বিতর্ক ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। একাধিক বার বিয়ে করেছেন। ঘনিষ্ঠ ভিডিয়োও প্রকাশ্যে এসেছিল। কিন্তু নিষ্ঠাবান ছিলেন পেশাদার কুস্তির প্রতি। পেশাদার কুস্তিকে কোটি কোটি ডলারের বিনোদনশিল্পে রূপান্তরিত করার নেপথ্যেও হাত ছিল তাঁর। ৭১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন জনপ্রিয় সেই ডব্লিউডব্লিউই তারকা হাল্ক হোগান।
জানা গিয়েছে, ফ্লরিডার বাড়িতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় হোগানের। তাঁর পরিবারের লোকেরা ৯১১ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু জরুরি পরিষেবাও প্রাণ বাঁচাতে পারেনি তাঁর।
বিগত কয়েক মাস ধরে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন হোগান। বেশ কয়েক বার অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। এ-ও রটেছিল যে, অস্ত্রোপচারের পর কোমায় চলে গিয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সেই খবর গুজব বলে উড়িয়ে দেন। তার পরেই ডব্লিউডব্লিউই তারকার মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে এল।
টিএমজ়েড স্পোর্টসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর বৃহস্পতিবার ভোরে ফ্লরিডার ক্লিয়ারওয়াটারে হোগানের বাসভবনে জরুরি চিকিৎসা পরিষেবা পাঠানো হয়েছিল। তাঁর বাড়ির বাইরে পুলিশও জড়ো হয়েছিল। এর পর হোগানকে স্ট্রেচারে করে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হয়।
হোগানের মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করে ইতিমধ্যেই বিবৃতি জারি করেছেন ডব্লিউডব্লিউই কর্তৃপক্ষ। ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ডব্লিউডব্লিউই ‘হল অফ ফেম’ খ্যাত হাল্ক হোগানের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। হোগান পপ সংস্কৃতির সবচেয়ে স্বীকৃত ব্যক্তিত্বদের একজন। ১৯৮০-এর দশকে ডব্লিউডব্লিউই-কে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জনে সহায়তা করেছিলেন তিনি। হোগানের পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং অনুরাগীদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে ডব্লিউডব্লিউই।’’
হোগানের আসল নাম টেরি জিন বোলিয়া। ১৯৫৩ সালের ১১ আগস্ট জর্জিয়ার অগাস্টায় তাঁর জন্ম। বেড়ে ওঠেন ফ্লরিডার টাম্পায়। প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় রক ব্যান্ডের একজন বেস গিটারবাদক হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন তিনি।
৬ ফুট ৭ ইঞ্চির হোগান ১৯৭০-এর দশকে ফ্লরিডার কুস্তিগিরদের দেখে আকৃষ্ট হয়ে নিজেও সেই দলে ভিড়ে যান। কুস্তিগির হিসাবে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন।
কুস্তিগির হিসাবে খুব কম সময়েই জনপ্রিয়তা পান হোগান। দেশ-বিদেশে কুস্তি লড়ার জন্য ডাক পেতেও শুরু করেন। বৃদ্ধি পেতে থাকে অনুরাগীর সংখ্যা। মার্ভেলের কমিকস চরিত্রের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়ে অনুরাগীরাই তাঁর নাম দেন ‘হাল্ক’।
তাঁকে ‘হোগান’ উপাধি দিয়েছিলেন ডব্লিউডব্লিউএফ (ওয়ার্ল্ড রেসলিং ফেডারেশন, পরে এরই নাম হয় ডব্লিউডব্লিউই)-এর প্রবর্তক ভিনসেন্ট জে ম্যাকমহন। ৮০ এবং ৯০-এর দশকে বৈগ্রহিক কুস্তিগির হয়ে উঠেছিলেন হোগান। পেশাদার কুস্তিগিরদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় মুখ হয়েও উঠেছিলেন। তাঁর লড়াই দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন তাঁর অনুরাগীরা।
ডব্লিউডব্লিউএফ-কে জনপ্রিয় করার নেপথ্যে বড় ভূমিকা ছিল হোগানের। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে পেশাদার কুস্তিতে সবচেয়ে বড় তারকা ছিলেন তিনি।
হোগানের অবতারও বাকিদের থেকে আলাদা ছিল। তাঁর চওড়া গোঁফ ও পেশিবহুল শরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করত। কুস্তি জেতার পর উদ্যাপন করতে পরনের গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলতেন তিনি।
প্রথম ন’বারের রেসলমেনিয়ায় আট বারই তিনি ছিলেন প্রধান আকর্ষণ। ছ’বারের ডব্লিউডব্লিউই চ্যাম্পিয়ন হোগান তাঁর বাচনভঙ্গির জন্যও জনপ্রিয় ছিলেন।
স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের প্রচ্ছদেও মুখ দেখা গিয়েছিল হোগানের, যা সেই সময়ের এক জন কুস্তিগিরের জন্য বিরল কীর্তি। মিস্টার টি এবং সিন্ডি লাউপারের মতো পপ তারকাদের সঙ্গেও ওঠাবসা ছিল হোগানের।
পেশাদার কুস্তির পাশাপাশি হলিউডের ছবিতে অভিনয়ও করেছেন তিনি। তখন তিনি নিজের নামের সঙ্গে ‘হলিউড’ কথাটা জুড়ে দেন। অর্থাৎ, তাঁকে ডাকা হত হলিউড হাল্ক হোগান নামে।
‘সাবারবান কমান্ডো’ এবং ‘মিস্টার ন্যানি’-সহ বহু সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন হোগান। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ‘হোগান নোজ় বেস্ট’ নামের একটি রিয়্যালিটি শো পরিচালনা করেছিলেন। সেই শোয়ে হোগান, তাঁর তৎকালীন স্ত্রী লিন্ডা এবং দুই সন্তানকে নিয়ে কুস্তিগিরের পারিবারিক জীবন তুলে ধরা হয়েছিল।
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রকি-৩’ ছবিতে থান্ডারলিপস চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন হোগান। সেই ছবিতে তাঁর জনপ্রিয়তা সিলভাস্টার স্ট্যালোনকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল।
এর মাঝেই ১৯৯৬ সালে ডব্লিউডব্লিউই ছেড়ে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নামের নতুন পেশাদার কুস্তি শুরু করেন তিনি। ফলে ডব্লিউডব্লিউই-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যান হোগান। তার পরেও ২০০৫ সালে তাঁকে ডব্লিউডব্লিউই ‘হল অফ ফেম’ দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে তাঁর একটি ঘনিষ্ঠ ভিডিয়ো প্রকাশ পাওয়ায় তাঁর ‘হল অফ ফেম’ কেড়ে নেওয়া হয়। যে সংস্থা তাঁর ভিডিয়ো প্রকাশ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন হোগান। তিনি মামলা জেতেন। ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে সেই সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যায়।
পরে ২০২০ সালে আবার হোগানকে ‘হল অফ ফেম’ দেয় ডব্লিউডব্লিউই। সারা জীবন বিতর্ক সঙ্গী থেকেছে হোগানের। আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক ছিলেন হোগান। ট্রাম্পের সমর্থনে বেশ কয়েকটা সভাও করেছিলেন তিনি।
জীবনে তিন বার বিয়ে করেছেন হোগান। তাঁর দুই সন্তান— এক পুত্র এবং এক কন্যা। একাধিক বার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ারও অভিযোগ উঠেছিল হোগানের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন এক বর্ণময় চরিত্র। ৭১ বছর বয়সে মৃত্যু হল তাঁর।
ছবি: সংগৃহীত।