রণবীর সিংহ অভিনীত ‘ধুরন্ধর’কে কেন্দ্র করে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রটিকে ‘মিথ্যা প্রচারমূলক’ বলে উল্লেখ করে পরিচালক আদিত্য ধরের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে সুশীল সমাজের একাংশ। তাতে অবশ্য স্পাই-থ্রিলারটির জনপ্রিয়তায় এতটুকু ভাটা পড়েনি। বক্স অফিসের সাফল্য যখন উপচে পড়ছে, ঠিক তখনই উপসাগরীয় দেশগুলির থেকে বড় ধাক্কা খেল ‘ধুরন্ধর’। সৌদি আরব-সহ সেখানকার মোট ছ’টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে এই বলিউডি ছায়াছবি।
পশ্চিম এশিয়ার ছ’টি আরব দেশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ’ বা জিসিসি (গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল)। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির সদস্যপদ রয়েছে বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির। রিয়াধকে জিসিসির অবিসংবাদিত নেতা বলা যেতে পারে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এই গোষ্ঠীর সমস্ত দেশেই নিষিদ্ধ হয়েছে ‘ধুরন্ধর’। ফলে সেখান থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক মুনাফার রাস্তা যে বন্ধ হল, তা বলাই বাহুল্য।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তান-বিরোধী চিত্রনাট্যের জন্যই ‘ধুরন্ধর’-এর উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ‘উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ’-এর সমস্ত সদস্য। যদিও এ ব্যাপারে আশা ছাড়তে নারাজ ছবিটির সঙ্গে জড়িত ভারতীয় পরিবেশকেরা। সৌদি-সহ ওই সমস্ত আরব দেশগুলির প্রশাসনের সঙ্গে নাগাড়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তবে তাতে বরফ কতটা গলবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বিশেষত সৌদি আরব, আমিরশাহি এবং কাতারে ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনও কাজের সূত্রে সেখানে থাকছেন তাঁরা। এ ছাড়া অতিরিক্ত আয়ের জন্য এ দেশের নির্মাণ শ্রমিকদের একাংশ প্রতি বছর ওই উপসাগরীয় দেশগুলিতে পাড়ি জমান। কেউ কেউ আবার হোটেলে চাকরি নিয়েও সেখানে যাচ্ছেন। পেশাদারদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার, চিকিৎসক এবং তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের সংশ্লিষ্ট আরব রাষ্ট্রগুলিতে বেশ কদর আছে।
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সাল) সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র আমিরশাহিতে বসবাসকারী ভারতীয়ের সংখ্যা ৪৩ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। বর্তমানে সৌদিতেও রয়েছেন এ দেশের কয়েক লক্ষ বাসিন্দা। বলিউডি সিনেমার প্রতি এঁদের আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। সেই কারণেই হিন্দি চলচ্চিত্রের পরিচালক-প্রযোজকেরা উপসাগরীয় দেশগুলিতে ছবি পাঠানোর ব্যাপারে সব সময় উৎসাহ নিয়ে থাকেন। আর তাই ‘ধুরন্ধর’-এর উপরে নিষেধাজ্ঞা বসার নেপথ্যে ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার গন্ধ পেয়েছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের সঙ্গে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’তে সই করে পাকিস্তান। সংশ্লিষ্ট সমঝোতাটিতে বলা হয়েছে, এই দু’য়ের মধ্যে কোনও একটি দেশ তৃতীয় কোনও শক্তি দ্বারা আক্রান্ত হলে বা আগ্রাসনের শিকার হলে, তাকে উভয় দেশের উপর আঘাত বা যুদ্ধ হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আর তাই ‘ধুরন্ধর’ নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে রিয়াধ-ইসলামাবাদের ‘ইসলামীয় ভ্রাতৃত্ব’ (ইসলামিক ব্রাদারহুড) সম্পর্ককেই দায়ী করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
