Bangladesh Unrest

আগুনে পুড়ে জন্ম যে জাতির, আজ তারাই অন্ধকারে

১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তর থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ— বাঙালি বার বার শিখেছে, ক্ষমতার রাজনীতিতে সে শুধুই একটি ভৌগোলিক সুবিধা। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ছিল ধর্মের নামে মানবতার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।

এফ এম শাহীন (লেখক, সংগঠক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা)
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:০০
পুড়ে যাওয়া সংবাদপত্র এবং নথি। শুক্রবার সকালে ঢাকায় ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর কার্যালয়ের সামনে।

পুড়ে যাওয়া সংবাদপত্র এবং নথি। শুক্রবার সকালে ঢাকায় ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর কার্যালয়ের সামনে। ছবি: রয়টার্স।

বাঙালি জাতির ইতিহাস যদি কোনও একটি প্রতীকে ধরা যায়, তবে তা আগুন। এই আগুন কখনও ঘরের চুলায়, কখনও জীবনের উষ্ণতায়, কখনও শ্মশানে মৃত্যুর নীরবতায়, আবার কখনও রাজপথে রক্ত ও ধোঁয়ার উন্মত্ততায়। কিন্তু এই আগুন শুধু বাহ্যিক নয়, এটি আত্মারওআগুন; বঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা ও স্মৃতিহত্যার আগুন।

১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তর থেকে শুরু করে ১৯৪৭-এর দেশভাগ— বাঙালি বার বার শিখেছে, ক্ষমতার রাজনীতিতে সে শুধুই একটি ভৌগোলিক সুবিধা। ১৯৪৭-এর দেশভাগ ছিল ধর্মের নামে মানবতার সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। সেই আগুনে শুধু জমি ভাগ হয়নি— ভেঙে গিয়েছিল ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার, স্মৃতি। এক দিনের মধ্যে প্রতিবেশী হয়ে গেল শত্রু, আত্মীয় হয়ে গেল উদ্বাস্তু। ধর্মের নামে যে বিভাজন করা হয়েছিল, তার ক্ষত আজও শুকায়নি। সেই বিভাজনের ভস্মের ওপরে দাঁড়িয়েই জন্ম নেয় এক বিকৃত রাজনীতি— যেখানে মানুষ নয়, পরিচয়ইপ্রধান; মানবিকতা নয়, ধর্মীয় ট্যাগই চূড়ান্ত সত্য।

এর পরে আসে ১৯৭১। একাত্তর ছিল আগুনের মধ্য দিয়ে এক জাতির পুনর্জন্ম। এটি শুধু যুদ্ধ নয়, ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর অসম্মান, লাখো বাস্তুচ্যুত মানুষের কান্নার ওপরে দাঁড়িয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। সেই সময়ে বাঙালি শিখেছিল— ধর্ম নয়, ভাষা ও সংস্কৃতিই তার পরিচয়। শিখেছিল— স্বাধীনতা কোনও দান নয়, এটি রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকার।

কিন্তু ইতিহাস নির্মম। ১৯৭৫-এ এসে সেই স্বাধীনতার বুকে গুলি লাগল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হল শুধু এক জন মানুষ হিসেবে নয়— মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হত্যা করার জন্য। সে দিন থেকেই বাংলাদেশে আগুন আর নীতিতে নয়, ষড়যন্ত্রে জ্বলতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধীরে ধীরে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে, রাজাকারদের পুনর্বাসন ঘটে, সামরিক ছাউনির ভেতর থেকে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

২০০১ সালে সেই আগুন আবার ধর্মীয় রূপ নেয়। সংখ্যালঘু নিধন, নারী নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের উপরে পরিকল্পিত হামলা— সবই ঘটেছিল রাষ্ট্রের নীরবতায়। বাঙালি তখনও ভেবেছিল, এটা হয়তো সাময়িক, ক্ষমতার পালাবদলের অন্ধকার সময়। কিন্তু ২০২৪ প্রমাণ করল, এটি সাময়িক ছিল না। এটি ছিল প্রস্তুতি। ২০২৪ সালের অগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশ দেখল এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। ঘৃণার প্রজন্ম ও ইতিহাস মুছে ফেলার পরিকল্পিত অভিযান। একে কেউ বলল ‘রিসেট’, কেউ বলল ‘নতুন বাংলাদেশ’— কিন্তু বাস্তবে এটি ছিল পাকিস্তানে ফেরার মনস্তাত্ত্বিক অভিযান।

