Research on Firefly

অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে কোনও দিন ‘মাংসখেকো’ হয়ে উঠতে পারে জোনাকিও! আশঙ্কা অমূলক নয়

পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, ডায়নোসরেরা যখন রাজত্ব করত, তখনও আপন আলোয় উদ্ভাসিত ছিল জোনাকি। হাজার সমস্যাও তাদের এ পৃথিবীর বুক থেকে উৎখাত করতে পারেনি।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৫ ১৫:২৫
Various information has emerged from research on fireflies, which emit their own light.

আপন আলোয় উদ্ভাসিত জোনাকি নিয়ে গবেষণায় উঠে এল নানান তথ্য। — ফাইল চিত্র।

জল-জঙ্গলে ভরা বাংলায় জোনাকি তার পাখা দু’টি সুখে মেলেছে বহু বছর ধরে। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই। শহুরে অন্ধকার মুছে গিয়েছে, গ্রামঞ্চলের ঝোপে ঝাড়েও আর দেখা যায় না ‘জোনাই’। কিন্তু এত সহজে কি তার অস্তিত্ব মুছে দেওয়া সম্ভব?

Advertisement

পৃথিবীর ইতিহাস বলছে, ডায়নোসরেরা যখন রাজত্ব করত, তখনও আপন আলোয় উদ্ভাসিত ছিল জোনাকি। হাজার সমস্যাও তাদের এ পৃথিবীর বুক থেকে উৎখাত করতে পারেনি। হয়তো ভবিষ্যতেও তেমন হবে না। প্রয়োজনে নিজেদের বদলে ফেলবে তারা! জোনাকি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে সম্প্রতি বাংলার বুকে দু’টি নতুন প্রজাতির আবিষ্কার করেছেন সৃঞ্জনা ঘোষ। বেথুন কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক সৃঞ্জনা বলেন, “আগামী দিনে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে মাংসাশী হয়ে উঠতেও পারে জোনাকিরা। এমন আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

ঘোর অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে রাখে জোনাকিরা, তাই তারা ‘তমোমণি’। এ সব আঁধার মানিকেরা তাদের জীবনচক্রের প্রাথমিক পর্যায়ে লার্ভা অবস্থায় অবশ্য মাংস খেয়েই বড় হয়। গত ১০ বছরের গবেষণায় এ তথ্য পেয়েছেন সৃঞ্জনা। গুবরে পোকা প্রজাতির এই কীট জলা এলাকায় জন্মায়। লার্ভা অবস্থায় ওই জলাশয়ে থাকা শামুক-সহ বিভিন্ন সন্ধিপদী এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মাংস খেয়েই বাঁচে তারা। এমনকি কোনও কোনও প্রজাতির জোনাকি বড় হওয়ার পরও মাংস খায়। তবে বেশির ভাগ জোনাকি মূলত পূ্র্ণাঙ্গ অবস্থায় ফুলের মধু, কিংবা গাছের পাতার রস খেয়ে বাঁচে।

Fireflies keep the light on in the dark, which is why they are also called 'Tamomoni'.

ঘোর অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে রাখে জোনাকিরা, তাই তাদের ‘তমোমণি’ও বলা হয়। — ফাইল চিত্র।

সৃঞ্জনা জানান, গবেষণার কাজে তিনি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছেন। পাশাপাশি বীরভূম-পুরুলিয়ার রাঙামাটি অঞ্চল, উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু পাহাড়ি গ্রাম, গাঙ্গেয় উপত্যকার শহরের খোঁজ করেছেন জোনাকির। শুধু এ বঙ্গ নয়, প্রতিবেশী ওডিশার বিভিন্ন গ্রামেও থেকেছেন। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তার পরই পেয়েছেন দু’টি নতুন প্রজাতির অস্তিত্ব। সৃঞ্জনা বলেন, “যখন গবেষণার কাজ শুরু করেছিলাম, তখন ভাবিনি নতুন কোনও প্রজাতির সন্ধান পেতে পারি। বিশেষ করে কলকাতা শহরের মতো জনবহুল এলাকায় জোনাকির নতুন প্রজাতির বাস থাকতে পারে, এটা ভাবনার বাইরে।”

সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল থেকে যে প্রজাতিটি আবিষ্কার হয়েছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ট্রায়াঙ্গুলারা সুন্দরবনেনসিস’। যে প্রজাতিটি কলকাতার বেহালা-বড়িশা-সরশুনা-ঠাকুরপুকুর অঞ্চল থেকে পাওয়া গিয়েছে তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘মেডিয়োপটেরিক্স বেঙ্গালেনসিস’। এই দুই প্রজাতিই জোনাকিদের ‘লুসিয়োলিনাই’ গোত্রভুক্ত।

(Inset) ‘Triangulara sundarbanensis’ on the left and ‘Mediopteryx bengalensis’ on the right.

(ইনসেটে) বাঁদিকে ‘ট্রায়াঙ্গুলারা সুন্দরবনেনসিস’ এবং ডানদিকে ‘মেডিয়োপটেরিক্স বেঙ্গালেনসিস’। ছবি: অধ্যাপক সৃঞ্জনা ঘোষ।

সৃঞ্জনা জানিয়েছেন, সারা বিশ্বে ‘লুসিয়োলিনাই’ গোত্রের প্রায় ৪৬৬টি জোনাকির প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে প্রায় দু’হাজার প্রজাতির জোনাকি। যাদের মধ্যে বহু প্রজাতিকেই উদ্ধার করা হয়েছে জীবাশ্ম অবস্থায়। জার্মান বিজ্ঞানী অলিভার কেলারের গবেষণা থেকে জানা যায়, ডায়নোসরের সঙ্গেও ছিল জোনাকির বাস। ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ১০-১২টি জীবাশ্মের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

২০২৩ সালেই এই কাজ শেষ করে ফেলেছেন সৃঞ্জনা। সম্প্রতি এক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গবেষণার কথা। গবেষকের কথায়, “জোনাকিদের জন্য গাছ খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাছের উচু ডালে বসে পুরুষ জোনাকি আলো জ্বালিয়ে স্ত্রী জোনাকির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জোনাকির আলো জ্বলা-নেভা আসলে পূর্বরাগের বার্তা— ‘কোর্টশিপ ডায়াল্যাক্ট’। কলা, শিরিষ, খয়ের, বাঁশের মতো ৫৬টি প্রজাতির গাছে বিভিন্ন প্রজাতির জোনাকি দেখেছি। অনেক প্রজাতি গাছেই ডিম পাড়ে।” কিন্তু, জল দূষণের ফলে জোনাকির অস্তিত্ব সঙ্কটে বলে মনে করেন সৃঞ্জনা। কলকারখানার বর্জ্য জলে মেশায় পিএইচ মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে জোনাকির স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। তবে এত সহজে তারা অবলুপ্ত হবে না বলেই আশাবাদী গবেষক।

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তথা প্রাণিবিজ্ঞানী সুশান্তকুমার চক্রবর্তীর অধীনে সৃঞ্জনা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। এই কাজে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার গবেষক লেসলি ব্যালেটাইন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জিত দে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেবব্রত বেরা, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুভঙ্কর কুমার সরকার, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অসমাঞ্জ চট্টোরাজ-সহ অন্যান্য অধ্যাপক এবং গবেষকরা।

Advertisement
আরও পড়ুন