যদিও অনেকেই এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, পাক-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার আগেও বহু বলিউডি সিনেমাকে নিষিদ্ধ করেছে জিসিসি-ভুক্ত ছয় উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্র। উদাহরণ হিসাবে এ বছরের জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘স্কাই ফোর্স’ এবং মার্চে জন আব্রাহাম অভিনীত ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’-এর কথা বলা যেতে পারে। এ ছাড়া গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সালে) মুক্তি পাওয়া হৃতিক রোশন অভিনীত ‘ফাইটার’ এবং ইয়ামি গৌতম অভিনীত ‘আর্টিকেল-৩৭০’ রয়েছে এই তালিকায়।
২০২৩ সালে মুক্তি পায় সলমন খান অভিনীতি ‘টাইগার-৩’। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্স’ প্রেক্ষাগৃহে আসে ২০২২ সালে। এই সিনেমাগুলিও মুক্তি পায়নি কোনও উপসাগরীয় দেশে। ‘ফাইটার’-এর ক্ষেত্রে বেশ কিছু দৃশ্য বাদ দিয়ে তা দেখানোর বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু, এক দিনের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট ছায়াছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দেয় আমিরশাহি প্রশাসন। সেই সিদ্ধান্ত থেকে আবু ধাবিকে আর টলানো যায়নি।
মজার বিষয় হল, নিষিদ্ধ হওয়া প্রতিটা সিনেমারই চিত্রনাট্যে রয়েছে পাকিস্তানের কুকীর্তির উল্লেখ। ‘ধুরন্ধর’-এ যেমন করাচির গ্যাং ওয়ার, নেপাল থেকে ভারতীয় বিমান ছিনতাই, যাত্রীদের পণবন্দি রেখে কুখ্যাত সন্ত্রাসী মৌলানা মাসুদ আজ়হারকে দিল্লির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ২৬/১১ মুম্বই হামলার সময়কার লশকর-এ-ত্যায়বার জঙ্গিদের কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। ‘ফাইটার’ তৈরি হয়েছে পুলওয়ামা হামলা এবং তার পাল্টা হিসাবে বালাকোটে এ দেশের বিমানহানাকে কেন্দ্র করে।
গত কয়েক বছরে একের পর এক ভারতীয় সিনেমা নিষিদ্ধ করলেও জিসিসির ‘কৃপাদৃষ্টি’ পেয়েছে পাকিস্তান। ইসলামাবাদের পরিচালক ও প্রযোজকদের তৈরি ‘ওয়ার’ এবং ‘শেরদিল’ ছায়াছবির ক্ষেত্রে এই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত কখনওই নেয়নি ওই সমস্ত উপসাগরীয় দেশ। সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্র দু’টির মাধ্যমে এ দেশের বিরুদ্ধে যথেষ্ট মিথ্যা প্রচার করেছে পশ্চিমের প্রতিবেশী। সেখানে ভারতীয় ফৌজ, সরকার এবং গুপ্তচরদের একরকম সন্ত্রাসবাদী হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।
২০১৬ সালে জম্মু-কাশ্মীরের উরি ক্যাম্পে হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট চার জঙ্গি। তাদের ছোড়া গুলিতে প্রাণ হারান ভারতীয় সেনার ১৯ জন সৈনিক। এর পরই সীমান্ত পেরিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে সন্ত্রাসীদের একগুচ্ছ গোপন ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় এ দেশের বাহিনী। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামের একটি সিনেমা তৈরি করেন আদিত্য ধর। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ভিকি কৌশল অভিনীত ওই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন তিনি।
