নিরাপত্তাবাহিনীর উপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না বাংলাদেশবাসীদের একাংশ। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী? সাম্প্রতিককালে একের পর এক ঘটনার পরে এই প্রশ্নই উঠেছে সে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মনে। বাহিনীর উপর ভরসা রেখে আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভোট বৈতরণী পার করা নিয়েও জেগেছে সন্দেহ।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে ১২ ডিসেম্বর গুলি করার পর থেকে ফেরার অভিযুক্তেরা। কী ভাবে তাঁরা পালালেন? কী ভাবে অন্তর্বর্তী সরকার, নিরাপত্তাবাহিনীর চোখের সামনে ভাঙচুর হল ‘প্রথম আলো’, ‘ডেলি স্টার’-এর দফতর? কী ভাবে যুবককে প্রকাশ্যে খুন করে পোড়ানো হল? গত কয়েক দিনের এই ঘটনাপ্রবাহের পরে বাংলাদেশে বার বার একটাই প্রশ্ন উঠেছে, নিরাপত্তা কোথায়? নিরাপত্তা দেবে কে? দেশবাসীর একটা অংশ নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে আর ভরসা রাখতে পারছেন না। গত এক বছরে বাংলাদেশে অপরাধের সংখ্যা যে ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকে। তাঁদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার বা নিরাপত্তাবাহিনী কঠোর হতে পারলে এই পরিস্থিতি তৈরি হত না। হাদির মৃত্যুর পরে ধরপাকড়, অভিযান শুরু করেছে পুলিশ, র্যাব। কিন্তু তাতে কতটা কাজ হবে, সেই নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে দেশবাসীর একাংশের মনেই।
হাদির খুনে অভিযুক্তদের কেন এখনও গ্রেফতার করা যায়নি, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের রাজনীতিকদের একাংশ। শনিবার শেষকৃত্যের পরে ইনকিলাব মঞ্চ ঘোষণা করে দিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের ধরতে না পারলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মহম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে হবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন বলছে, ‘প্রথম আলো’ এবং ‘ডেলি স্টার’ কর্তৃপক্ষেরও অভিযোগ, হামলা চালানো হতে পারে খবর পেয়ে সরকারের শীর্ষ আধিকারিকদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করেনি বলে ভাঙচুর এড়ানো যায়নি।
শুধু দুই সংবাদমাধ্যমের দফতর নয়, গত কয়েক দিনে বাংলাদেশে ভাঙচুর হয়েছে ঢাকার সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘ছায়ানট’, ধানমন্ডিতে মুজিবুর রহমানের বাড়ি। বিএনপি-সহ রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, দেশে হিংসার আবহ তৈরি করে নির্বাচন ঠেকানোর জন্যই এ সব করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে নির্বাচন করানোর জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনী কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্নও উঠেছে অনেকের মনে। তবে কেউ কেউ বলছেন, এই পরিস্থিতি যে হতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলেছিল আগেই। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যে ভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা দেখলে অনেক কিছুই স্পষ্ট হয় বলে দাবি তাঁদের।
দেশের কোথায় কী অপরাধ হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান স্থানীয় থানার মাধ্যমে জমা পড়ে পুলিশ সদর দফতরে। যদিও পুলিশের একাংশ থেকে সাধারণ মানুষের অনেকেই মনে করেন, অপরাধের প্রকৃত পরিসংখ্যান অধরাই থেকে যায়। কারণ, বহু অপরাধের মামলা থানায় রুজু হয় না। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যানকে উদ্ধৃত করে ‘বিবিসি বাংলা’ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, অপহরণের ঘটনা হয়েছে ১৮,০৫৪টি। চলতি বছর, গত ১১ মাসে সেই সংখ্যা পৌঁছেছে ১৯,৫৫৫-তে। এক বছরে অপরাধ বেড়েছে প্রায় দেড় হাজার। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর, এই তিন মাসে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ছিল ৪,৪০০। চলতি বছর ওই একই সময়ে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা ৫,৬০০।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরের দিন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর জানিয়েছিলেন, যাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হবেন, তাঁরা চাইলে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে। কোনও প্রার্থীর অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হলে ফেরত দেওয়া হবে। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ়-২’ শুরুর ঘোষণাও করেন তিনি। ভোটকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ভোটকর্মী, রিটার্নিং অফিসারদের নিরাপত্তার জন্য ‘গানম্যান’ নিয়োগ করার কথাও বলা হয়। ইতিমধ্যে চার হাজার জনকে আটক করা হয়েছে।
যদিও তার পরেও বাংলাদেশে হিংসার ঘটনা ঘটেছে বার বার। গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহে এক যুবককে খুন করে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তথা অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক এ সবের জন্য বাহিনীর দুর্বলতাকেই দায়ী করেছেন। ‘বিবিসি বাংলা’-কে তিনি জানিয়েছেন, পরিস্থিতি কখনও একটু ভাল হলেও আবার বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে গিয়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে গণআন্দোলন শুরু হয়। অগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। তার পরে দেশে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। থানা থেকে লুট হয় অস্ত্র। অভিযোগ, প্রায় দেড় বছর কেটে গেলেও সেই লুট হওয়া অস্ত্রের ২০ শতাংশ এখনও ফেরাতে পারেন পুলিশ। তার মধ্যে রয়েছে পিস্তল, শটগান, এলএমজি, এসএমজির মতো অস্ত্র। সেই নিয়েও তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। প্রশ্নের মুখে পড়েছে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কতটা নির্বিঘ্নে হবে, সেই প্রশ্ন রয়েই গিয়েছে। হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে বিএনপির মহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘এ রকম ঘটনা আরও ঘটতে পারে।’’ এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘নিরাপত্তার বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে সরকারের।’’
পুলিশ সদর দফতরের আধিকারিক এএইচ এম শাহদাত হোসেন জানান, তাঁদের মূল লক্ষ্য হল সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেই কাজও চলছে। প্রাক্তন পুলিশকর্তা মুরুল হুদা মনে করেন, গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে আটক করতে হবে। তা হলে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। ১৯ ডিসেম্বর সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায়, অপরাধের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আসন্ন নির্বাচনকে ‘গুরুতর জাতীয় অঙ্গীকার’ বলেও উল্লেখ করে সরকার। তার পরেও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।