শীত মানে পিঠেপুলি, খেজুর গুড়, ক্রিসমাস কেকের পাশে এখন জায়গা করে নিয়েছে কাঠকয়লার আঁচে বারবিকিউ-ও। শীতশহরে বাঙালি বাড়িতে সাহেবি কায়দায় বারবিকিউ ঘিরে জমে ওঠে ওপেন টেরেস বা গার্ডেন পার্টি। বাগানের এক কোণে বা ছাদে বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেঁকা মাংস খাওয়ার সঙ্গী হয় নিভু কাঠকয়লার ওম।
উৎস-সন্ধানে
তবে বারবিকিউ বলে গালভরা সাহেবি নাম যতই দেওয়া হোক না কেন, আগুনে সেঁকা মাংস খাওয়ার চল যুগ যুগ ধরে নানা দেশে চলে আসছে। আমেরিকা, ফ্রান্সের স্থানীয়রা যেমন পর্ক রিব, বাট, চিকেন থাইয়ের মতো অংশ বেছে নিতেন বারবিকিউয়ের জন্য, আফগান-মোগল হেঁশেলেও শিকে গাঁথা মাংস কাঠকয়লার আঁচে অবগাহন করে বেরিয়ে আসত কাবাব রূপে। জাপানে ইয়াকিতোরিও তৈরি হয় আঁচ পোহাতে পোহাতে। একই পদ্ধতি আবার আফ্রিকায় ব্রাই নামে পরিচিত। আগুনে সেঁকা মাছ, মাংস, আনাজপাতি খাওয়া মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। আগুন আবিষ্কারের পর থেকে মাংস যেখানে সরাসরি আগুনে ঝলসে খাওয়া হত, বারবিকিউ পদ্ধতিতে সেখানে সম্বল নিভু আঁচে স্লো কুকিং।
এই বারবিকিউ শব্দের উল্লেখ অবশ্য খুব পুরনো নয়। সম্প্রতি নভোটেল হোটেলে আয়োজন করা হয়েছিল পুলসাইড বারবিকিউয়ের। হোটেলের এগজ়িকিউটিভ শেফ বিক্রম জয়সওয়াল বললেন, “ক্যারিবিয়ান শব্দ বারবাকোয়া থেকে ‘বারবিকিউ’ শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়। সেখানকার আদিবাসী উপজাতিরা নিভু আঁচে কাঠের কাঠামোর উপরে ধীরে ধীরে মাংস রান্না করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করত। ক্রমশ বাণিজ্য করতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত যত বেড়েছে, বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে এই পদ্ধতি।” যেহেতু আগুনে সেঁকে মাছ, মাংস খাওয়া মানুষের আদিম অভ্যাস, তাই এই ধরনের রন্ধনপ্রণালীর উল্লেখ প্রায় সব দেশের ইতিহাসেই মেলে। বিক্রমের কথায়, “আমেরিকায় বারবিকিউয়ের ইতিহাস অনেক দিনের, বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলে, যেখানে শক্ত কাঠ দিয়ে ধীরে ধীরে স্মোক তৈরি করে রান্না করা হত। একই ভাবে এশিয়া জুড়ে তন্দুর, গ্রিলের জনপ্রিয়তাও কম দিনের নয়।” পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতেও তখন স্কিউয়ারে গেঁথে অনেকটা একই কায়দায় মাংস ঝলসে খাওয়ার চল শুরু হয়ে গিয়েছে, যা তখন কেবাব বা কাবাব নামে পরিচিতি পাচ্ছে। পশ্চিম এশিয়ার খাবারে যেমন এই সেঁকা মাংসের হদিস পাওয়া যায়, তেমন আমাদের দেশে এই পদ্ধতি আরও প্রাচীন। হরপ্পা সভ্যতার সময়েও এমন পদ্ধতিতে রান্নার উল্লেখ মেলে।
