মার্কিন অর্থনীতিতে ‘স্বর্ণযুগ’-এর প্রত্যাবর্তন! তাঁর নীতির জোরেই নাকি ফিরেছে সেই সোনালি সময়। বর্ষশেষে এই ইস্যুতে প্রচারের ঝড় তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সরকারি তথ্য তুলে ধরে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দেন তিনি। আর সঙ্গে সঙ্গেই এ ব্যাপারে ঢাক পেটানো শুরু করে দিয়েছে তাঁর স্তাবককুল। যদিও প্রদীপের নীচটা যথেষ্টই অন্ধকারে ভরা, বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
গত ২৩ ডিসেম্বর মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বৃদ্ধির হার প্রকাশ করে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ। সেখানে বলা হয়েছে, এ বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমেরিকার আর্থিক বিকাশের সূচক বেড়েছে ৪.৩ শতাংশ। এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে তা আটকে ছিল ৩.৮ শতাংশে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আর্থিক বৃদ্ধির হার তিন শতাংশের বেশি বাড়বে না বলে একরকম নিশ্চিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ।
জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি মার্কিন অর্থনীতিতে ৭০ শতাংশ অবদান রয়েছে যে ভোক্তা ব্যয়ের, বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে তা বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ। আগের প্রান্তিকের (এপ্রিল-জুন) তুলনায় তা ২.৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, বেশ চাঙ্গা রয়েছে সে দেশের খুচরো বাজার। এ ছাড়া রফতানি বাণিজ্য ৮.৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানি কমেছে ৪.৭ শতাংশ। ট্রাম্প সমর্থকদের দাবি, এগুলি সবই প্রেসিডেন্টের কড়া শুল্কনীতির সুফল।
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ অবশ্য এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। গত ২৮ ডিসেম্বর সেখানে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে মার্কিন অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলিকে তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, অর্থনীতির হিসাব শুধুমাত্র জিডিপি বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল নয়। তার সঙ্গে যুক্ত থাকে মুদ্রাস্ফীতির হার এবং কর্মসংস্থানের মতো বিষয়। এই দুই ক্ষেত্রে মোটেই স্বস্তিজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই আমেরিকা। আর তাই একে ট্রাম্পের ‘রাজনৈতিক প্রচারের কৌশল’ বলে উল্লেখ করেছে ওই ব্রিটিশ গণমাধ্যম।
‘দ্য গার্ডিয়ান’ জানিয়েছে, বর্তমানে আমেরিকার ব্যক্তিগত খরচ বা পিসিই-তে (পার্সোনাল কনজ়াম্পশান এক্সপেনডিচার্স) মুদ্রাস্ফীতির হার দাঁড়িয়ে আছে ২.৮ শতাংশে। মাসকয়েক আগে এই নিয়ে বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ফেডারেল রিজ়ার্ভ। সেখানে বলা হয়েছিল, পিসিই মুদ্রাস্ফীতির হার দু’শতাংশের বেশি হওয়া মার্কিন বাজার অর্থনীতির জন্য খুবই বিপজ্জনক। তখন সেটা ছিল ২.১ শতাংশ। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এর সূচক।
এ ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে মূল ব্যক্তিগত খরচ বা কোর পিসিই মুদ্রাস্ফীতির হারও। বর্তমানে এর সূচক ২.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে ২.৯ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ এর সঙ্গে ভারতের ‘রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’ বা আরবিআইয়ের ভোক্তা মূল্য সূচক বা সিপিআই-এর (কনজ়িউমার প্রাইস ইনডেক্স) তুলনা টেনেছেন। এ দেশের হিসাবে আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় সাত শতাংশ। চলতি আর্থিক বছরে (২০২৫-’২৬) সিপিআইয়ের সম্ভাব্য হার দু’শতাংশ থাকবে বলে জানিয়েছে আরবিআই।
২০২০ সালে কোভিড অতিমারির সময় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতির হার দ্রুত গতিতে বাড়তে শুরু করে। পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে তা পৌঁছোয় নয় শতাংশে। ওই সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ফলে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সূচক নেমে আসে ৩.১ শতাংশে। তার পরেও খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধি তাঁর উদ্বেগ বাড়িয়েছিল।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। পরবর্তী তিন মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ২.৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন তিনি। এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ চালু করেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। তার পর থেকেই মূল্যবৃদ্ধির সূচক ফের উপরের দিকে ছুটতে শুরু করেছে। বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যে সেটা পাঁচ বা ছয় শতাংশে পৌঁছোতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে শুরু করলে সাধারণ ভাবে সুদের হার বৃদ্ধি করে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। একে বাজার থেকে টাকার প্রবাহ কমানোর একটা সহজ পন্থা বলা যেতে পারে। কিন্তু, ট্রাম্প জমানায় তার সম্পূর্ণ উল্টো ছবি দেখা গিয়েছে। গত কয়েক মাসে অন্তত তিন বার সুদের হার কমিয়েছে আমেরিকার ফেডারেল রিজ়ার্ভ। এর জেরে মূল্যবৃদ্ধির হার বেলাগাম হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বাইডেন জমানায় ২০২২-’২৪ সালের মধ্যে সুদের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি করেছিল আমেরিকার ফেডারেল রিজ়ার্ভ। মুদ্রাস্ফীতির হার কিছুটা কমার পর একসময় বেশ কিছু দিন তা স্থির রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। এতে অবশ্য আর্থিক বৃদ্ধির গতি কিছুটা থমকে গিয়েছিল। কুর্সিতে বসেই এই অবস্থা আমূল পাল্টে ফেলার নির্দেশ দেন ট্রাম্প। ফলে টানা তিন বার সুদের হার কমিয়ে দেয় ফেড রিজ়ার্ভ। বর্তমানে তা দাঁড়িয়ে আছে ৩.৬ শতাংশে।
