জ়োহরান মামদানি। নিউ ইয়র্কের মেয়র হতে চলেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ডেমোক্র্যাটিক নেতা। ৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৪ বছর বয়সি মামদানি নির্বাচিত হয়েছেন মেয়র পদে। আমেরিকার রাজনীতিতে বামঘেঁষা ডেমোক্র্যাট বলে পরিচিত এই তরুণ রাজনীতিবিদ।
মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জয়লাভ করে ইতিহাস রচনা করেছেন মামদানি। ১০০ বছরের ব্যবধানে সর্বকনিষ্ঠ মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। মেয়রের কুর্সি দখল করলে আমেরিকার ইতিহাসে মামদানি হবেন প্রথম মুসলিম মেয়র। ১০ লক্ষ ৩৬ হাজার ৫১টি ভোট পেয়েছেন এই ‘কমিউনিস্ট’ প্রার্থী।
মা মীরা নায়ার চলচ্চিত্র পরিচালক। বাবা শিক্ষাবিদ ও খ্যাতনামী লেখক মাহমুদ মামদানি। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহমুদ । ১৯৯১ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডার কাম্পালায় জ়োহরান মামদানির জন্ম হলেও পরে বাবা-মার সঙ্গে আমেরিকায় চলে আসেন। ১৯৯৮ সালে সাত বছর বয়সে নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাস শুরু করেন তিনি।
২০২০ সালে প্রথম বারের মতো নিউ ইয়র্ক অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন মামদানি। কুইন্সের একটি জেলার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন সেই বছর। গত অক্টোবরে যখন মামদানি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন প্রাদেশিক আইন প্রণেতা। নিউ ইয়র্কের বেশির ভাগ বাসিন্দার কাছেই অপরিচিত ছিলেন।
জুন মাসে প্রাইমারি নির্বাচনে নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন গভর্নর তথা এ বারের নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে বিপুল ভোটে হারিয়ে হঠাৎই সংবাদের শিরোনামে চলে আসেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থী। নির্বাচনী প্রচারে মামদানি ঘোষণা করেন, নির্বাচিত হলে তিনি নিয়ন্ত্রিত ভাড়ার অ্যাপার্টমেন্টগুলির ভাড়াবৃদ্ধি স্থগিত করবেন।
আগামী ১০ বছরে নিউ ইয়র্কে দু’লক্ষ ‘সাশ্রয়ী’ বাসস্থান নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন মামদানি। শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী মামদানির নির্বাচনী প্রতিশ্রতি তরুণ ভোটারদের কাছে সাড়া ফেলেছিল।
ডেমোক্র্যাটিক শিবিরের প্রার্থী হওয়ার কথা ঘোষণা করতেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশানা করেন মামদানিকে। তাঁর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে সুর চড়িয়ে গিয়েছেন ট্রাম্প। ‘কমিউনিস্ট’ প্রার্থী মামদানিকে ভোটে জেতালে নিউ ইয়র্ক সিটির সরকারি অনুদান বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিয়েছিলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের সেই হুঁশিয়ারি অবশ্য কানে তোলেননি নিউ ইয়র্কবাসী। নিউ ইয়র্ক থেকে মামদানির বিপরীতে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন কুর্টিস স্লিওয়া। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মামদানির ধারেকাছে আসতে পারেননি তিনি। ১০ শতাংশেরও কম ভোট জমা পড়েছে তাঁর ঝুলিতে।
মামদানি জিতলে, ‘সঠিক রাস্তায় না এলে’ এবং আইন বাধা না দিলে নিউ ইয়র্কের যুক্তরাষ্ট্রীয় অনুদান বন্ধ করার হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মামদানি বলেছিলেন, “ট্রাম্প বুঝে গিয়েছেন, নিউ ইয়র্কবাসীও এ বার পরিবর্তন চাইছেন। এই হুমকি শুধু আমার বিরুদ্ধে নয়, বরং নিউ ইয়র্কের মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার এক প্রচেষ্টা।”
মামদানির সমালোচনা করতে গিয়ে প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা তাঁর ধর্মীয় পরিচয় সামনে এনেছেন বলেও দাবি করেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মেয়র পদপ্রার্থী। যদিও সেই সব সমালোচনায় বিচলিত হননি কখনও। উল্টে বিরোধীদের এই সব সমালোচনাকে বর্ণবিদ্বেষী এবং ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন মামদানি।
মামদানির কাছে বৈধ নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও মাত্র সাত বছরের নাগরিকত্ব নিয়ে বার বার প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। প্যালেস্টাইনের অধিকার নিয়ে বার বার সরব হওয়া নিয়েও আক্রমণ শানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-সহ রিপাবলিকানেরা।
মেয়র নির্বাচনে তাঁর দলের শোচনীয় পরাজয়ের পর মুখ খুলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রম্প। নির্বাচনী সমীক্ষক সংস্থা পোলস্টারের এক সমীক্ষার উদাহরণ তুলে সমাজমাধ্যমে হারের কারণ ব্যাখ্যা করেন ট্রাম্প। তিনি জানান, তাঁদের প্রার্থীর পরাজয় ঘটেছে কারণ ট্রাম্প নিজে এই ভোটে প্রার্থী ছিলেন না। দ্বিতীয় কারণ আমেরিকার ‘শাটডাউন’ (প্রশাসনিক অচলাবস্থা)। ট্রাম্পের দাবি, এই দুই কারণে তাঁর দল আঞ্চলিক নির্বাচনে জিততে পারেনি।
রাজধানী কাম্পালার উপকণ্ঠের এক অভিজাত এলাকা বুজিগা হিলে প্রাসাদোপম বাড়ি মামদানি পরিবারের। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে কিছু দিন বসবাস করেছিল এই পরিবার। উগান্ডার কিছু দিন থাকার পর তাঁরা আমেরিকায় পাকাপাকি ভাবে চলে আসেন। কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর পর ২০১৮ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন মামদানি।
ব্রঙ্কস হাই স্কুল অফ সায়েন্সে পড়াশোনা মামদানির। ২০১৪ সালে মেইনের বোডোইন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। আফ্রিকা সংক্রান্ত পড়াশোনায় স্নাতক মামদানি।
নিউ ইয়র্কের হবু মেয়র সাত পাকে বাঁধা পড়েছেন চিত্রশিল্পী রমা দুয়াজির সঙ্গে। দুবাইয়ে আংটিবদল সেরে ফেলেছিলেন গত ডিসেম্বরে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিউ ইয়র্কে আইনি বিয়ে সারেন তাঁরা। চলতি বছরের জুলাই মাসে উগান্ডায় পরিবারিক নিবাসেই জাঁকজমকের সঙ্গে অনু্ষ্ঠিত হয়েছে মামদানি ও চিত্রশিল্পী রমা দুয়াজির বিবাহ অনুষ্ঠান।
ফলাফল ঘোষণার পর বিজয়সভায় যোগ দিয়েছিলেন জ়োহরান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী রামা এবং বাবা-মা মাহমুদ মামদানি ও মীরা নায়ার। নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের ধারণা ছিল মামদানির মতো এক জন ‘নির্ভেজাল কমিউনিস্ট’ জিতে যাবেন, এটা ‘অকল্পনীয়’। সেই অকল্পনীয় বিষয়ই এখন ঘোর বাস্তব। তা প্রমাণ করে দিয়েছেন তরুণ রাজনীতিক জ়োহরান মামদানি।
সব ছবি: রয়টার্স।