‘অপারেশন সিঁদুর’-এ মার খাওয়া পাকিস্তানের পাশে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন (পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না)। ইসলামাবাদের হাত শক্ত করতে ক্রমাগত হাতিয়ার সরবরাহ করে যাচ্ছে বেজিং। সেই তালিকায় এ বার যুক্ত হল পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ শ্রেণির জে-৩৫ লড়াকু জেট। পাক সেনা সর্বাধিনায়ক বা সিডিএফ (চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্স) ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের হাতে ৪০টি এই যুদ্ধবিমান তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে ড্রাগনের। নতুন বছরের মুখে এই খবরে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে নয়াদিল্লির চিন্তা যে কয়েক গুণ বাড়ল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পাক বিমানবাহিনীর ৪০টি চিনা জে-৩৫ লড়াকু জেট পাওয়ার খবর সম্প্রতি নিশ্চিত করে মার্কিন যুদ্ধ দফতরের (ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার) সদর কার্যালয় পেন্টাগন। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের সঙ্গে সম্পর্কিত সামরিক ও নিরাপত্তা উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা। সেখানেই বেজিং-ইসলামাবাদের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে একাধিক বিস্ফোরক দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রিপোর্ট অনুযায়ী, আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যকে নতুন করে সাজাতে চাইছে ড্রাগন। সেই কারণেই রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মান্দারিনভাষী সরকার।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, চিনা প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ওই রিপোর্ট কিছু দিন আগে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এ পাঠিয়েছিল পেন্টাগন। সেখানে অনুমোদন পায় সংশ্লিষ্ট সরকারি নথি। তাতে ইসলামাবাদের হাত শক্ত করার নেপথ্যে বেজিঙের এই পদক্ষেপকে ‘কৌশলগত’ এবং ‘উচ্চকাঙ্ক্ষী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই সামরিক সরঞ্জামের রফতানির সূচক আরও ঊর্ধ্বমুখী করার চেষ্টা চালাচ্ছেন ড্রাগন প্রেসি়ডেন্ট শি জিনপিং। আর তাই রাওয়ালপিন্ডির বাজারকে পাখির চোখ করেছে তাঁর প্রশাসন।
ভারতীয় বায়ুসেনার বহরে থাকা শক্তিশালী জেটগুলির মধ্যে অন্যতম হল ফরাসি সংস্থা দাসোঁ অ্যাভিয়েশনের তৈরি রাফাল। পেন্টাগনের দাবি, প্যারিস সাড়ে চার প্রজন্মের এই যুদ্ধবিমানের সরবরাহ শুরু করতেই প্রমাদ গোনে ইসলামাবাদ। তড়িঘড়ি চিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পর এ ব্যাপারে শিকে ছেঁড়ে তাদের। জুনে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বেজিঙের থেকে পাওয়া যাচ্ছে বলে সরকারি ভাবে দাবি করে পাকিস্তান। সেই আওয়াজ যে একেবারেই ফাঁকা ছিল না, এ বার তা স্পষ্ট করল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ দফতর।
পেন্টাগনের রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক সরঞ্জাম রফতানিতে বৈচিত্র আনতে তিনটি যুদ্ধবিমান সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিন। সেগুলি হল, পঞ্চম প্রজন্মের এফসি-৩১, সাড়ে চার প্রজন্মের জে-১০সি মাল্টিরোল জেট এবং পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি জেএফ-১৭ থান্ডার হালকা যুদ্ধবিমান। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এফসি-৩১ শ্রেণির যুদ্ধবিমানের উন্নত সংস্করণ তৈরি করে ফেলেছে বেজিং। সেখানেই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে জে-৩৫ সিরিজ়ের পঞ্চম প্রজন্মের জেটের।
২০২০ সালে মোট ৩৬টি জে-১০সি যুদ্ধবিমানের জন্য চিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে পাক সরকার। চলতি বছরের মে পর্যন্ত তার মধ্যে ২০টি ইসলামাবাদের হাতে তুলে দেয় বেজিং। বাকিগুলি ২০২৬ সালের মধ্যে রাওয়ালপিন্ডির বিমানবাহিনীর বহরে যুক্ত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। জে-৩৫ জেটের সরবরাহ অবশ্য কখন থেকে ড্রাগন শুরু করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ, আর্থিক দিক থেকে দেউলিয়া অবস্থায় রয়েছে পাকিস্তান। সেই সীমাবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট রফতানির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে রিপোর্টে জানিয়েছে পেন্টাগন।
