হিমালয়ের উপত্যকা মানে তুষারশৃঙ্গের অপরূপ দৃশ্য। নির্মেঘ আকাশে হেলান দিয়ে থাকা তুষারাবৃত শৃঙ্গের দোসর বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য, চোখজুড়োনো অর্কিড ও ফুল, নানা রঙের পাখি, গা ছমছমে অরণ্য। সব মিলিয়ে পাহাড়ি সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন পর্যটকেরা।
অপার সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি অঞ্চলে মরসুম বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় উপত্যকার রূপ। সাধারণত বরফের চাদর সরে গেলে উপত্যকার কিছু কিছু অংশে মাথা দোলায় রংবেরঙের ফুল। উপত্যকা জুড়ে মাথা দোলায় রকমারি ফুলের দল। তবে এই বছর সেই ফুলের জলসায় নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুটা আগেই আগমন ঘটেছে এক অদ্ভুত প্রজাতির ফুলের।
সুদীর্ঘ তিন দশকের অপেক্ষার অবসান। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় হিমালয়ের সুউচ্চ এলাকায় সগর্বে মাথা উঁচিয়ে জেগে উঠছে ‘সিকিম সুন্দরী’। সিকিমের সুন্দরী বলে পরিচিত হলেও এর দেখা মেলে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের কিছু এলাকা, নেপাল, ভুটান এবং তিব্বত হয়ে মায়ানমার পর্যন্ত।
৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মিটার উচ্চতায় ফোটে ফুলটি। পোশাকি নাম ‘সিকিম সুন্দরী’ হলেও বৈজ্ঞানিক নাম রিউম নোবাইল। ফুলটি দেখতে শঙ্কুর মতো। দেখতে অনেকটা আকর্ষণীয় কোনও প্যাগোডার মতো। স্বচ্ছ আবরণ দিয়ে ঘেরা থাকে ফুলটি।
স্থানীয়েরা এটিকে চেনেন চুকা নামে। পাহাড়ের ধাপে ধাপে ফুটে ওঠা ফুলটিকে দেখলে মনে হবে কাচের স্বচ্ছ টাওয়ার, মাথা উঁচু করে জেগে রয়েছে। গাছটি প্রায় দুই মিটার লম্বা হয়ে একটি সুউচ্চ প্যাগোডার মতো কাঠামো তৈরি করে।
৩০ বছর বাদে ফুলটি ফুটে ওঠার পর সিকিমের একটি অংশের ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন শিল্পপতি ও মাহিন্দ্রা গ্রুপের চেয়ারম্যান আনন্দ মাহিন্দ্রা। ফুলটিকে প্রকৃতির সবচেয়ে অসাধারণ সৃষ্টিগুলির মধ্যে একটি বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এমনকি ছোটবেলার জীববিজ্ঞানের কোনও পাঠ্যবইয়ে এর সম্পর্কে কোনও তথ্য পাননি বলেও জানিয়েছেন আনন্দ। বর্তমান ভারতীয় স্কুল পাঠ্যক্রমগুলিতেও এই স্থানীয় কিংবদন্তির উল্লেখ রয়েছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সেই পোস্টে।
এক্সের পোস্টে আনন্দ লিখেছেন, ‘‘এই ‘কাচঘর গাছ’ পাহাড়ের বিপরীতে একটি উজ্জ্বল স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর জীবনধারণ ধৈর্যের এক অসাধারণ উদাহরণ। ৭ থেকে ৩০ বছর নীরবে শক্তি সঞ্চয় করে অবশেষে নিজের জীবনীশক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে।’’