ধর পরিচালিত ‘উরি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। অনেকেই বলেছিলেন, সিনেমাটির মাধ্যমে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের হয়ে প্রচার করেছেন তিনি। যদিও বক্স অফিসে দুর্দান্ত ব্যবসা করে ওই সিনেমা। এর পর দীর্ঘ ছ’বছর পরিচালনা থেকে দূরে ছিলেন তিনি। ‘ধুরন্ধর’-এ অবশ্য পাকিস্তানের ‘অপারেশন লিয়ারি’ এবং তাতে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা র-এর জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরেছেন তিনি।
‘ধুরন্ধর’ বক্স অফিসে ঝড় তুললেও পরিচালকের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নেটপ্রভাবী ধ্রুব রাঠি। তাঁর কথায়, “কতটা নীচে নামা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন আদিত্য ধর। সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গিয়েছেন তিনি। এত হিংসা, এত রক্ত, এত নৃশংসতায় ভরা একটা সিনেমা দেখা আর আইসিস-এর জঙ্গিদের হত্যালীলা দেখা— দুটোই সমান। একে ‘বিনোদন’ বলা হচ্ছে। এত অর্থের লোভ, যে নতুন প্রজন্মের মনে বিষ ঢালছেন। অপ্রত্যাশিত অত্যাচারকে গৌরবান্বিত করছেন উনি।”
ধ্রুব রাঠির পাশে দাঁড়িয়ে প্রায় একই কথা বলতে শোনা গিয়েছে বলি নায়িকা রাধিকা আপটেকে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী বলেন, “আমার খুব অস্বস্তি হয়েছে ছবিটা দেখে, বিষয়টা নিয়ে খোলাখুলি কথাও বলা উচিত। যে ভাবে হিংসা ও অতিরিক্ত রক্তারক্তি দিয়ে বিনোদন দেখানো হচ্ছে, তা দেখে সত্যিই চিন্তা হচ্ছে। যে বিশ্বে হিংসাকেই বিনোদন হিসাবে দেখানো হচ্ছে, সেখানে কোনও শিশুর জন্ম দিতে চাই না। এই হিংসা আমি নিতে পারছি না।”
অন্য দিকে সম্পূর্ণ উল্টো রাস্তায় হেঁটে ‘ধুরন্ধর’-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন অভিনেতা রণদীপ হুডা। সমাজমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘‘সিনেমাটা দেখে আমি উড়ে গিয়েছি। আদিত্য ধরকে অভিনন্দন। ক্ষুরধার পরিচালনা। চিত্রনাট্য টানটান, আবহসঙ্গীত অসাধারণ।’’ এর আগে ‘স্বতন্ত্র বীর সাভারকর’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য কটাক্ষের স্বীকার হন রণবীর। সেই প্রসঙ্গও টানেন তিনি।
ইসলামাবাদের সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের আবার দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনুমতি নিয়ে ‘ধুরন্ধর’ তৈরি করেছেন আদিত্য ধর। পাশাপাশি তারা তোপ দেগেছে সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফের কন্যা তথা পঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মরিয়ম নওয়াজ়ের উদ্দেশেও। শুধু তা-ই নয়, পাল্টা প্রচারমূলক ছবি তৈরির জন্য বর্তমান সরকার অর্থসাহায্য করছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে পশ্চিমের পড়শি দেশে।
ভারতীয় নেটাগরিকদের মধ্যে পাক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এই খবরের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া গিয়েছে। কেউ কেউ সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘আদিত্য ধরের এই ছবি ইসলামাবাদকে চাপের মুখে ফেলেছে।’’ যদিও এ দেশের অনেকেই গুপ্তচরবৃত্তির অনেক কিছুকে বাস্তবের মতো করে ফুটিয়ে তোলার জন্য পরিচালকের কড়া সমালোচনা করেছেন।
সিনেবিশ্লেষকদের অনুমান, দ্বিতীয় সপ্তাহেই ৪০০ কোটির ক্লাবে পা রাখবে আদিত্য ধরের ‘ধুরন্ধর’। রণবীর সিংহের পাশাপাশি এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন সঞ্জয় দত্ত, অক্ষয় খান্না, আর মাধবন এবং অর্জুন রামপাল। তাঁদের পারফরম্যান্সও যথেষ্ট নজরকাড়া। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলিতে নিষিদ্ধ হলেও ‘ধুরন্ধর’-এর বক্স অফিস সাফল্য যে আটকাবে না, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সব ছবি: সংগৃহীত।