‘চালবাজ’ চিনের ঋণের ফাঁসে আটকে যখন হাঁসফাঁস দশা, ঠিক তখনই পরিত্রাতার ভূমিকায় রঞ্চমঞ্চে পা রেখেছে ভারত। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এর জেরে আগামী দিনে ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির ওই এলাকায় নয়াদিল্লির শিল্প সংস্থাগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক যুদ্ধে নামতে হবে বেজিংকে। আর সেই প্রতিযোগিতায় জেতা ড্রাগনের পক্ষে মোটেই সহজ নয়।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘানা সফর নিয়ে ইতিমধ্যেই একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চিনের সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইম্স। আফ্রিকার বাজারে বেজিঙের একাধিপত্য শেষ করতে নয়াদিল্লি যে উঠেপড়ে লেগেছে, সেখানে তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। ড্রাগনভূমির কূটনীতিকদের দাবি, ‘দক্ষিণী বিশ্বের’ (পড়ুন গ্লোবাল সাউথ) প্রতিটা ক্ষেত্রকে কব্জা করার প্রচেষ্টা রয়েছে ভারতের। মোদীর ঘানা সফর সেই পরিকল্পনারই অংশ বলে মনে করেন তাঁরা।
বিশ্লেষকদের দাবি, প্রধানমন্ত্রীর আফ্রিকা যাত্রায় চিনের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, বেজিঙের মতো কোনও দেশকে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে তার সম্পদ লুটের কোনও পরিকল্পনা নেই ভারতের। দ্বিতীয়ত, বহু ক্ষেত্রে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রকে একাধিক জনকল্যাণকর প্রকল্প উপহার দিয়েছে নয়াদিল্লি। বিনিময়ে সেনাঘাঁটি তৈরি, বিশেষ বাণিজ্যচুক্তি বা শুল্কছাড়ের শর্ত কখনওই চাপিয়ে দিতে চায়নি মোদী সরকার এবং তার পূর্বসূরিরা।
উদাহরণ হিসাবে ঘানার কথা বলা যেতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটির প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ‘জুবিলি হাউস’ তৈরি হয়েছে নয়াদিল্লির টাকায়। এর জন্য তিন কোটি ডলার আক্রার হাতে তুলে দেয় ভারত সরকার। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ নির্মাণের পাশাপাশি ওই অর্থে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক ভবন নির্মাণও সম্ভব হয়েছিল। ‘বন্ধু’র এই অনুদান ভোলেনি আটলান্টিকের পারের দেশটি।
বর্তমান ঘানা এবং ভারতের মধ্যে রয়েছে ৩০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক। এই অঙ্ককে দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে আক্রা ও নয়াদিল্লি। এতে ভারত সাফল্য পেলে বেজিঙের যে দুশ্চিন্তা বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির সঙ্গে নয়াদিল্লির কোনও বাণিজ্যিক ঘাটতি নেই। অর্থাৎ, সেখানে বেশি পরিমাণে পণ্য বিক্রি করে থাকে এ দেশের একাধিক সংস্থা।
ঘানার বাজারে ভারতীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম, লোহা-ইস্পাত, ভারী যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, চিনি এবং চালের বেশ কদর রয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির বাসিন্দারা নয়াদিল্লির শিল্প সংস্থাগুলির তৈরি করা গাড়ি এবং বাইক বা স্কুটার কিনতে পছন্দ করেন। ফলে টাটা, মাহিন্দ্রা এবং অশোক লেল্যান্ডের মতো কোম্পানি সেখানে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাবে বলে আশাবাদী আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
আটলান্টিকের কোলের দেশ হওয়ায় ঘানার উপকূলরেখা খুব ছোট নয়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬৩ কিলোমিটার। পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে দু’টি প্রধান সমুদ্রবন্দর রয়েছে। সেগুলি হল, টেমা এবং টাকোরাদি। এ ছাড়া সল্টপন্ড, এলমিনা বন্দর, সেকোন্দির এবং আক্রা বন্দরও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, মোদীর সফরের জেরে আগামী দিনে সেখানেও ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলিকে লগ্নি করতে দেখা যাবে।
এ ছাড়া ঘানায় সমরাস্ত্র বিক্রির বড় বাজার পেতে পারে ভারতের যাবতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা। চলতি বছরের মে মাসে চার দিনের ‘যুদ্ধে’ নয়াদিল্লির অত্যাধুনিক হাতিয়ারগুলি যে ভাবে পাকিস্তানের বিমানঘাঁটি উড়িয়েছে, তাতে বেশ মুগ্ধই হয়েছেন আক্রার ফৌজি জেনারেলরা। সূত্রের খবর, তার পর থেকেই এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। যদিও এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে এখনও কোনও ঘোষণা করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আদানি গোষ্ঠীর তৈরি ‘আত্মঘাতী’ স্কাইস্ট্রাইকার ড্রোন, পিনাকা মাল্টি-ব্যারেল রকেট লঞ্চার এবং রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ইচ্ছা রয়েছে ঘানা সরকারের। পাশাপাশি, বিপুল সংখ্যায় কামান-মর্টারের গোলা, ল্যান্ডমাইন এবং গ্রেনেডের বরাত দিতে পারে আক্রা। নয়াদিল্লির অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে আগ্রহ রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির সেনা অফিসারদের।
