(বাঁ দিকে) রাহুল গান্ধী এবং অমিত শাহ (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
ভোটচুরি, এসআইআর এবং নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী মঙ্গলবার পাঁচটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন তুলেছিলেন। বুধবার জবাবি বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিশানা করলেন নেহরু-গান্ধী পরিবারকে। বললেন, ‘‘আপনার পরিবার ভোটচোর।’’
নেহরু-গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে ভোটচুরির অভিযোগ তুলতে গিয়ে জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর নাম উল্লেখও করেন শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তি আক্রমণের জবাবে মুখ খোলেন রাহুলও। শাহের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করছি, তিনটি সাংবাদিক বৈঠকে আমি যা বলেছি, তা নিয়ে বিতর্ক হোক। সেখানে আমি তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি, কী ভাবে নির্বাচন কমিশন এবং বিজেপি মিলে ভোট চুরি করছে।’’ জবাবে রাহুলকে নিশানা করে শাহ বলেন, ‘‘হরিয়ানার একটি বাড়িতে নাকি ৫০১টি ভোট রয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখেছে যে ২৬৫ নম্বর ওই বাড়িটি আসলে একটি বিশাল পৈতৃক সম্পত্তি। সেখানে একাধিক পরিবার বসবাস করে। ওটা কোনও ছোট ফ্ল্যাট নয়।’’
যদিও হরিয়ানার ভোটার তালিকায় ব্রাজ়িলের এক মডেলের নাম কিংবা কর্নাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহাদেবপুরা বিধানসভায় ১৫০ বর্গফুটের একচিলতে একটি ঘরে ৮০ জন ভোটারের নাম নথিভুক্তির যে ‘তথ্যপ্রমাণ’ রাহুল সাংবাদিক বৈঠকে দিয়েছিলেন, তার জবাব দেননি শাহ। বরং দাবি করেন, স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের অন্দরে সর্দার বল্লভভাই পটেল ২৮টি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সমর্থন পেয়েছিলেন, যেখানে নেহরু পেয়েছিলেন মাত্র দু’টি। কিন্তু পটেলের বদলে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নেহরু। শাহের মন্তব্য, ‘‘এটিই ছিল দেশের প্রথম ভোটচুরি।’’
নেহরু প্রসঙ্গের পরে জরুরি অবস্থার কথা টেনে শাহ নিশানা করেন ইন্দিরাকে। তিনি বলেন, ‘‘ইলাহাবাদ হাইকোর্ট ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল করে দিয়েছিল। তখন তিনি গদি বাঁচাতে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। এটি ছিল গণতন্ত্রের উপর আঘাত এবং ভোটচুরির দ্বিতীয় নির্লজ্জ উদাহরণ।’’ তাঁর নিশানা থেকে বাদ পড়েননি রাহুলের মা সনিয়াও। শাহ মঙ্গলবূার অভিযোগ করেন, ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার আগেই ভোটার তালিকায় নাম তুলেছিলেন সনিয়া। তিনি বলেন, ‘‘সনিয়া গান্ধী ভারতের নাগরিক হওয়ার আগে কী ভাবে ভোটার হয়েছিলেন? ভোটচুরির এই তৃতীয় উদাহরণটি সম্প্রতি দেওয়ানি আদালতেও গিয়েছে।’’
প্রসঙ্গত, রাহুল মঙ্গলবার লোকসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘কেন সিজেআই (সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি)-কে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হল? আমরা কি তাঁকে বিশ্বাস করি না?’’ সুপ্রিম কোর্টের রায় এড়াতে ২০২৩ সালে আইন বদল করেছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার। নতুন আইন অনুযায়ী, দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং প্রধানমন্ত্রী মনোনীত এক জন মন্ত্রী। কমিটির বৈঠক ডাকবেন প্রধানমন্ত্রী। কমিটির বৈঠকে গৃহীত নাম যাবে রাষ্ট্রপতির কাছে। তিনিই মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করবেন। সেই আইনের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সরব কংগ্রেস।
রাহুলের দাবি, কমিটিতে লোকসভার বিরোধী দলনেতা হিসাবে রয়েছেন তিনি। বাকি দুই সদস্য প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ওই কমিটিতে তিনি একা বিরোধী পক্ষের। ফলে তাঁর মতের গুরুত্ব থাকে না। রাহুলের দ্বিতীয় প্রশ্নও মোদী জমানায় আনা এক আইনকে কেন্দ্র করে। কংগ্রেস নেতা সেই আইনের কথা উল্লেখ করে বলেন, কোনও নির্বাচন কমিশনারকে তাঁদের সরকারি ক্ষমতাবলে গৃহীত পদক্ষেপের জন্য কেন শাস্তি দেওয়া যাবে না? ২০২৩ সালের ওই আইনের ১৬ নম্বর ধারায় নির্বাচন কমিশনারদের নেওয়া সিদ্ধান্তকে ‘সুরক্ষা’ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রে সরকার বদল হলে নির্বাচন কমিশনারদের রক্ষাকবচ বাতিল করা হবে বলেও জানান বিরোধী দলনেতা।
মঙ্গলবার রাহুল অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন নির্বাচনের দিন ক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর সূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ঠিক করছে। কেন এমন করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রায়বরেলীর কংগ্রেস সাংসদ জানান, ভোটার জালিয়াতির অভিযোগ নিয়ে তাঁর উদ্বেগে কমিশন কোনও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ নিয়ে আইনের কথাও উল্লেখ করেন রাহুল। তাঁর প্রশ্ন, কেন আইনে কমিশনকে ৪৫ দিন পর সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করার অনুমতি দেয়? এর প্রয়োজনীয়তা কী? রাহুলের চতুর্থ প্রশ্ন ছিল, এসআইআর পর্বের সময় নির্বাচন কমিশন কেন ‘মেশিন রিডেবল’ ভোটার তালিকা দিচ্ছে না। তাঁর পঞ্চম প্রশ্ন ছিল বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্র (ইভিএম) সম্পর্কে বিরোধীদের তোলা নানা অভিযোগ সম্পর্কে কমিশন ও সরকারের ‘নীরবতা’ নিয়ে। হরিয়ানার ভোটার তালিকায় ব্রাজ়িলের এক মডেলের নামের ২২ বার ‘উপস্থিতি’র অভিযোগও করেছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে, রাহুলের পরিবারকে আক্রমণ করলেও তাঁর তোলা সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলির কোনও জবাব মেলেনি শাহের বক্তৃতায়।