—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
স্মার্টফোনই এখন ডাক্তার। চ্যাটবট বা হেলথ অ্যাপে শারীরিক সমস্যা জানালেই মিলছে ওষুধের খোঁজ। জেনে নিন তা আদতে কতটা ক্ষতিকর
ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের দৌলতে হাতের নাগালে হরেক অ্যাপ, ওয়েবসাইট, এআই। সেগুলোর এমন ক্ষমতা যে জ্বর, সর্দি, কাশি থেকে যে কোনও উপসর্গ লিখলেই সম্ভাব্য রোগ এবং তার ওষুধের খোঁজ মিলবে। ওষুধের নাম, তার ডোজ়, কত দিন খাবেন, তা-ও বলে দিচ্ছে এআই। সমীক্ষা বলছে, চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ার মতো এখন ইন্টারনেট কিংবা চ্যাটবটের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। প্রশ্ন হল, এই পদ্ধতি কি আদৌ নিরাপদ?
সাধারণত ইন্টারনেটে রোগের নাম লিখে সার্চ করলেই তা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যায়। অ্যাপ কিংবা চ্যাটবটকে রোগীর উচ্চতা, ওজন, বয়স, শারীরিক সমস্যার বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। তার প্রেক্ষিতে কয়েক সেকেন্ডেই সম্ভাব্য সমাধান বাতলে দেয় অ্যাপ। কিছু অ্যাপে আবার ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট আপলোড করলে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা এবং সমাধানও পাওয়া যায়।
এই প্রবণতা কেন বাড়ছে?
বাড়ি বসে মাসকাবারি বাজার থেকে ওষুধ, খাবার... সব এখন দশ মিনিটে হাতে আসে। এই প্রবণতা থেকেই অনলাইন মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। চিকিৎসকদের মতে, ডাক্তার দেখানোর জন্য নির্দিষ্ট সময়, অগ্রিম অ্যাপয়েন্টমেন্ট, খরচ ইত্যাদি রয়েছে। এ সমস্ত ঝক্কি এড়িয়ে চলতে চান অনেকেই। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা অনেকেই হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের কাছে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। তা ছাড়া, শারীরিক সমস্যাটি আদৌ গুরুতর কি না তা-ও বুঝে উঠতে পারেন না অনেকে।
“করোনার সময়ে টেলিমেডিসিন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে এই অনলাইন কনসালট্যান্সি বা অ্যাপগুলোরও জনপ্রিয়তা বেড়েছে,” বলছেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান সুবীর মণ্ডল। তবে এই দুয়ের মধ্যে তফাত আছে। ডা. মণ্ডল বলছেন, “টেলিমেডিসিনে ফোনের ও পারে একজন চিকিৎসক থাকেন। তিনি রোগীর বক্তব্য শোনেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুরো কাজটা এআই করে অথবা ব্যক্তি ইন্টারনেট-লব্ধ জ্ঞান নিজের মতো করে বুঝে নেন। সমস্যার সূত্রপাত হয় সেখানেই।”
সমস্যা কোথায়?