ঘানার উত্তরের প্রতিবেশী বুরকিনা ফাসোতে দীর্ঘ দিন ধরে চলছে গৃহযুদ্ধ। সেই আঁচে বেশ কয়েক বার গা পুড়েছে আক্রার। এ ছাড়া আফ্রিকার কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-অ্যাডো। অতীতে আফ্রিকার আর এক দেশ মালির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে ঘানাকে। সেখানে ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন আক্রার সৈনিকেরা।
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, মোদীর সফরের জেরে টাটা-আদানি-অম্বানীর মতো বড় বড় ভারতীয় শিল্প সংস্থাগুলির লগ্নির দরজা পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে খুলে গেলে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে সেখানে একচেটিয়া ব্যবসা করে আসা চিনা কোম্পানিগুলি। সেই তালিকায় প্রথমেই থাকবে লোহা-ইস্পাত, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম, গাড়ি এবং সমরাস্ত্রের ব্যবসা।
এ ছাড়া ঘানার সমুদ্র বন্দরগুলিতে লগ্নির ক্ষেত্রে দুই দেশের শিল্পপতিদের মধ্যে বাণিজ্যিক লড়াই দেখতে পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে ভারত। কারণ, বেজিঙের ঋণ অর্থনীতির জাল কেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে আক্রা। পাশাপাশি, এ ব্যাপারে ‘বন্ধু’ ভারতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশের।
চলতি বছরের ৩ জুলাই ঘানার পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘‘আফ্রিকার উন্নয়নে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অংশীদার। এখানকার জনগণের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আমরা ‘এজেন্ডা ২০৬৩’কে সমর্থন করি। এর বাস্তবায়নকে অগ্রাধিকার দেবে নয়াদিল্লি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল সমান ভাবে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা।’’
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘এজেন্ডা-২০৬৩’ গ্রহণ করে আফ্রিকান ইউনিয়ন। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল ঘানা। সেই কারণে প্রকল্পটিকে গ্রহণ করেছে আক্রা। এর মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শান্তি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির ৫৫টি রাষ্ট্রের সংগঠনটির।
কৌশতগত দিক থেকে এ-হেন গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে রেলপথ বিস্তারের কাজও চুটিয়ে করছে ভারত। গত বছর টেমা-এমপাকাদান রেললাইনের উদ্বোধন করে ঘানার সরকার। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নির্মাণের নেপথ্যে হাত রয়েছে নয়াদিল্লির। আক্রা সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী জানিয়েছেন এই ধরনের পরিকাঠামোগত প্রকল্পে আগামী দিনে আরও বেশি করে লগ্নি করবে ভারত। পাশাপাশি, আফ্রিকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকার অর্থনৈতিক একীকরণে ঘানার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন তিনি।
বিদেশ মন্ত্রকের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জুন পর্যন্ত আফ্রিকার মোট ৪৩টি দেশে ২০৬টি প্রকল্প শেষ করেছে ভারত। এ ছাড়া ছাড় দেওয়া ঋণের আওতায় বাস্তবায়িত হয়েছে আরও ৬৫টি প্রকল্প। সংশ্লিষ্ট পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলিতে মোট খরচ হয়েছে ১,২৩৭ কোটি ডলার। এ ছাড়া আরও ৮১টি প্রকল্প বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি।
আফ্রিকার দেশগুলিতে ভারতীয় অর্থে যে পরিকাঠামোগুলি তৈরি হচ্ছে সেগুলি হল পানীয় জল ও সেচ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রান্সমিশন লাইন, সিমেন্ট, চিনি ও বস্ত্র কারখানা এবং প্রযুক্তিগত হাব। তবে সবচেয়ে বেশি অর্থ রেলপথ বিস্তারে খরচ করার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। ফলে বাণিজ্যের প্রতিটা ক্ষেত্রেই কড়া টক্করের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে চিনের।
বর্তমানে আফ্রিকার দেশগুলির বৃহত্তম দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক অংশীদার হল বেজিং। ‘অন্ধকার মহাদেশ’টির রাষ্ট্রগুলির রফতানি করা পণ্যের ২০ শতাংশই যায় ড্রাগনভূমিতে। এর একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিরল খনিজ উপাদান। এ ছাড়া আফ্রিকার দেশগুলির আমদানি করা পণ্যের ১৬ শতাংশ আসে চিন থেকে।
২০০৫ সালে সহারা মরুভূমির নীচের দিকের দেশগুলির মোট বৈদেশিক ঋণের মধ্যে চিনের অংশ ছিল দু’শতাংশের কম। কিন্তু ২০২১ সালে সেটাই বেড়ে ১৭ শতাংশ পৌঁছে যায়। ওই বছর আফ্রিকার দেশগুলির বৈদেশিক ঋণের অঙ্ক ছিল ১৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। শেষ চার বছরে সেখানে ঊর্ধ্বমুখী থেকেছে বেজিঙের ঋণের সূচক।
ঘানায় দেওয়া ভাষণে তাই নাম না করে চিনকে খোঁচা দিতে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি বলেন, ‘‘এই মহাদেশের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলিতে আমাদের অংশীদারি চাহিদাভিত্তিক। শুধুমাত্র লগ্নির লক্ষ্য নিয়ে আমরা আসিনি। নয়াদিল্লি চায় স্থানীয় সক্ষমতা এবং ক্ষমতায়ন। স্বনির্ভর বাস্তুতন্ত্রের বিকাশেও আমরা সহযোগিতা করছি।’’ তাঁর কূটনীতি ‘অন্ধকার মহাদেশ’-এ ভারতের প্রভাব বৃদ্ধিতে কতটা সাহায্য করে, তার উত্তর দেবে সময়।
সব ছবি: সংগৃহীত।