World Breastfeeding Week

শিশুর অধিকার, মায়েরও

ভারতীয় সংস্কৃতি গর্ভাধান থেকে প্রসব পরবর্তিকালীন নারীকে সযত্নে পরিচর্যার পরামর্শ দিয়েছে। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতায় এর উল্লেখ আছে।

পৌলমী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:১৮

নবজাতককে পুষ্টি জুগিয়ে জীবনযোগ্য করে তোলার অন্যতম মৌলিক শর্তটি মায়ের দুধ। এতে আছে জল, ফ্যাট, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট। ছোট্ট দেহের পরিচর্যা, বিকাশের সহায়ক নানা ভিটামিন, খনিজ পদার্থ, উৎসেচক, হরমোন, অ্যান্টিবডি ইত্যাদিতে ভরপুর। স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার প্রথম পথ্য। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে মায়ের দেহ-মনেও আছড়ে পড়ে তীব্র মাতৃসুখ।

ভারতীয় সংস্কৃতি গর্ভাধান থেকে প্রসব পরবর্তিকালীন নারীকে সযত্নে পরিচর্যার পরামর্শ দিয়েছে। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতায় এর উল্লেখ আছে। বাংলায় ১৪০ বছর আগে লেখা হয়েছে ধাত্রী শিক্ষা, ধাত্রী শিক্ষা সংগ্রহ-এর মতো বই। উদ্দেশ্য, নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি। আগামী প্রজন্মের জন্য শক্তপোক্ত শরীর, সুস্বাস্থ্য, দেশবাসীকে স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় উৎসাহিত করা। আমাদের দেশের মতো বহু দেশেই এই প্রচলন ছিল। সুস্থতা মানবসভ্যতার বীজমন্ত্র। ইদানীং পৃথিবীব্যাপী মানবসম্পদের প্রাথমিক সুস্থতা আর নীরোগ শৈশবের জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ যথেষ্ট সক্রিয়।

‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালন এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় কর্মসূচি। ১৯৯২ সালে তা প্রথম পালিত হয় ‘ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্টফিডিং অ্যাকশন-এর মাধ্যমে। এখন এই দায়িত্ব ইউনিসেফ এবং হু’র। অগস্টের প্রথম সাত দিন ধরে উদ্‌যাপিত কর্মসূচিটিতে ক্রমশ সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের দেশগুলি। খেয়াল করলেই আমাদের আশপাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা স্থানীয় পুরসভাতেও উদ্যোগটি নজরে আসে। কমপক্ষে ছয় মাস থেকে প্রায় দুই বছর বয়সি শিশুর পুষ্টির লক্ষ্যে স্তন্যদানে সহায়তা, নিঃসঙ্কোচে মায়ের দুধ খাওয়ানোকে সামাজিক চর্চায় পরিণত করার জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচিও গৃহীত হচ্ছে।

মায়ের দুধ খাওয়ানো মা আর শিশু উভয়ের জন্যই ভাল। কিন্তু কিছু অমূলক ধারণা আর একান্ত অসুবিধায় মাতৃদুগ্ধ থেকে শিশু বঞ্চিত হয়। বিষয়টাকে কেবলই শিশুর অধিকার হিসেবে না দেখে মায়ের অধিকার হিসেবে দেখাটাও জরুরি। এখনকার নারীর জীবনধারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। এই বদল ভাল না মন্দ— সে আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, বড় অংশের সাধারণ মেয়েরা এখন খানিক বাধ্যত, খানিক ইচ্ছাক্রমে অস্বাস্থ্যকর জীবনশৈলীতে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে। কেবল বাইরে কাজ করেই নয়, ঘরে থেকেও তাদের অনেকেরই শরীর আর মন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে সন্তানধারণ ও পালনপোষণের ভার বইতে। এই ধরনের যাবতীয় বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে ‘মাতৃদুগ্ধ’ বিষয়ক সর্বজনীন উদ্‌যাপনে। আলোচনা, কর্মশালা ইত্যাদিতে স্বাস্থ্যকর জীবনবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাতে ধরে শেখানো হয় সহায়ক নানা কৌশল।