অ্যাপের দেওয়া তথ্য সব সময়ে যে ঠিক হবেই, এমনটা নয়। একই উপসর্গ বহু রোগের হতে পারে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রবণতাই হল জটিল বিষয়কে সরলীকরণ করা, যার ফলে ভুল রোগ নির্ধারিত হতে পারে। গুরুতর রোগের প্রাথমিক লক্ষণকে ‘সাধারণ সমস্যা’ হিসেবে দেখালে রোগ জটিল হতে পারে। তা ছাড়া, রোগীর পারিবারিক ইতিহাস, অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কথা জেনে, পরীক্ষানিরীক্ষার পরে একজন চিকিৎসক ওষুধ দেন। রোগ একই হলেও ব্যক্তিবিশেষে ওষুধের ধরন, ডোজ় বদলে যায়। এ কাজ প্রযুক্তির পক্ষে করা অসম্ভব।
মেয়েদের ক্ষেত্রে কিন্তু এই প্রবণতা আরও বিপজ্জনক। ঋতুস্রাব সংক্রান্ত সমস্যা বা কনট্রাসেপ্টিভ পিলের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট, অ্যাপ, এআই-এর মতামত নেওয়ার ঝোঁক বাড়ছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলছেন, “এর ফলে হরমোনাল ইমব্যালান্স হওয়ার ভয় থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম মেনে কনট্রাসেপ্টিভ ব্যবহার না করা, তার কোর্স শেষ না করার ফলে ভবিষ্যতে নানা রকম শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এতে ভবিষ্যতেে কনসিভ করতে বা গর্ভাবস্থাতেও সমস্যা হতে পারে।”
একই কথা প্রযোজ্য প্রসাধনী পণ্য ও কসমেসিউটিক্যালসের ক্ষেত্রেও। চুলের ঘনত্ব, ত্বকের জেল্লা বাড়াতে, ওজন কমাতে গামিজ়, সেরাম অনেকেই ব্যবহার করছেন। ত্বক বিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধর বলছেন, “এ সব পণ্য কোনটা কত দিন, কোন ডোজ়ে ব্যবহার করবেন, তার সিদ্ধান্ত সাবধানে নিতে হয়। ব্যক্তির লিভারের কার্যক্ষমতা, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির উপরে সবটা নির্ভর করে। এআই সে সব বিচার করে না। শুধু ওষুধ খাওয়া নয়, কিছু সেরাম, সলিউশন রয়েছে, যেগুলোর বাহ্যিক ব্যবহারেও হরমোনের ক্ষরণে বদল আসে। এর প্রভাব বডি হেয়ার গ্রোথ তো বটেই, রিপ্রোডাক্টিভ হেলথের উপরেও পড়ে। এর ফলে ভবিষ্যতে সন্তান ধারণ করতেও সমস্যা হতে পারে।”
ওষুধের নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও থাকে। ডা. মণ্ডল উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন, “হার্ট অ্যাটাকের পরে অনেক রোগীকেই ব্লাড থিনার দেওয়া হয়। এই ধরনের রোগী যদি সাধারণ বাজারচলতি অম্বলের ওষুধ খান, তবে ব্লাড থিনার আর কাজ করবে না। আবার অনেক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বমি হয়। তা শরীরের জন্য ভাল। ব্যক্তি যদি এখন বমি কমানোর ওষুধ খান, সে ক্ষেত্রে কিন্তু আসল ওষুধটি কাজ করা বন্ধ করে দেবে।” এআই বা ইন্টারনেট এত জটিল বিচার করতে পারে না।
তা ছাড়া, চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতো ক্ষেত্র, যেখানে রোজ চিকিৎসাপদ্ধতি, ওষুধ বদলে যাচ্ছে, সেখানে ইন্টারনেটে কিন্তু নিয়মিত তথ্য আপডেট করা হয় না। পুরনো বা ভুল তথ্য মোছারও উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে ঠিক, ভুল তথ্যের মধ্যে ব্যক্তি বিভ্রান্ত হতে পারেন। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট না থাকায় রোগীর ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।
ইতিবাচক দিক
এগুলির ফলে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে এ কথাও ঠিক। রোগ, ওষুধ ইত্যাদি নিয়ে সম্যক ধারণা তৈরি হয় রোগীর। তাতে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনার সময়েও সুবিধা হয়। সাধারণ সর্দি-কাশি, জ্বরের সমস্যায় অ্যাপ বা ইন্টারনেট কতক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে, কতটা জল খাওয়া দরকার, কখন ডাক্তার দেখানো জরুরি সে সব পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। হালকা উপসর্গে এই তাৎক্ষণিক তথ্য দুশ্চিন্তা কমায়। তা ছাড়া, জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাথমিক ফার্স্ট এডে ইন্টারনেট, এআই-এর পরামর্শ বিপদের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রোগী নিজেদের স্বাস্থ্যতথ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন, এ নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির ভাল দিক। তাই অ্যাপ বা অনলাইনের তথ্যকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস বা বাতিল না করে বরং নিরাপদ ভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। খেয়াল রাখবেন, ইন্টারনেট কিংবা এআই ডাক্তার নয়। অনলাইন তথ্যকে চূড়ান্ত চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা না করে বিষয়টি জেনে নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন। কোনও ওষুধ নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কোন অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের তথ্য নির্ভুল, তা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।