ্যের নজর কেড়েছিল।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৫ ১০:০৬
Would Pahalgam victim Bitan Adhikari’s wife shore up to Bengal politics, Buzz doing rounds after Sohini gets Indian citizenship

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

সহানুভূতির ঢেউ মিশছে জাতীয়তাবাদের স্রোতে। সে স্রোত এগোচ্ছে রাজনীতির প্রবাহের দিকে। গোটা দেশে একই ছবি। ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও। ফলে বঙ্গ রাজনীতির অলিন্দে আলোচনা বাড়ছে পহেলগাঁও হামলায় নিহত এক বাঙালি পর্যটকের পরিবারকে ঘিরে।

Advertisement

কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ২২ এপ্রিল ২৫ জন পর্যটক-সহ ২৬ জনকে গুলি করে মেরেছিল জঙ্গিরা। ৬ মে গভীর রাতে পাকিস্তানে ন’টি জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে প্রত্যাঘাত করে ভারত। তৈরি হয় দেশজোড়া ‘জাতীয়তাবাদের স্রোত’। সহানুভূতি এবং জাতীয়তাবাদের মিলিত প্রবাহ সম্পর্কে কী অবস্থান নেওয়া হবে, তা নিয়ে দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক দল সাবধানি। কিন্তু ভাবাবেগের হাওয়া নিজেদের পালে যতটা সম্ভব টানার কথাও মাথায় রাখছেন বিভিন্ন দলের নেতৃত্ব।

বিজেপি দেশজোড়া ‘তিরঙ্গা যাত্রা’ শুরু করার পরিকল্পনা নিয়েছে। পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর ‘পরাক্রমী প্রত্যাঘাত’কে সম্মান জানিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল করতে বলা হয়েছে সব রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্বকে। এ রাজ্যে কলকাতায় এবং বিভিন্ন জেলায় বিজেপি এই ‘তিরঙ্গা যাত্রা’ করবে। নেতৃত্ব দেবেন রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির নেতা-নেত্রীরাই। পশ্চিমবঙ্গে সে রকম কোনও মিছিলে পহেলগাঁও হামলায় নিহত বিতান অধিকারীর স্ত্রী সোহিনীকে দেখতে পাওয়া যেতে পারে বলে বিজেপির একটি সূত্রের দাবি। যদিও বিজেপি নেতৃত্বের মুখে এমন কোনও সম্ভাবনার কথা এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে শোনা যায়নি।

পহেলগাঁওয়ে নিহতদের মধ্যে তিন জন পশ্চিমবঙ্গের। এক জন পুরুলিয়ার মণীশরঞ্জন মিশ্র। বাকি দু’জন কলকাতার সমীর গুহ এবং বিতান। এঁদের মধ্যে বিতানের পরিবারই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় থেকেছে। কাশ্মীর থেকে কলকাতায় ফেরার পরে বিমানবন্দরে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে বিতানের স্ত্রী সোহিনী আবেগবিহ্বল হয়ে পড়েন। পশ্চিমবঙ্গের এক ঝাঁক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী সেখানে হাজির ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সোহিনীর আদান-প্রদান রাজ্যের নজর কেড়েছিল। প্রথমে রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস আর ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে তাঁর শোকাতুর কথোপকথন। তার পরে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পৌঁছোতেই তিনি আরও বিহ্বল হয়ে পড়েন।

তার পরেই পারিবারিক সমীকরণের কারণে সোহিনীকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। বিতানের দাদা-সহ পরিবারের কয়েক জন অভিযোগ করেছিলেন সোহিনী ভারতীয় নাগরিক নন, বাংলাদেশি। ফলে বিতানের মৃত্যুতে সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার সোহিনীর রয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতানের দাদারা প্রশ্ন তোলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দু’পক্ষকেই আলাদা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তবে তার পরেও ঝুলে ছিল সোহিনীর নাগরিকত্বের বিষয়টি। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের হস্তক্ষেপে সে সমস্যার সমাধান হয়েছে। গত শনিবার সুকান্ত জানিয়েছেন, সোহিনীকে ভারত সরকার নাগরিকত্ব দিয়েছে।

