গোড়াতেই মনে করিয়ে দেওয়া যাক, অধুনা গৈরিক বাহিনীর পরম পূজ্য শ্রীরামচন্দ্র রীতিমতো আমিষাশী ছিলেন। তুলসীদাসী বা কৃত্তিবাসী রামায়ণে নয়, মূল বাল্মীকি রামায়ণে। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে বনবাসে যাওয়ার আগে সীতা গঙ্গার আরাধনাপূর্বক সহস্র কলস সুরা ও মাংস-ভাতের নৈবেদ্য দানের কথা বলছেন। অযোধ্যাকাণ্ডেরই ৫৫ সর্গে হরিণ শিকার করে খেতে খেতে রাম লক্ষ্মণকে বলেছেন, “মৃগমাংস আহরণ করিয়া গৃহযাগ করিতে হইবে।” ৫৬ সর্গে বন থেকে হরিণবধ করে এনে অগ্নিতে আহুতি দিয়ে রামকে লক্ষ্মণ বলেছেন, “আপনি এক্ষণে গৃহযাগ আরম্ভ করুন।” ৯৬ সর্গে সীতাকে রাম বলছেন, “এই মৃগমাংস অত্যন্ত স্বাদু ও পবিত্র।” অরণ্যকাণ্ডের ৪৪ সর্গে মৃগরূপী মারীচ হত্যার পর, ৪৭ সর্গে সীতা রাবণকে ভিক্ষা দেওয়ার সময় রামের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে, ৬৮ সর্গে জটায়ুর মৃত্যুর পর মৃগমাংসের পিণ্ডদান করতে গিয়ে বার বার রাম-লক্ষ্মণ-সীতার আমিষাশী হওয়ার কথা উঠে এসেছে। সুন্দরকাণ্ডের ৩৬.৪১ সর্গে রামের বিলাপ বর্ণনায় হনুমান সীতাকে বলছেন, কী ভাবে সীতাবিরহে রাম মদ ও মাংস পরিত্যাগ করে নিরামিষাশী হয়ে উঠেছেন। উত্তরকাণ্ডের ৪২ সর্গে অশোকবনে কাটানো সুখের সময়ে রাম-সীতা মৈরেয় মদ ও মাংস খাচ্ছেন।
রামায়ণের মতো মহাকাব্য যুগে যুগে নতুন করে বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। ক্রমে তা বদলেছে যুগের ধর্ম মেনে, কথকের নিজস্ব ‘নৈতিকতা’র আলোয়। যেমন, সুন্দরকাণ্ডে সীতাবিরহে রামচন্দ্রের মাংস না-খাওয়ার বিষয়টি পরবর্তী কালে পরিবর্তিত হয়েছে ‘রামচন্দ্র নিরামিষাশী ছিলেন’ দাবিতে। যেমন ঋগ্বেদের ১০/৯৪/৩ শ্লোকের ‘আমিষ’ শব্দটি অনুবাদে পরিবর্তিত হয়েছে ‘বৃক্ষের পক্ব ফল’-এ, তেমনই হিন্দু বাহুবলীরা রামচন্দ্রকে নিরামিষাশী বানিয়ে ছেড়েছেন।
এক জন ক্ষত্রিয় রাজপুরুষ, পেশিশক্তিই যাঁর মূল অলঙ্কার, প্রতি মুহূর্তে যাঁকে দুষ্টের দমনের জন্য শত্রুসংঘাতে লিপ্ত হতে হয়, তিনি যে শক্তি আহরণের জন্য উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন প্রাণিজ প্রোটিন খাবেন, সেটাই কি কাঙ্ক্ষিত নয়? এমনকি, ভাল না লাগলেও, কেবল প্রজাকুল রক্ষার লক্ষ্যে আপন বাহুবল বৃদ্ধির জন্যই যে তিনি প্রাণিজ প্রোটিন ভক্ষণ করে রাজধর্ম পালন করবেন, তাও কি স্বাভাবিক নয়? উল্টো দিকে এটাও স্বাভাবিক যে, এক জন ঈশ্বরপ্রেমিক মানুষ যদি নিজে নিরামিষাশী বলে শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে একাত্মতার অনুভবে তাঁকেও নিরামিষাশী কল্পনা করে নিজের ঈশ্বরপ্রেম উদ্যাপন করেন, তাতে অসুবিধার কিছু নেই। মানুষের ধর্মই এই যে, সংসারের যা কিছু সে ভালবাসে, যা কিছু তার ব্যক্তিবিচারে ঠিক, তা-ই সে তার ভালবাসার ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। যে-হেতু অবধারিত ভাবেই বিশ্বের কোনও এক, এমনকি একাধিক মানুষের মধ্যেও তা আজীবন খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সে তার ঈশ্বর নির্মাণ করে। ঈশ্বরকেও মানুষের সেই চাহিদা মেটাতে অঞ্চলভেদে কোথাও আমিষাশী, কোথাও নিরামিষাশী হতেই হয়।