মার্কিন যুদ্ধ দফতরের শীর্ষকর্তারা অবশ্য মনে করেন, প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রসার এবং সামরিক সরঞ্জামের রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট শি-র ‘পাকিস্তান প্রেম’-এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কারসাজি। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটনের চাপে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার বিদেশনীতিতে কিছুটা বদল এনেছেন তিনি। সেখানে ইসলামাবাদকে তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে বেজিং। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিল্ড মার্শাল মুনিরের ‘মধুর সম্পর্কে’ ফাটল ধরানোও এর অন্যতম উদ্দেশ্য হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, পাক বিমানবাহিনীকে পঞ্চম শ্রেণির লড়াকু জেট সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে মতাদর্শের বদল ঘটাচ্ছে চিন। কারণ, এত দিন পর্যন্ত এই ধরনের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানগুলিকে জাতীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করছিল জিনপিং প্রশাসন। সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি সরে এসে এগুলিকে ভূ-রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে বেজিং, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থার যাবতীয় হিসাব বদলে দিতে পারে, বলছেন তাঁরা।
চরম আর্থিক সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও চিনের থেকে কেন পঞ্চম প্রজন্মের লড়াকু জেট কিনছে পাকিস্তান? পেন্টাগনের রিপোর্টে তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ একগুচ্ছ যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ায় যথেষ্টই দুর্বল হয়েছে ইসলামাবাদের বায়ুসেনা। সেই ফাঁক দ্রুত বুজিয়ে ফেলতে চাইছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। আর তাই জে-১০সির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জে-৩৫কে বিমানবাহিনীর বহরে শামিল করতে ঝাঁপিয়েছেন তিনি।
জে-৩৫এ-র নির্মাণকারী সংস্থা হল চিনের ‘শেনইয়াং এয়ারক্রাফ্ট কর্পোরেশন’। সূত্রের খবর, পঞ্চম প্রজন্মের এই লড়াকু জেটকে ওড়ানো এবং যুদ্ধকৌশল জানতে গত জুনে বেজিঙে যান পাক বায়ুসেনার একগুচ্ছ অফিসার। সেখানে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ড্রাগনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বিমানবাহিনী। প্রশিক্ষণ শেষে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানগুলি নিয়ে ইসলামাবাদে ফেরার কথা রয়েছে তাঁদের।
দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ‘স্টেলথ’ শ্রেণির জে-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রথম বার আকাশে ওড়ে ২০১২ সালে। যে কোনও পরিবেশে সমান দক্ষতায় হামলা চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এই লড়াকু জেটের। ‘স্টেলথ’ শ্রেণির হওয়ায় সহজে এটি শত্রুর রাডারের নাগালে আসবে না। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এর জে-৩৫এ ভ্যারিয়েন্টটি তৈরি করে ‘শেনইয়াং’। পাকিস্তানই প্রথম দেশ, যাকে এই যুদ্ধবিমান রফতানি করছে বেজিং।
পিএলএ বায়ুসেনার পাশাপাশি জে-৩৫এ যুদ্ধবিমানটি চিনা নৌবাহিনীরও ব্যবহার করার কথা রয়েছে। বেজিং হামেশাই সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটিকে পঞ্চম প্রজন্মের মার্কিন ‘স্টেলথ’ যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ লাইটনিং টু-র সঙ্গে তুলনা করে থাকে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এর কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি ড্রাগনের এই জে-৩৫এ। অন্য দিকে, লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ভালই রয়েছে আমেরিকার এফ-৩৫ লাইটনিং টু-র।