মার্কিন অর্থনীতির তৃতীয় সমস্যার জায়গা হল বেকারত্ব। এ বছরের জুন থেকে অগস্টের মধ্যে আমেরিকায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়া তো দূরে থাক, উল্টে তা কমে গিয়েছে। অক্টোবরের মধ্যে প্রচুর ছাঁটাই করেছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট থেকে শুরু করে একাধিক বড় বড় সংস্থা। ফলে শ্রমের বাজারে ইতিহাসের দীর্ঘতম অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছে ‘দ্য গার্ডিয়ান’।
ওয়াশিংটনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে কাজ হারিয়েছেন ১.০৫ লক্ষ যুবক-যুবতী। নভেম্বরে সেখানে কাজ পেয়েছেন মাত্র ৬৪ হাজার জন। অর্থাৎ, শ্রম বাজারে ঘাটতির অঙ্ক ৪১ হাজারে পৌঁছে গিয়েছে। বেকারত্বের হার দাঁড়িয়ে আছে ৪.৬ শতাংশে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের পর যা সর্বোচ্চ। ট্রাম্প জমানায় আমেরিকার সংস্থাগুলি কর্মী নেওয়ার পরিমাণ যে দিনকে দিন কমাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুধু বেসরকারি ক্ষেত্রেই নয়, সরকারি স্তরেও কর্মচারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখনও পর্যন্ত স্বেচ্ছাবসর মিলিয়ে সরকারি স্তরে কর্মী ছাঁটাই হয়েছে ২.৭১ লাখ। অন্য দিকে, এই সময়সীমায় বেকার আমেরিকানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ লক্ষ।
এ ছাড়া গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরেই দীর্ঘতম শাটডাউন দেখেছে আমেরিকা, যা অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু করে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। এই সময়সীমার মধ্যে বেতন পাননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ন’লক্ষ সরকারি কর্মচারী। ব্যাহত হয় বিমান পরিষেবাও।
এগুলিকে বাদ দিলে উচ্চ শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়েছেন ট্রাম্প। কাটছাঁট করা হয়েছে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার (ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) খরচও। এর মধ্যেই আবার নভেম্বরে নতুন করে পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার নির্দেশ দেন তিনি। গত ৩৩ বছর তা বন্ধ রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর জেরে আগামী দিনে সরকারের ব্যয়ের বোঝা আরও বাড়তে চলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
যদিও এই সমস্ত সতর্কবার্তাকে সে ভাবে পাত্তা দিচ্ছেন না ট্রাম্প। বাণিজ্য বিভাগ জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রকাশ করতেই এই নিয়ে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করেন তিনি। সেখানে ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) লিখেছেন, ‘‘অতীতের প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে আশাতীত ভাল জায়গায় রয়েছে দেশের আর্থিক বিকাশের সূচক। এর মূলে আছে সুশাসন আর শুল্ক।’’
‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ অবশ্য মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। তাঁর দাবি, ‘‘মুদ্রাস্ফীতির হার শূন্যে নেমে এসেছে। ভোক্তা ব্যয় শক্তিশালী হওয়ায় এবং নিট রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি অনেক কমে গিয়েছে।’’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাঁর কর বিল এবং শুল্কনীতির জন্য ২০২৫ সালে রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর জেরে আগামী দিনে কর্মসংস্থানের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে আমেরিকা।
এ বছরের নভেম্বরে জাতীয় ঋণের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় ওঠায় এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দাবি, গত ১০০ বছরে এই প্রথম বার ঋণের নিরিখে ইটালি এবং গ্রিসকে ছাপিয়ে যেতে পারে আমেরিকা। অর্থাৎ, এককথায় একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশিংটনের অর্থনীতি।
আইএমএফের পদস্থ কর্তাদের অনুমান, ২০৩৫ সালের মধ্যে জিডিপির ১৪৩.৪ শতাংশে পৌঁছোবে মার্কিন ঋণের অঙ্ক। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) এর সূচক দাঁড়িয়েছিল ১২৩ শতাংশে। সে ক্ষেত্রে ধারের নিরিখে গ্রিস এবং ইটালিকে পিছনে ফেলবে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে বিশ্বের ‘সর্বাধিক শক্তিশালী’ রাষ্ট্র। কারণ এক দশক পর আথেন্স এবং রোমের জাতীয় ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির ১৩০ এবং ১৩৭ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ৩৮ লক্ষ কোটি ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে আমেরিকার জাতীয় ঋণ। বিশ্লেষকেরা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ধারের সূচক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের কথায়, বছরের পর বছর ধরে প্রতিরক্ষা বা মহাকাশ গবেষণার মতো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। ফলে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে বাজেট ঘাটতি, যাকে একেবারে গুরুত্ব না দিয়ে ট্রাম্প বিপদ কতটা বাড়াচ্ছেন, তার উত্তর দেবে সময়।
সব ছবি: সংগৃহীত।