ইনস্টাগ্রামে ১২ লক্ষ অনুরাগী। বলিউডের ‘ভাইজান’ থেকে শুরু করে তাবড় তারকাদের সঙ্গে ছবি। সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ভাগ করে নিতেন রোহতকের ব্যবসায়ী ও সমাজমাধ্যম প্রভাবী। সমাজমাধ্যমের এই তারকার মাথায় আপাতত ঝুলছে ১৫টি গুরুতর অপরাধের এফআইআর। এর মধ্যে অন্যতম হল খুন ও অর্থ পাচারের মামলা।
সেই মামলায় সোমবার দিল্লি এবং হরিয়ানার গুরুগ্রাম এবং রোহতকের ১০টি এলাকায় তল্লাশি চালায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডি। তল্লাশি অভিযানের সময় পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি, ১৭ লক্ষ টাকা নগদ, ব্যাঙ্কের লকার, বিভিন্ন অপরাধমূলক নথি, ডিজিটাল ডিভাইস এবং তথ্যের হদিস পেয়েছেন ইডি কর্তারা।
যাঁর খোঁজে ইডির এই হানা, তিনি অবশ্য অনেক আগেই বিদেশে পিঠটান দিয়েছেন। তিনি অর্থ পাচার মামলার সঙ্গে জড়িত মূলচক্রী রাও ইন্দ্রজিৎ যাদব। গত বছর (২০২৪ সালে) রোহতকের এক ব্যবসায়ীকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে রাওয়ের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, এই হত্যা মামলায় তাঁর নাম জড়িয়ে যাওয়ার পরই তিনি সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গা ঢাকা দিয়েছেন।
রাওয়ের বিরুদ্ধে তোলাবাজি, আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয় দেখানো ছাড়াও জোর করে ঋণ নিষ্পত্তির অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের অবৈধ কার্যকলাপ থেকে বখরা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। সেই সমস্ত মামলায় উত্তরপ্রদেশ এবং হরিয়ানা পুলিশ রাও এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিল।
একের পর এক অভিযোগ জমা পড়তেই নড়েচড়ে বসে ইডি। আর্থিক গরমিল ও অপরাধের হদিস পেয়ে আসরে নামে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। আর্থিক তছরুপ প্রতিরোধ আইনের অধীনে পূর্বতন মামলা ও চার্জশিটের ভিত্তিতে তদন্তে নামে ইডি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হরিয়ানার রোহতকে এক ব্যবসায়ী মঞ্জেত দিঘলকে হত্যা করা হয়। হিমাংশু ভাউ নামে এক অপরাধীর দল এই হত্যার দায় স্বীকার করে। তবে রাও ইন্দ্রজিৎ যাদবের নামও এই খুনের মামলায় সামনে এসেছে।
তল্লাশি অভিযানের সময় ইডির নজরে আসে রাও বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা এবং বেসরকারি অর্থদাতাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতেন। এই ধরনের বিষয় নিষ্পত্তির জন্য একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করেছিলেন পলাতক ব্যবসায়ী।
রাও ইন্দ্রজিৎ যাদব ‘জেম রেকর্ডস এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে পরিচিত একটি সঙ্গীত সংস্থার মালিক। এই সংস্থাটি মূলত ‘জেম টিউনস’ নামে মধ্য ও পশ্চিম ভারতে বহুল পরিচিত। ২০০৬ সালে তৈরি হওয়া ‘জেম টিউনস’ একটি ভিডিয়ো-অন-ডিমান্ডের প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে। এই সংস্থাটি পঞ্জাবি, হিন্দি, হরিয়ানার আঞ্চলিক ভাষায় গান তৈরি করে। প্রচারও করে।
অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সমাজমাধ্যমে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেন রাও। বলিউডের একাধিক তারকার সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাঁর। এমনকি একটি ছবিতে সলমন খানের সঙ্গেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। ইনস্টাগ্রামে তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পাশাপাশি সেলিব্রিটিদের সঙ্গে নানা ছবিও পোস্ট করতেন এই ব্যবসায়ী। তদন্তকারী আধিকরিকদের অভিযোগ, জনসমক্ষে আসা এই ছবির আড়ালে রাও সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে গভীর ভাবে জড়িত ছিলেন।
সমাজমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভিডিয়োয় উঠে এসেছে রাওয়ের বিত্তশালী জীবনের ঝলক। চোখে রোদচশমা, চারটি আঙুলে মোটা মোটা সোনার আংটি, ধোপদুরস্ত পোশাক পরে হেঁটে এসে গাড়িতে চড়ছেন তিনি। বেগনি রঙের ঝাঁ-চকচকে একটি পোর্শে গাড়িতে উঠে বসতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেই গাড়িটির দাম কয়েক কোটি টাকা। সেই ভিডিয়োর পটভূমিকায় দেখা গিয়েছে একটি সুদৃশ্য বাংলোও।
ইডি জানিয়েছে, রাও তাঁর এলাকায় প্রভাবশালী বলে পরিচিত ছিলেন। জোর করে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করতেন। কোটি কোটি টাকার ব্যক্তিগত ঋণ লেনদেন এবং আর্থিক বিবাদের মামলাগুলির নিষ্পত্তিতে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে কাজ করতেন রাও।
বিবাদ মিটিয়ে ফেলার জন্য হুমকি, ভয় দেখানো এবং স্থানীয় গ্যাং-এর সশস্ত্র বাহুবলীদের ব্যবহার করতেন রাও, এমনটাই উঠে এসেছে তদন্তে। বিদেশ থেকে পরিচালিত সংগঠিত অপরাধ সিন্ডিকেটের সঙ্গেও তাঁর জড়িত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না ইডি। ভারতের এই ধরনের বিষয়গুলি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছিল বলে অভিযোগ তদন্তকারী সংস্থার।
এই জালিয়াতি ও তোলাবাজি থেকেই কোটি কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন রাও। দামি দামি গাড়ি থেকে শুরু করে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত রাওয়ের বিরুদ্ধে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর।
তাঁর সন্ধানে একাধিক জায়গায় ইডি তল্লাশি চালানোর পরও দমে যাননি রাও। সমাজমাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন যথেষ্টই। অভিযানের কয়েক ঘণ্টা পরই ইনস্টাগ্রামে হিন্দিতে সুদীর্ঘ একটি পোস্ট করেন তিনি। অনুরাগীদের কাছে নিজের ভাবমূর্তি পরিষ্কার রাখার জন্য সাফাই দিতেও দেখা গিয়েছে সেই পোস্টে।
সেই পোস্টে রাও লিখছেন, ‘‘হ্যাঁ, আমি এক জন ‘খুনি’। ঋণের নামে ব্যবসায়ীদের শোষণকারী চক্রের শিকার যাঁরা, লুটপাট ও তোলাবাজির হাত থেকে তাঁদের বাঁচানোর জন্য আমি খুনি। গুন্ডা এবং পুলিশের চক্র, যারা ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কঠোর পরিশ্রমকে কাজে লাগাত তাদের কাছে খুনি আমি। তখন পুলিশ কোথায় ছিল?’’
চলতি বছরের (২০২৫) জুলাই মাসে, গায়ক রাহুল ফাজিলপুরিয়ার বাড়িতে গুলি চালানোর ঘটনায়ও রাওয়ের নাম উঠে আসে। এক মাস পর, গুরুগ্রামে ফাজিলপুরিয়ার সহযোগী রোহিত শৌকিনকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। রাও এবং তাঁর সহযোগীরা সেই হত্যার দায়ও স্বীকার করেন বলে সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ১৮ অগস্ট, ইউটিউবার এলভিস যাদবের বাড়িতে গুলি চালায় কয়েক জন দুষ্কৃতী। হিমাংশু ভাউয়ের গ্যাং সেই গুলি চালানোর দায় স্বীকার করে। সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টেও যাদবের নাম উঠে আসে। অক্টোবরে হরিয়ানার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর সন্দীপ কুমার লাথার তাঁর সুইসাইড নোটে রাও ইন্দ্রজিৎ যাদবের নামও উল্লেখ করেছিলেন।
সব ছবি: সংগৃহীত।