জে-৩৫ লড়াকু জেট দ্রুত হাতে পেতে এ বছরের মে মাসে বেজিং সফরে যান পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ। সেখানে দ্বিপাক্ষিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতার উপর জোর দেন তিনি। চিনা সরকারের পদক্ষেপকে ‘পুরস্কার’ হিসাবে উল্লেখ করেছে ইসলামাবাদ। কারণ, ভারতের হাতে বর্তমানে কোনও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান নেই।
গত বছরের (২০২৪ সালের) ডিসেম্বর মাসে জে-৩৫ লড়াকু জেট কেনার ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দেয় পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের প্রশাসন। তবে ওই সময় যুদ্ধবিমানগুলি ২০২৭ সালের আগে পাক বায়ুসেনার বহরে শামিল হবে না বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘর্ষে ভারতীয় সেনার হাতে মার খাওয়ার পর দ্রুত বদলে যায় পরিস্থিতি। তড়িঘড়ি লড়াকু জেটগুলি বহরে শামিল করতে বেজিং ছোটেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ ও সেনা অফিসারেরা।
খোয়াজা আসিফের বেজিং সফরের মধ্যে জে-৩৫ লড়াকু জেট নিয়ে প্রকাশ্যে আসে একটি বিস্ফোরক তথ্য। জানা যায়, যুদ্ধবিমানগুলির দামে ইসলামাবাদকে ৫০ শতাংশ ছাড় দিতে রাজি হয়েছে জিনপিং সরকার। এর পরই প্রেসিডেন্ট শি-র ওই সিদ্ধান্ত ঘিরে সমাজমাধ্যমে ওঠে ঝড়। সমালোচনা করেন সাধারণ মান্দারিনভাষীরাও।
শি সরকারের কাছে চিনা নেটাগরিকদের প্রশ্ন, কেন হঠাৎ পাকিস্তানকে সস্তা দরে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেলথ’ শ্রেণির যুদ্ধবিমান বিক্রি করা হচ্ছে? এতে যে আর্থিক লোকসান হবে, সেই অর্থ কী ভাবে বা কোথা থেকে জোগাড় করবে বেজিং? তাঁদের আশঙ্কা, লড়াকু জেটের বাকি টাকা মেটাতে হবে ড্রাগনভূমির সাধারণ খেটে খাওয়া বাসিন্দা ও করদাতাদের। আর তাই জিনপিং প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি রয়েছে তাঁদের।
সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী মান্দারিনভাষীদের দাবি, সংশ্লিষ্ট জে-৩৫ লড়াকু জেটটির নাকি ঠিকমতো পরীক্ষাই হয়নি। তাই একে এখনও বহরে শামিল করেনি চিনের পিএলএ-র বিমানবাহিনী। ফলে নিয়ম অনুযায়ী এই যুদ্ধবিমান বিদেশে রফতানি করার কথা নয়। কিন্তু, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি ইসলামাবাদকে তা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেজিং। ফলে এখানে কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতির গন্ধ পাচ্ছেন ড্রাগনভূমির নেটাগরিকেরা।
এই আবহে প্রকাশ্যে আসে আরও একটি বিতর্ক। চিনা সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, বেজিংকে এখনও পর্যন্ত জে-১০সি লড়াকু জেটের পুরো দাম চোকায়নি পাক সরকার। বকেয়া অর্থ ইসলামাবাদ কবে দেবে বা আদৌ দেবে কি না, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তার পরও কিসের ভরসায় রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের পঞ্চম প্রজন্মের জে-৩৫ যুদ্ধবিমান সরবরাহ করা হচ্ছে? প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ৫০ শতাংশ ছাড়ে পাকিস্তানকে জে-৩৫এ বিক্রির সিদ্ধান্ত বেজিঙের জন্য বুমেরাং হতে পারে। কারণ, এর জেরে আগামী দিনে অন্য দেশগুলিও সস্তায় পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কিনতে চাইবে। সেই দাবি মানলে আর্থিক লোকসান হবে লড়াকু জেটটির নির্মাণকারী সংস্থার। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাজারে নিজের অবস্থান খারাপ হতে পারে জিনপিং সরকারের।
দীর্ঘ দিন ধরেই লড়াকু জেটের স্বল্পতায় ভুগছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। এই অবস্থায় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি যুদ্ধবিমান নির্মাণের উপর জোর দিয়েছে নয়াদিল্লি। যদিও জেট ইঞ্জিন তৈরিতে সে ভাবে সাফল্য পাননি এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ফলে দ্রুত আমেরিকা বা রাশিয়া থেকে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে চুক্তি করতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। সেই দৌড়ে এখনও মস্কোর এসইউ-৫৭ এগিয়ে রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।