বিশ্বাসের এই বৈষম্যে তাই কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি দাবি করি যে, আমার বিশ্বাসই একমাত্র সত্য, আর সব বিশ্বাস মিথ্যা, ধর্মহীন— তবে আমি এক জন মৌলবাদী। উদ্বেগজনক ভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই মৌলবাদ বেশ তীব্র হয়ে উঠছে। গত ৭ ডিসেম্বর ব্রিগেড ময়দানে পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠের আসরে এক প্যাটি বিক্রেতা গণহেনস্থার শিকার হন। শেখ রিয়াজুল নামের, আরামবাগের ওই প্যাটি বিক্রেতা গত কুড়ি বছর ধরে কলকাতায় প্যাটি বিক্রি করেন। সে দিনও তিনি ভেজ ও চিকেন প্যাটি নিয়ে খদ্দেরের আশায় ময়দানে যান। অতঃপর ‘পবিত্র সভা’য় মাংস বিক্রির অপরাধে কিছু গেরুয়াধারী লোক এসে তাঁর উপরে চড়াও হয়; মারধর করে, পণ্যসামগ্রী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।
আমরা বাঙালিরা, যারা মা কালীর ভোগে পাঁঠার মাংস চড়াই, দুর্গাপুজোয় আমিষ খাই, যাদের ঘরে ঘরে উপাসিত শ্রীমা সারদা তাঁর ভক্তকুলকে আজীবন মন খুলে মাছ-মাংস খেতে বলেছেন— সেই বাঙালির রাজ্যের কোনও জমায়েতে চিকেন প্যাটি যে ‘নিষিদ্ধ’ হতে পারে, এ কথা এক জন হকার জানবেন কী করে? সে দিনের জনসভার আগে কিন্তু কেউ বলেনি যে, সেখানে আমিষ নিষিদ্ধ। তবু ওই বিক্রেতা সে দিন করজোড়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, দিন-আনি-দিন-খাই মানুষেরা আমিষ-নিরামিষের পার্থক্য বোঝেন তার বাজারদরে; খাদ্যের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক খোঁজার বিলাসিতার সুযোগ ঈশ্বর তাঁদের দেননি। ক্ষমতাবানদের আক্রোশের সামনে যদিও সে দিন তাঁর সে কথা বলার সুযোগ হয়নি।
তিন হামলাকারী গ্রেফতার হয়েছিল, পরে জামিন পায়। জনৈক বিজেপি নেতা তাঁদের সর্বসমক্ষে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়ে বলেন, হামলাকারীরা তাদের যথার্থ ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছে, হিন্দুধর্ম রক্ষার লড়াই লড়েছে, এ লড়াই চলবে।
নোম চমস্কি বলেছিলেন, হিটলার ষাট লক্ষ ইহুদি নিধন করেছিলেন, তার থেকেও বড় কথা এই যে, সে কালের সাধারণ জার্মানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হিটলারের এই গণহত্যা সঠিক বলে মনে করেছিলেন। এখানেও বক্তব্য একই— কিছু মৌলবাদী নেতা বা তিন জন মগজধোলাই হয়ে যাওয়া মানুষ এক শ্রমজীবী মানুষকে নিগ্রহ করেছে, তার থেকে ঢের বড় কথা এই যে, বাংলার এক বড় সংখ্যক সাধারণ মানুষ এই নিগ্রহকে সমর্থন করেছেন। ঢের চিন্তার কথা এই যে, পশ্চিমবঙ্গও ক্রমে ‘ভারত’ হয়ে উঠছে। ঢের শঙ্কার কথা এই যে, সমাজমাধ্যমে বহু মানুষ নিতান্ত মিথ্যা বয়ান ছড়াচ্ছেন যে, লোকটি সে দিন ভেজ প্যাটি বলে চিকেন প্যাটি বিক্রি করছিলেন!
পশ্চিমবঙ্গের আবহমান জনজীবনকে যাঁরা জানেন, তাঁরা বলবেন, ধর্মের জলঅচল গণ্ডিতে সাধারণ মানুষ বাঁধা থাকেন না। তাঁরা হিন্দু হয়ে উরস শরিফের মেলায় যান, ছেলেমেয়ের অসুখ করলে তাবিজ কেনেন, মাজারে মানত করেন, মুসলমান হয়েও রথের মেলায় জিলিপি খান, গ্রামের পুরোহিতের গঙ্গাজল মাথায় নেন। দারিদ্র ঈশ্বরের কাছে মানুষের শর্তহীন, শ্রেণিহীন, ধর্মহীন আত্মসমর্পণ ঘটায়।
কিন্তু এ সব সত্য বিশ্বাস করতে গেলে নিরপেক্ষ হতে হয়। ধর্মের, বিশ্বাসের, মানুষের প্রতি, এমনকি ঈশ্বরের প্রতিও। কিন্তু মৌলবাদে অন্ধ মানুষ এমনই অভাগা যে, না সে অন্য মানুষকে শর্তহীন ভালবাসতে পারে, না সে ঈশ্বরকে তাঁর প্রকৃত পরিচয়ে স্বীকার করে নিঃশর্ত সমর্পণে মুক্ত হতে পারে। পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ আসরের ‘জয় শ্রীরাম’ উল্লাসের নীচে ঈশ্বর, মানুষ ধর্ম, সবই চাপা পড়ে যায়, বেঁচে থাকে শুধু অন্ধবিশ্বাস ও দলীয় রাজনীতি।