এ হেন সোহিনীকে বিজেপি এ বার সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী প্রচারের ‘মুখ’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইবে কি না, তা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, ‘তিরঙ্গা যাত্রা’য় সোহিনীকে দেখা যেতে পারে। কেউ বলছেন, সোহিনী নির্বাচনের প্রচারে শামিল হতে পারেন। কেউ আবার সোহিনীর আরও বড় রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখছেন।

কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠছিল, তাঁকে নিয়ে হঠাৎ বঙ্গ রাজনীতির ময়দানে জল্পনা কেন? কারণ, পহেলগাঁও থেকে কলকাতায় ফেরার পরের মুহূর্ত থেকে তাঁকে ঘিরে বিজেপি নেতৃত্বের কলরব। এবং পরে তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বিজেপির ‘সক্রিয়তা’। বিমানবন্দরের বাইরে শুভেন্দু উচ্চকণ্ঠে সোহিনীকে বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু বলে আপনার স্বামীকে মেরেছে। কালকে রাতে আমাকে ফোনে যা বলেছিলেন, সেটা এদের সকলের সামনে বলুন।’’ সোহিনীও উচ্চকণ্ঠেই সে ঘটনা ফের বিবৃত করেছিলেন। শুভেন্দুকে বলেছিলেন, ‘‘আমি আপনার ভরসাতেই এসেছি স্যর। আমার স্বামী আপনাকে খুব মানত স্যর।’’

ওই ঘটনার পরেই বিতানের দাদারা সোহিনীর নাগরিকত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্তর উদ্যোগে সে বিতর্ক এখন অতীত। যদিও সুকান্ত সব ‘কৃতিত্ব’ নিজে নিচ্ছেন না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি একা নাগরিকত্ব পাইয়ে দিইনি। সবাই মিলেই কাজটা করেছি।’’ সুকান্তের বক্তব্য, ‘‘নাগরিকত্ব চেয়ে ওঁর আবেদন আগেই জমা পড়েছিল। কিন্তু কোনও কারণে কাজটা এগোচ্ছিল না। পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পরে আমরা সে কথা প্রথম জানতে পারি। আমাদের এক বিধায়ক ওঁর পূর্বপরিচিত। সেই বিধায়ক আমাকে সমস্যাটার কথা জানান। তখন আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে কথা বলেছিলাম। পরিস্থিতি বিচারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্রুত ওঁকে নাগরিকত্ব দিয়েছে।’’

নাগরিকত্ব পাওযার কথা সোহিনী নিজেই ফোন করে সুকান্তকে জানান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ধন্যবাদও জানান তিনি। বিজেপি সূত্রেই সে খবর জানা যাচ্ছে। কিন্তু সোহিনীর সঙ্গে রাজ্য বিজেপির দুই সর্বোচ্চ নেতার এই আদান-প্রদানে তাঁর বিজেপি-ঘনিষ্ঠতা বাড়ার ইঙ্গিত রয়েছে কি না, সে বিষয়ে বিজেপিতে এখনই কেউ আনুষ্ঠানিক ভাবে মুখ খুলতে নারাজ।

প্রাক্তন সেনাকর্মী এবং শহিদদের পরিজনেরা বিজেপির রাজনীতিতে বরাবরই আলাদা গুরুত্ব পান। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্রে দেশের প্রাক্তন উপ-সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সুব্রত সাহাকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। ২০১৬ সালে টলিগঞ্জে প্রার্থী ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন কর্মী মোহন রাও। ২০২১ সালে কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) কুণাল ভট্টাচার্যকে। ২০২৩ সালে ধূপগুড়ি বিধানসভা আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী করা হয়েছিল তাপসী রায়কে। তাপসীর স্বামী সিআরপিএফে ছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরে জঙ্গি হামলায় শহিদ হন।

সোহিনীর স্বামী বিতান কোনও সশস্ত্র বাহিনীতে ছিলেন না। কিন্ত পহেলগাঁওয়ে যাঁরা নিহত হয়েছেন, বিজেপি তাঁদের ‘শহিদের মর্যাদা’ই দিচ্ছে। তাই সন্ত্রাসের হামলায় ‘শহিদ’ হওয়া বিতানের স্ত্রীকেও ভবিষ্যতে তাপসীর ভূমিকায় দেখতে পাওয়া যাবে কি না, সে প্রশ্ন বঙ্গ রাজনীতির আঙিনায় ঘুরতে শুরু করেছে।

Advertisement
আরও পড়ুন