Lionel Messi

আর একটি ‘পালক’

কেবল বিশৃঙ্খলা নয়, ঘটনাটির জন্য দেশবিদেশে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হল।

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:০১

দুর্ভাগা পশ্চিমবঙ্গ! জনসাধারণের ক্লেশ এখানে যেমন যথাতথা পরিব্যাপ্ত, আনন্দও এ রাজ্যে অতি সহজে গভীর ক্লেশে পরিণত। গত শনিবার যুবভারতীতে মেসি-দর্শনএকটি আনন্দের ঘটনা হওয়ারই কথা ছিল। বহুসংখ্যক মানুষ বহু অর্থব্যয়ে সেই আনন্দের সন্ধান করেছিলেন। তার পর যা ঘটে গেল, চূড়ান্ত অব্যবস্থা, সীমাহীন বিশৃঙ্খলা, জনরোষের জোয়ারে ভাঙচুর ক্ষয়ক্ষতি— রাজ্যের ইতিহাসে দিনটি খোদিত হয়ে রইল লজ্জা ও অসম্মানের অন্যতম উত্তুঙ্গ মুহূর্ত হিসাবে। তবে ভাগ্য তো আকাশ থেকে পড়ে না, মানুষের স্বহস্তে নির্মিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যও এখানকার সরকার ও জনসমাজের একত্র উদ্যোগে নির্মিত। রাজ্য সরকারের বিশেষ ‘কৃতিত্ব’— এই ক্লেশ-সংস্কৃতিকে তারা এখানে এমন অবাধ আকার দিতে পেরেছে। জনগণের উত্তেজনা সত্ত্বেও মেসিকে নিয়ে উদ্‌যাপন কেমন শৃঙ্খলাপূর্ণ হতে পারে, ইতিমধ্যেই অন্যান্য রাজ্যে দেখা গিয়েছে। সুতরাং, রাজ্য সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। পারে না যে, তৎক্ষণাৎ তা বুঝে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমা চেয়েছেন রাজ্যবাসীর কাছে। প্রশ্ন হল, এত বড় সমাবেশকে অবজ্ঞা ও অবহেলা করলে তা যে ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, সেটা না ভাবাই কি ক্ষমার অযোগ্য নয়? বিশেষত যেখানে সমস্যা তৈরি করেছেন সরকারি ‘হোমরা-চোমরা’রাই, মুখ্যমন্ত্রীর নিকট নেতৃবর্গ ও তাঁদের পারিষদগোষ্ঠী। চক্ষুলজ্জাহীন আত্মতোষণের এক চরম পর্যায়ে উঠে গিয়েছেন তাঁরা। মেসিকে ঘিরে তাঁরা সে দিন যে কাণ্ড করেছেন, তাতে কেবল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত ও অপমানিত করা হয়নি, স্বয়ং মেসির জন্যও বিপদের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। মন্ত্রীর অটোগ্রাফ-শিকারি সাঙ্গোপাঙ্গদের দাপটে তাঁর নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁকে সরিয়ে নিয়েছিলেন দ্রুত। কেবল বিশৃঙ্খলা নয়, ঘটনাটির জন্য দেশবিদেশে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হল।

এ দিকে কোনও দুই-এক জনের কাঁধে দায় চাপিয়ে দিয়ে তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করে, এবং শাস্তি দিয়ে, নিজেদের দায়-মুক্ত করে ফেলার অভ্যাসটি ইতিমধ্যে ভালই রপ্ত করেছে তৃণমূল সরকার। সুতরাং লিয়োনেল মেসি সফরের মুখ্য উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত গ্রেফতার হয়েছেন, কিন্তু তার বাইরে আর কারও ‘অপরাধ’ এখনও স্বীকৃত হয়নি। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদও শুরু হয়নি। অথচ কোনও একক ব্যক্তির জন্য এই ঘটনা ঘটতে পারে না। রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস ও অন্য প্রভাবশালীরা কেবল মেসিকে ঘিরে সীমাহীন আদিখ্যেতা করেননি, স্টেডিয়ামে সে দিনের প্রথমাবধি বিপুল অব্যবস্থার দায়িত্বও তাঁদের। মেসি-প্রস্থানের পর যে ভাবে জনরোষে স্টেডিয়াম তছনছ হল, তখনও পুলিশের ভূমিকা ছিল অকিঞ্চিৎকর। বাস্তবিক, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি এই রাজ্যে ক্রমশই একটি প্রহেলিকা হয়ে উঠছে। এক দিকে দুর্গাপুজো বা অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রমাণিত, চাইলে কতটাই কর্মকুশলতা দেখাতে পারে কলকাতা পুলিশ, অন্য দিকে একাধিক ক্ষেত্রে পুলিশের অকর্মণ্যতা অবিশ্বাস্য স্তরে প্রকাশিত। ধাঁধার সূত্রটি লুকিয়ে উচ্চতম স্তরেই। পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী কি এখনও নিজের স্খলন দেখতে পাচ্ছেন না? না কি মনে করেছেন, একটি ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমেই সেই দায়ও ঘুচিয়ে ফেলা গিয়েছে?

সব শেষে, পশ্চিমবঙ্গের জনসমাজকেও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে বইকি। এমনিতেই কলকাতার ক্রীড়ামোদীরা ইতিহাসে একাধিক হিংস্রতার পরিচয় রেখেছেন। ১৯৬৭ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ম্যাচ, বা ১৯৮০ সালের ফুটবলে দুই বড় দলের খেলায় বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা ভাবা যেতে পারে। এ বারেও অত্যুৎসাহী জনগণ যে ক্রোধান্ধ ব্যবহার করলেন, তাতে স্পষ্ট যে ‘সেলফি’-সংস্কৃতির আত্যন্তিক দর্শমোহে তাঁরা তীব্র ভাবে আক্রান্ত, শুভাশুভজ্ঞানবিরহিত। এমন উর্বর ভূমি থাকলে প্ররোচনাকারীরাও তার কর্ষণে বিরত হবেন না। সরকার ও সমাজের বৃত্তে এ ভাবেই আবর্তিত হতে থাকবে নৈরাজ্যসাধনা।

আরও পড়ুন