সদ্যোজাত শিশু, মা এবং মায়ের দুধের আদর্শ সমন্বয় শুধুমাত্র মজবুত ভবিষ্যতের নির্দেশিকা নয়, এই সূচক উন্নয়নের ধারাবিবরণীও বটে। বাংলা শিল্প-সাহিত্য জুড়ে আছে সেই পরিসংখ্যান। যামিনী রায়ের ছবিতে মা শিশুকে কোলে আঁকড়ে যত্নে দুধ খাওয়াচ্ছেন। সচ্ছল বনিয়াদে অনুমান করা যাচ্ছে শিশুর সম্ভাব্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আর আর্থ-সাংস্কৃতিক সুস্থিতি। জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ হোরের রেখায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মা ও দুগ্ধপোষ্য শিশুর শীর্ণকায় চেহারায় সামাজিক আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের হাহাকার। অপুষ্ট মাতৃদেহের পেটে খিদের তাড়না, শূন্য বুকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অকালমৃত্যুর অশনিসঙ্কেত।

তবে আদর-আবেগের মতো মানবিক উপাদানের পাশাপাশি মায়ের দুধের আর্থিক আবেদনটিও বড় স্পর্শকাতর। এর মধ্যে উঁকি দেয় আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা। মহাশ্বেতা দেবীর ‘স্তনদায়িনী’র জননী যশোদা। যত দিন ক্ষমতা ছিল তত দিন নিজের বুকের দুধ অন্য বাড়ির বাচ্চাদের খাইয়েছেন। পয়সার বিনিময়ে। দীর্ঘকাল অমানবিক শারীরিক ধকল সহ্য করেছেন নিজের সন্তান এবং সংসার প্রতিপালনের জন্য। আসলে মায়ের শারীরিক ক্লান্তিকে অতিক্রম করে মাতৃদুগ্ধের একটা গঠনশীল ক্ষমতা আছে। আবার, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দুধ মা’ গল্পের চরিত্রগুলি সামাজিক বৈধ-অবৈধের সীমা পার করে মিথ্যা দিয়ে। তবে নবেন্দু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত সুবোধ ঘোষের কাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র পরশুরামের কুঠার মা, শিশু এবং মায়ের দুধকেন্দ্রিক সমস্ত তত্ত্বকথাকে ওলট-পালট করে দিয়েছে। গল্পটি সমকালীন এবং উত্তর-সমাজকে কুঠারাঘাতে জর্জরিত করে।

তবে পরিবার ও সমাজে একটি বড় কথা অনেক সময়ই খুব বেশি অবহেলিত হয়। মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিকে যে স্তরে রাখতে হয় শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য, তা আমাদের জনসমাজের এক বড় অংশে খুব সহজ নয়। এমনকি অধিক শারীরিক পরিশ্রম বা মানসিক উৎকণ্ঠাও এখানে অন্তরায় হতে পারে। এই সব সত্যকে আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবে অস্বীকার করি। মনে রাখা ভাল, পাঁচ বছরের নীচে শিশুমৃত্যুর ৭০% অপুষ্টিজনিত কারণে— এবং তার নেপথ্যে আছে মায়েদের পথ্যহীন অভুক্ত জীবন। শিশুপুষ্টির একমাত্র উপাদান মায়ের দুধ— সেই স্তন্য যেমন শিশুরও অধিকার, মায়েরও। মা এই অধিকার পালন করতে চাইলেও অনেক সময় অক্ষম হয়ে পড়েন সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি রাষ্ট্রিক কারণে। রাষ্ট্রিক কারণ বুঝতে গেলে, দুর্ভিক্ষ বা যুদ্ধে জড়িয়ে থাকা দেশগুলির কথা ভাবা যেতে পারে, আজকের ইউক্রেন কিংবা প্যালেস্টাইন, কিংবা সর্ব সময়ের আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোর অনাহারক্লিষ্ট শিশুদের— এবং মায়েদের— ছবি মনে করা যেতে পারে। সেই বীভৎসতাকে পাত্তা দেয় না ক্ষমতান্ধ মানুষ। যুদ্ধের ভয়াবহতা শুধুমাত্র একটি শিশুর ভবিষ্যৎকে নষ্ট করছে না; রুগ্‌ণ বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরি করছে। তাই সন্দেহ হয়, ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’ পালন করে কি সচেতনতা জাগানো যাবে এই সংঘর্ষ-উন্মাদ আধুনিক বিশ্বপৃথিবীতে?

আরও পড়ুন