‘ফ্লাওয়ার্স অফ ইন্ডিয়া’র মতো উদ্ভিদ সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের সূত্র অনুসারে, এই উদ্ভিদের স্বচ্ছ, হালকা রঙের ব্র্যাক্টগুলি গোলাপি রঙের প্রান্ত-সহ দুর্গম পাহাড়ের ঢালের বিরুদ্ধে একটি উজ্জ্বল আলোর টাওয়ারের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। মাইলের পর মাইল উপত্যকা জুড়ে এটি দৃশ্যমান।
এটি একটি অসাধারণ প্রজাতির রুবার্ব বা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, যা সাধারণত ঠান্ডা আবহাওয়াতেই জন্মায় এবং বড় হয়। বাইরের পর্দা স্বচ্ছ ব্র্যাক্ট দিয়ে তৈরি। ব্র্যাক্ট হল গাছের পরিবর্তিত পাতা যা ফুলের সঙ্গে যুক্ত থাকে, যেটি ফুলকে আলো জোগায়। এই রূপান্তরিত পাতাগুলি প্রাকৃতিক গ্রিনহাউসের কাজ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করে, তা হল অতিবেগনি রশ্মিকে বাধা দেওয়া।
একই সঙ্গে হিমালয় অঞ্চলের ঠান্ডা বাতাস এবং তীব্র রশ্মি থেকে কোমল ফুলগুলিকে রক্ষা করে। এটি ভিতরে একটি উষ্ণ ‘মাইক্রোক্লাইমেট’ তৈরি করে, যা ওই এলাকার জলবায়ুর থেকে ভিন্ন হয়। নিজস্ব সেই আবহাওয়া উদ্ভিদকে ওই উচ্চতায় প্রাণধারণে ও টিকে থাকতে সাহায্য করে।
ব্র্যাক্টগুলি উপরে তুললে তার মধ্যে ছোট ছোট সবুজ ফুলের শাখাযুক্ত গুচ্ছ নজরে পড়বে। গাছের মূলটি ৩-৭ ফুট লম্বা এবং মানুষের হাতের মতো পুরু। ভিতরের রং উজ্জ্বল হলুদ। কাণ্ডের ফাঁকে প্রচুর পরিমাণে স্বচ্ছ জল থাকে।
ফুল ফোটার পরে কাণ্ডটি লম্বা হতে শুরু করে এবং ব্র্যাক্টগুলি একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। মোটা লাল-বাদামি হয়ে যায়। ফল পাকলে ব্র্যাক্টগুলি পড়ে যায়। পড়ে থাকে গাঢ় বাদামি রঙের ফলের ঝাঁক দিয়ে ঢাকা কাণ্ডটি।
সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, গাছটি ৩০ বছর ধরে পাতা দিয়ে তৈরি ছোট গোলাপের মতো বেঁচে থাকে। হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রা সহ্য করে। সাধারণত জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ‘সিকিম সুন্দরী’র দেহে ফুল ফোটার সময় আগত হয়।
হিমালয়ের সুবিশাল পাহাড়ি উপত্যকায় এক বার ফুল ফোটার এবং বীজ ছড়িয়ে পড়ার পর, গাছটি মারা যায়। চরম পরিবেশে কয়েক দশক ধরে নীরবে বেঁচে থাকার পর গাছটি খুব স্বল্প সময়েই জীবনচক্রের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।
চুকা নামে পরিচিত উদ্ভিদটির টক স্বাদের কাণ্ড ঐতিহ্যবাহী খাবারের পদ হিসাবে খেয়ে থাকেন স্থানীয়েরা। সিকিম সুন্দরীর ৩ থেকে ৭ ফুট উজ্জ্বল হলুদ কাণ্ড ও শিকড় ঐতিহ্যবাহী তিব্বতি ওষুধ তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
‘সিকিম সুন্দরী’র ছবি সমাজমাধ্যমে প্রায়শই শেয়ার করা হয় ‘প্যাগোডা ফুল’ বলে। অনেকেই দাবি করেন, এটি হিমালয়ে প্রতি ৪০০ বছরে এক বার ফোটে। যদিও এই দাবি সর্বৈব মিথ্যা। ‘ফ্লাওয়ার্স অফ ইন্ডিয়া’-সহ আরও বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করে যে মাঝেমাঝেই জুন এবং জুলাই মাসে এই ফুল ফুটতে দেখা যায়।
সব ছবি: সংগৃহীত।