দেশ-বিদেশে
এ দেশে কাবাবের জনপ্রিয়তা বাড়ে তন্দুর আসার পর থেকে। তবে স্থানভেদে সেই পদ্ধতিও পাল্টে পাল্টে গিয়েছে। যেমন কাশ্মীরে শিক তুজ বা শিক তুজি বেশি জনপ্রিয়। বারবিকিউয়ে যেখানে মাংসে মশলা মাখিয়ে শিকে গেঁথে ফেলা হয়, কাশ্মীরে আগের রাত থেকে মাংস ম্যারিনেট করে রাখা হয়। আর তা সেঁকা হয় শুকনো পাতা আর ঘুঁটের আঁচে। এখানে তন্দুরে নয় বরং সিগরি কায়দায় গ্রিল করে তৈরি হচ্ছে কাবাব, যা অনেকটা আফ্রিকান ব্রাইয়ের মতো। অনেকে মনে করেন, ব্রাই থেকেই বারবিকিউয়ের ধারণা এসেছে। এ নিয়ে নানা মত থাকলেও দেশ-বিদেশে মাংস সেঁকার পদ্ধতি কমবেশি প্রায় একই। তবে বারবিকিউয়ের সঙ্গে কাবাবের সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে রন্ধনপ্রণালীতে। বারবিকিউ সাধারণত হয় ঢিমে আঁচে, অনেকক্ষণ ধরে। সেখানে কাবাবে সরাসরি তন্দুরের মধ্যে বেশি আঁচে রান্না হয়। ফলে বাইরে পোড়া ভাব থাকে। বারবিকিউয়ের ক্ষেত্রে যেহেতু রন্ধনপ্রণালী দীর্ঘায়িত তাই স্মোকি ফ্লেভার ভাল আসে।
কোন কাঠের আগুন দেওয়া হচ্ছে, সেটাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার উপরে নির্ভর করে সেঁকা মাংসের স্বাদ-গন্ধ। শেফ বিক্রম বললেন, “বারবিকিউ প্রক্রিয়ায় সাধারণত হিকরি, ওক জাতীয় কাঠ ব্যবহার করা হয়। যেহেতু এগুলো শক্ত ও স্মোকি ফ্লেভার ভাল আসে। তবে মিষ্টি সুবাসের জন্য অনেকে আপেল এবং চেরি কাঠও ব্যবহার করে থাকেন।” এ দেশে অবশ্য বাজারলব্ধ কাঠকয়লাই ভরসা। তবে পাহাড়ি অঞ্চলে আপেল কাঠ ব্যবহার করেন স্থানীয়রা।
বারবিকিউয়ে মাছ, মাংস, আনাজের কাটও আলাদা হবে। পর্ক, ল্যাম বা চিকেন... ধরন অনুযায়ী কোন অংশের মাংসে ভাল বারবিকিউ হয়, তা নির্ভর করে। যেমন পর্ক রিব, ল্যাম রিব-লয়েন, চিকেন থাই ইত্যাদি। ভুট্টা হলে তা গোল গোল করে কেটে দিলে ভাল হয়। গাজর, ক্যাপসিকাম, টম্যাটো, পনিরও বারবিকিউ করে খাওয়া হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে আনাজপাতি বা মাছ, মাংস যা-ই রাঁধুন না কেন, সেটা যেন ঠিকমতো রান্না করা হয়। বাড়িতে বারবিকিউ করলে অনেক সময়ে সুসিদ্ধ হওয়ার আগেই নামিয়ে ফেলেন অনেকে। কিন্তু পর্ক বারবিকিউ করার সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। যথেষ্ট সময় নিয়ে রান্না করতে হবে।
বাড়িতে ব্যবস্থা করলে
এ বার শীতে উষ্ণতার পারদ বাড়াতে বাড়িতেই আয়োজন করে নিতে পারেন বারবিকিউয়ের। একটা সন্ধে কেটে যাবে নিভু আঁচের ওম নিতে নিতে গল্প-গুজবে।