চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। পেট্রলের দাম বেড়েই চলেছে দুনিয়া জুড়ে। টাকার দামে পতন এবং ভূ-রাজনীতিতে বিবিধ সমস্যার কারণে তেলের দাম কমার কোনও লক্ষণ নেই এ দেশেও।
অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপর জ্বালানির দামের প্রভাব পড়তে বাধ্য। এই খরচের বহর ক্রমশ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় ডলার আরও শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে অপরিশোধিত তেল আরও দামি হতে পারে। চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে ‘তরল সোনার’ দর হু-হু করে বাড়ছে।
কর ও শুল্ক, আমদানি ও পরিবহণ খরচ ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে পেট্রল বা ডিজ়েলের দাম। স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার, বাণিজ্যিক নিয়মনীতি, প্রতিযোগিতা এবং ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার মতো বিষয়গুলিও জ্বালানির দরের কমা-বাড়ার উপর প্রভাব ফেলে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তেলের দাম ভিন্ন। ভারতের তুলনায় বহু গুণ চড়া দামে তেল কিনতে বাধ্য হন বহু দেশের বাসিন্দারাই।
অনেক দেশেই পেট্রলের দাম বাড়ার প্রধান কারণ হল বিভিন্ন ধরনের কর। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলি যেমন ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস। কার্বন নির্গমন কমাতে এবং পরিবেশরক্ষায় জ্বালানিতে কর বাড়িয়ে থাকে এই দেশগুলি।
সেই তালিকায় প্রথম নামটি রয়েছে হংকঙের। ২০২৫ সালের মার্চ মাসের পাওয়া তথ্য অনুসারে হংকঙে পেট্রলের দাম ছিল ৩.৪২ ডলার প্রতি লিটার। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় এক লিটার তেলের দাম পড়বে প্রায় ৩০৪ টাকা। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেট্রলের দাম চোকাতে হয় চিনশাসিত ‘সুবাসিত বন্দর’ শহরটির বাসিন্দাদেরই।
উচ্চমাত্রার কর, পেট্রল বা ডিজেলের পাম্প তৈরির জমির খরচ বহুল হওয়ার কারণে চড়া দামে জ্বালানি কিনতে হয় হংকঙের অধিবাসীদের। এ ছাড়াও স্থানীয় অঞ্চলে তেল পরিশোধনের সুযোগসুবিধা থাকার জন্য বাড়তি খরচ চাপে তেলের দামের উপর।
জীবনযাত্রার মানের নিরিখে সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে প্রথম এবং বিশ্বে নবম। নাগরিক পরিষেবা বিশ্বমানের হওয়া সত্ত্বেও এখানকার বাসিন্দাদের মোটা টাকা গুনতে হয় পেট্রলের জন্য।
হংকঙের মতো সিঙ্গাপুরেও স্থানীয় তেলের উৎসের অভাব রয়েছে। সমস্ত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। অপরিশোধিত তেল উৎপাদন না করলেও, সিঙ্গাপুরে তেল পরিশোধন কেন্দ্র রয়েছে। পেট্রল না থাকলেও পেট্রোপণ্যের প্রধান সরবরাহকারী দেশ এই ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রটি।
সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, লোকবলের অভাব সত্ত্বেও কী ভাবে একটি বিশ্বমানের শহর গড়ে উঠতে পারে তা দেখিয়েছে সিঙ্গাপুর। এই শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ যেমন বেশি, তেমনই গাড়ি চড়ার জন্য মোটা টাকা খরচ করতে হয় সিঙ্গাপুরবাসীকে। চলতি বছরের অক্টোবরে-নভেম্বরে সিঙ্গাপুরে পেট্রলের দাম ছিল ২.৯ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় হিসাব করলে এক লিটার পেট্রলের দাম পড়বে প্রায় ২৫২ টাকা।
প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে ‘বরফভূমি’ আইসল্যান্ডে তেলের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, আইসল্যান্ডে পেট্রলের দাম ছিল ২.৫২ ডলার প্রতি লিটার। একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপরাষ্ট্র হওয়ার কারণে আইসল্যান্ডে তেল পৌঁছোনোর খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চড়া হারের শুল্ক। সে কারণে ‘বরফ ও আগুনের দেশ’-এর নাগরিকদের পেট্রল কেনার জন্য বেশি টাকা দিতে হয়।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ছিল ২.৪৪ ডলার বা ২১৬.৪৪ টাকা। এর প্রধান কারণ হল দেশের উচ্চ করকাঠামো। জ্বালানির খরচ বেশি হওয়ায় ডাচদের দেশটি বর্তমানে বিকল্প ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছে।
প্রতি লিটারে ২১২ টাকা দিয়ে পেট্রল কিনতে হয় ইউরোপের দেশ মোনাকোর বাসিন্দাদের। জিডিপির নিরিখে এই দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির মধ্যে একটি। মোনাকোয় বসবাসকারী যে কোনও দেশের নাগরিকের জন্য আয়করে সম্পূর্ণ ছাড় রয়েছে। তবে এখানে গাড়ি চড়ার খরচ যথেষ্ট।
পেট্রলের দাম চড়া স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশ ডেনমার্কেও। ডেনমার্কে পেট্রলের দাম অন্য স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলির তুলনায় অনেকটাই বেশি। দেশটি ঠান্ডা এবং ঘনবসতিপূর্ণ। উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের এই দেশের নাগরিক জীবনযাত্রার মান বেশ উঁচু। সেপ্টেম্বর মাসের দাম অনুযায়ী এখানে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ১৯৮ টাকার কাছাকাছি।
বিশ্ববাজারে তেলের দামের উত্থানের পিছনে প্রধান একটি কারণ হল ইহুদি ও শিয়া মুলুকের মধ্যে চলমান অশান্তি। ওপেকের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রের নাম ইরান। সেই ইরানের সঙ্গে সম্মুখসমরের ফল ভোগ করে ইজ়রায়েলও। প্রতিবেশী দেশে তেলের খনি থাকা সত্ত্বেও সরাসরি তেল পায় না ইজ়রায়েল।
ইহুদি দেশটির নিজস্ব প্রাকৃতিক তেলের ভান্ডার নেই। দেশের প্রায় ১০০ শতাংশ জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। করের পরিমাণও বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের দর অনুযায়ী সে দেশে এক লিটার পেট্রলের দাম ১৯২ টাকা।
সুইৎজ়ারল্যান্ড এবং অস্ট্রিয়ার মাঝখানে অবস্থিত ইউরোপের ছোট্ট দেশ। ২০২৪ সালে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৪০ হাজার। সেই ক্ষুদ্র দেশটিতেও বেশ দামি পেট্রল। ১৯২.৪ টাকা প্রতি লিটার দরে তেল কিনতে হয় লিখটেনস্টাইনের বাসিন্দাদের।
বরফঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড়, সবুজ ঢালু আলপাইন উপত্যকায় ঘেরা দেশ সুইৎজ়ারল্যান্ড। তেল আমদানির জন্য দেশটিকে অনেক খরচ করতে হয়। এর ফলে এখানে প্রতি লিটার তেলের দাম ১৯১ টাকার কাছাকাছি। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের দর তাই বলছে।
আয়ারল্যান্ডে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি লিটার পেট্রলের দাম ছিল ১৭৩.৮৪ টাকা। আয়ারল্যান্ডে জ্বালানিতে কর বেশি হওয়ার কারণে এত দাম।
সব ছবি: সংগৃহীত।