৫ অগস্ট ২০২৪-এর পর বাংলাদেশ এমন এক সামাজিক রূপ দেখল, যা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়— এটি ছিল নৈতিক পতন। এই প্রজন্মের একটি বড় অংশের চোখে যে ঘৃণা দেখা গেল, তা কোনও স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ নয়, দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত মগজধোলাইয়ের ফল।পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতি, সামাজিক মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বয়ান, ধর্মীয় উগ্রতার স্বাভাবিকীকরণ— এই সব মিলেই তৈরি করা হয়েছে একপ্রজন্ম, যারা আগুনে হাত পুড়লেও প্রশ্ন করে না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বার বার হামলা হচ্ছে। একই কায়দায় হামলা হল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সব স্থাপনায়, ভাস্কর্যে, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, মাজার, মসজিদ, মন্দির সর্বশেষ ছায়ানটে। ছায়ানট হল সেই প্রতিষ্ঠান, যা পাক সামরিক শাসনের সময়েও বাঙালির সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। হামলা হল ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারে, যা ছিল সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহাবস্থানের প্রতীক। এটি নিছক ভাঙচুর নয়। এটি ছিল স্মৃতি-হত্যা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়— যে সমাজ তার স্মৃতি ধ্বংস করে, সে সমাজ নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। এই হামলাগুলো প্রমাণ করে— লক্ষ্য ব্যক্তি নয়, লক্ষ্য সংস্কৃতি। কারণ সংস্কৃতি ধ্বংস করতে পারলে ইতিহাস মুছে যায়, আর ইতিহাস মুছে গেলে প্রতিরোধও মুছে যাবে।

আজ পৃথিবী দেখছে, ‘মব’ কী ভাবে দানবে পরিণত হওয়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর মুখ। রাষ্ট্র তার নৈতিক বৈধতা শুধু হারায়নি, বরং আইনগত বৈধতা দিয়ে এই সকল জেহাদি বর্বর হত্যা ও নিপীড়নের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইনকিলাব মঞ্চের হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে হিংসা শুরু হল, তা দেখিয়ে দিল, মব এখন রাষ্ট্রীয় বৈধতা পাচ্ছে। রাষ্ট্র আর নাগরিকের নিরাপত্তার গ্যারান্টার নয়, রাষ্ট্র এখন নীরব দর্শক— কখনও বা নির্যাতনের প্রত্যক্ষ সহযোগী। এক জন মানুষ হিসেবে বলতে চাই, কোনও মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য নয়। সে আমার চিরশত্রু হলেও।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার, যারা জুলাই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তারাও রক্ষা পেল না। ইতিহাস বলে, উগ্রপন্থা কাউকে বন্ধু ভাবে না। আজ যারা হাততালি দেয়, কাল তারাই আক্রমণের লক্ষ্য হয়। ভারতবিরোধী স্লোগান তুলে হাই কমিশনে হামলা, ভারতবর্ষকে আক্রমণ করে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, গণমাধ্যমে আগুন, সংখ্যালঘু হত্যা— এ সবই আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনীতির সরাসরি লঙ্ঘন। অথচ রাষ্ট্র নির্বিকার, প্রশাসন নির্বাক।

বাঙালি জাতি নানা রঙের, নানা বর্ণের, নানা গন্ধের আগুনে পোড়া জাতি। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, এই জাতি আগুন থেকেই উঠে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব মানবতার কাছে প্রশ্নএকটাই, এ বার আমরা রুখে দাঁড়াব তো? না কি নীরব থেকে এই অন্ধকারকে স্বাভাবিক হতে দেব? কারণ ইতিহাস এক দিন প্রশ্ন করবে, তোমরা তখন কোথায় ছিলে? আর সে দিন আজকের এই নীরবতার কোনও যুক্তি থাকবে না।

আরও পড়ুন