Puja Special 2025

ত্রিধারা সঙ্গম থেকে মাষভক্তবলি, সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোয় মিশে আছে নানা কাহিনি

সাবর্ণ পরিবারের ৮টি বাড়িতেই প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আয়োজিত হয়। এই পরিবারের মাধ্যমেই বাংলায় প্রথম আটচালায় সপরিবারে দেবীর পুজোর প্রচলন শুরু হয়।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০১
The traditional Sabarna Roy Chowdhury Durga Puja of Kolkata is known for its many special aspects

সাবর্ণ পরিবারের দুর্গাপুজোয় চলছে কুমারীপুজো। ছবি: সংগৃহীত।

১৬০৮ সাল। বাদশাহ জাহাঙ্গিরের থেকে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি পেলেন সাবর্ণ পরিবারের ২২তম পুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিই ১৬১০ সালে পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু করেন। ৪১৬ বছর ধরে চলে আসা এই পুজোর একাধিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

Advertisement

তারও আগে বাংলায় যে দু’-চারটি দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়, সেখানে দেবী দুর্গা একক চণ্ডীরূপে পূজিতা হতেন। কিন্তু সাবর্ণ পরিবারের মাধ্যমে প্রথম আটচালায় সপরিবার মায়ের আরাধনার সূত্রপাত ঘটে। অর্থাৎ, যেখানে দুর্গামূর্তির পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ এবং কার্তিকের অবস্থান। তবে প্রজাদের আনন্দ বর্ধনের জন্য আদি নিবাস হালিশহরের পাট চুকিয়ে বড়িশার বর্ধিষ্ণু অঞ্চলেই রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো শুরু হয়।

১৬৬০ সালে বিদ্যাধর রায়চৌধুরীর হাত ধরে পরিবারের পুজোয় 'ত্রিধারা সঙ্গম' ঘটে। অর্থাৎ শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব— এই তিন মতের মিশ্রণ ঘটে পুজাপদ্ধতিতে। এখনও কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ অনুসারে পরিবারে দুর্গাপুজো হয়। কলকাতা শহরে সাবর্ণ পরিবারের ৮টি শরিকি বাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে বড়িশাতেই রয়েছে ৬টি (আটচালা, বড় বাড়ি, মেজো বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেণাকি বাড়ি এবং কালীকিঙ্কর ভবন) বাড়ি। অন্য দু’টি হল বিরাটি রায়চৌধুরী বাড়ি এবং নিমতা-পাঠানপুর বাড়ি। উল্লেখ্য, সব ক’টি বাড়িতেই দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়।

The traditional Sabarna Roy Chowdhury Durga Puja of Kolkata is known for its many special aspects

সার্বণ রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো ৪০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। ছবি: সংগৃহীত।

সাবর্ণ পরিবারের প্রতিমার মুখমণ্ডল এখনও প্রাচীন রীতি মেনে পানপাতার আকারের। মায়ের গাত্রবর্ণ শিউলি ফুলের বোঁটার রঙের। গণেশের গায়ের বর্ণ লাল। বাংলায় এক সময় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কার্তিকপুজো করতেন না। কার্তিক মূলত পূজিত হতেন সমাজের নিম্নবর্ণের দ্বারা। সাবর্ণ পরিবারের সূত্রে কার্তিকের রূপ হল রাজকীয়। পরিবারের তরফে দেবর্ষি রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘পারিবারিক বিশ্বাস, লক্ষ্মীকান্তকে কল্পনা করেই ১৬১০ সালে কার্তিকের রূপ বদলে যায়।’’ দেবীর চালচিত্রটি তিন ভাগে বিভক্ত এবং সেখানে দশমহাবিদ্যার ছবি আঁকা হয়। এক দিকে রামচন্দ্র এবং অন্য দিকে মহাদেবের অবস্থান।

আটচালা বাড়িতে দেবীর বোধন হয়, কৃষ্ণা নবমী কল্পে এবং অন্য বাড়িগুলিতে হয় ষষ্ঠাদি কল্পে। আটটি বাড়ির মধ্যে সাতটি বাড়িতে পুজোয় দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয়। একমাত্র নিমতা-পাঠানপুর বাড়িতে ভোগ হয় নিরামিষ। বড় বাড়ির পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব, সপ্তমীতে অর্ধরাত্রি বিহিত পুজো। অর্থাৎ দেবী দুর্গা পূজিতা হন চামুণ্ডারূপে।

The traditional Sabarna Roy Chowdhury Durga Puja of Kolkata is known for its many special aspects

বিরাটির বাড়িতে ধুনো পোড়ায় অংশ নেন পরিবারের সদস্যেরা। ছবি: সংগৃহীত।

এ ছাড়াও সাবর্ণ পরিবারের দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য— মাষভক্তবলি। দেবর্ষি জানালেন, মূলত অপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতেই এই বিশেষ রীতির প্রচলন। ১৮০টি মাটির খুরিতে মাষকলাই, ঘি এবং দই দিয়ে অষ্টমী এবং নবমীর দিন এই পুজো করা হয়। বিরাটি এবং বড়িশা বড় বাড়িতে প্রতি বছর নবমীর দিন কুমারীপুজো হয়। সাবর্ণ পরিবারে বহু বছর আগেই পশুবলি নিষিদ্ধ হয়েছে। তবে পুজোর অঙ্গ হিসেবে এখন আখ এবং চালকুমড়ো বলি প্রচলিত। পুজোর দিনে বিরাটি বাড়িতে ধুনো পোড়ায় অংশ নেন পরিবারের সদস্যেরা।

আজ থেকে কয়েক দশক আগে কলকাতা শহরের বহু বাড়ি থেকে দুর্গাপুজো উপলক্ষে বিশেষ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হত। সময়ের সঙ্গে সেই রীতি লুপ্তপ্রায় হয়ে গেলেও, সাবর্ণ পরিবারে এই ধারা আজও বর্তমান। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রতি বছর সাবর্ণ সংগ্রহশালার তরফে প্রকাশিত হয় পারিবারিক মুখপত্র ‘সাবর্ণ বার্তা’।

Advertisement
আরও পড়ুন