প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অথবা স্থাপত্য নিদর্শনের জন্য নয়। এই পর্যটনস্থলের ‘আকর্ষণ’ জীবাণুর ভান্ডার। আর তা দেখতে সেখানে ভিড় জমান পর্যটকেরা। এমনকি, সেখানকার দেওয়াল থেকে চুইংগাম তুলে খেয়েও ফেলেন অনেকে। বিশ্বের জীবাণু সংক্রমিত পর্যটনকেন্দ্রগুলির মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে ‘গাম ওয়াল’। চুইংগামে থিকথিক করা এই দেওয়ালের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমেরিকার এক শহরের ইতিহাস।
আমেরিকার ওয়াশিংটনের সিয়াটলের পাইক প্লেস মার্কেটের অনতিদূরে রয়েছে চুইংগামে ঠাসা পুরু একটি দেওয়াল। আট ফুট উঁচু এবং ৫৪ ফুট দীর্ঘ এই দেওয়ালটি ‘গাম ওয়াল’ নামে পরিচিত। তবে নব্বইয়ের দশকে এই দেওয়াল ছিল একেবারে ঝকঝকে, তকতকে। সেই দেওয়ালের কাছে একটি ছোট বক্স অফিস ছিল। অধিকাংশ সময় সেখানে কমেডি শো এবং ছোটখাটো অনুষ্ঠান হত।
১৯৯১ সালে বক্স অফিসটি এক প্রযোজনা সংস্থা কিনে ফেলে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, ওই দলের কয়েক জন খোশগল্প করার জন্য দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতেন। কখনও তাঁরা দেওয়ালের গায়ে চুইংগাম লাগিয়ে দিতেন। কখনও আবার চুইংগামের সঙ্গে মুদ্রাও আটকে দিতেন তাঁরা। পরে দেওয়াল থেকে মুদ্রাগুলি তুলে নেওয়া হলেও চুইংগামগুলি আর উপড়ে ফেলা হয়নি।
নব্বইয়ের দশকের গো়ড়ার দিকে দুই বন্ধু দেওয়ালের উপর চুইংগাম লাগিয়ে দেন। তাঁদের দেখে দলের বাকি দু’জনও একই কাজ করেন। দেওয়ালে এত চুইংগাম লেগে থাকতে দেখে স্থানীয়দের অনেকেই সেখানে চুইংগাম লাগাতে থাকেন। এ ভাবে বছরের পর বছর ধরে দেওয়ালের উপর চুইংগামের পুরু আস্তরণ জমতে থাকে।
রংবেরঙের চুইংগাম লেগে থাকার কারণে ধীরে ধীরে ‘গাম ওয়াল’ একটি পর্যটনস্থলে পরিণত হয়ে যায়। সেখানে ভিড় জমাতে থাকেন পর্যটকেরা। ‘গাম ওয়ালে’ ঘুরতে যাওয়া অধিকাংশ পর্যটককে চুইংগাম চিবোতে দেখা যেত। কিছু ক্ষণ চিবিয়ে তা দেওয়ালে আটকে দিতেন তাঁরা। আবার কেউ কেউ মজার ছলে সেই দেওয়াল থেকে চুইংগাম তুলে খেয়ে ফেলতেন।
চুইংগাম লেগে থাকার কারণে সেখানে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়তে শুরু করেছিল বলে স্থানীয়দের দাবি। ওই দেওয়ালের কাছেই ছিল ভরা বাজার। ইঁদুরের উপদ্রবে সেখানকার দোকানদারদেরও অসুবিধা হচ্ছিল। তাই ওই দেওয়াল পরিষ্কার করার দাবি জানান তাঁরা।
স্থানীয়দের অনেকের মতে, বহু বছর ধরে চুইংগাম লেগে থাকার ফলে দেওয়াল ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর। তাই খুব সাবধানে সেই দেওয়ালটিকে যথাসম্ভব সংরক্ষণ করে চুইংগাম তোলার ব্যবস্থা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সেই দেওয়াল পরিষ্কার করা শুরু হয়। ২০ বছর পর সেই দেওয়াল সাফাইয়ের কাজে হাত দেন তাঁরা। স্টিম মেশিন ব্যবহার করে ১৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নিম্নচাপে দেওয়াল থেকে চুইংগাম তোলার কাজ শুরু হয়।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে মোট ১৩০ ঘণ্টা সময় লাগে। দেওয়াল থেকে ১ হাজার ৭০ কেজি ওজনের চুইংগাম তোলা হয়। পরে সেগুলিকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নষ্ট করে দেওয়া হয়। দেওয়ালে গাঁথা ইটের যেন কোনও রকম ক্ষতি না হয়, সে কারণেই সাবধানতা অবলম্বন করে এই কাজ করা হয়।
তবে ২০১৫ সালের পরেও ‘গাম ওয়ালে’ চুইংগাম লাগানো হয়েছে। তেমন বিশেষ কোনও সতর্কতাবিধি জারি করা হয়নি সেই এলাকায়। ‘গাম ওয়ালের’ ঐতিহ্য বজায় রাখতে এক ব্যক্তি সেখানে গ্রাফিটি আঁকেন। কিন্তু সেটাও করা হয় চুইংগাম লাগিয়ে।
আমেরিকার জনপ্রিয় ফুটবল কোচ পিটার ক্লে ক্যারল। সিয়াটল সিহক্স দলের হেড কোচের দায়িত্ব থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার পর ‘গাম ওয়ালে’ পিটারের দু’ফুট লম্বা ছবি এঁকে ফেলেন রুডি উইলিংহ্যাম নামে এক স্থানীয় চিত্রশিল্পী।
ম্যাচ চলাকালীন নাকি দিনে ১৩০ খানা চুইংগাম চিবোতেন পিটার। তাঁকে সম্মান জানাতে ২০০টির বেশি চুইংগাম চিবিয়ে তা ‘গাম ওয়ালে’ লাগাতে শুরু করেন রুডি। চুইংগাম লাগিয়ে পিটারের ছবি ফুটিয়ে তোলেন শিল্পী।
২০১৫ সালের পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর এবং ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে আবার সাফাই অভিযান চলেছে গাম ওয়ালে। তবে জায়গাটি এখনও পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে খ্যাত। মাঝেমধ্যে হবু দম্পতিরা প্রাক্বিবাহের জন্য ফোটোশুটও করতে যান সেখানে। জীবাণুদের আবাসস্থলে তখন ছড়িয়ে পড়ে রোম্যান্স।
সব ছবি: সংগৃহীত।