ভারতীয় চলচ্চিত্রে বহু বার উঠে এসেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহসিকতা এবং বীরত্বের গল্প। দর্শকদের মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে ছবিগুলি। এর মধ্যে ‘বর্ডার’, ‘লক্ষ্য’, ‘শেরশাহ’-এর মতো অনেক ছবি রয়েছে।
এ বার বড়পর্দায় আসতে চলেছে ভারতীয় সেনার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ ক্ষেত্রপালের জীবন নিয়ে তৈরি ছবি ‘ইক্কিস’। ’৭১-এর যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন অরুণ। সেই গল্পই তুলে ধরবে ‘ইক্কিস’। ছবিতে তরুণ শহিদের চরিত্রে অভিনয় করবেন অমিতাভ বচ্চনের নাতি অগস্ত্য নন্দ।
নেটফ্লিক্সের ‘দ্য আর্চিস’-এর পর এটি অগস্ত্যের দ্বিতীয় ছবি। শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত ছবিতে রয়েছে সদ্যপ্রয়াত স্বনামধন্য অভিনেতা ধর্মেন্দ্র। ডিসেম্বরেই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা শ্রীরাম রাঘবন পরিচালিত ‘ইক্কিস’ ছবিটির।
ছবির কথা তো গেল। কিন্তু কে ছিলেন এই অরুণ ক্ষেত্রপাল? ভারতের সর্বোচ্চ সেনা-সম্মান পরমবীর চক্রের সে সময়ের সর্বকনিষ্ঠ প্রাপক অরুণের সঙ্গে জড়িয়ে এক সেনার বীরত্বের কাহিনি।
যে কোনও যুদ্ধই নায়কের জন্ম দেয়। আর এই নায়কদের ঘিরে তৈরি হয় নানা কিংবদন্তি। স্বাধীনতা-উত্তর যুগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এসেছেন এমন অনেক সেনা, অফিসার, যাঁদের সাহসিকতার গল্প আজও লোকের মুখে মুখে ঘোরে। অরুণও এঁদেরই এক জন।
১৯৫০ সালের ১৪ অক্টোবর পুণেয় অরুণের জন্ম। দুই ভাইয়ের মধ্যে অরুণ ছিলেন ছোট। তাঁর পরিবারের সঙ্গে ভারতীয় সেনার যোগ অনেক দিনের। অরুণের প্রপিতামহ শিখ খালসা সেনাবাহিনীতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। দাদু যুদ্ধ করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। বাবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার) এমএল ক্ষেত্রপাল ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার্স কোরের অফিসার।
ছোট থেকে বরাবরই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন অরুণ। পড়াশোনার বাইরে আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আগ্রহ ছিল তাঁর। খেলাধুলোতেও ছিলেন পারদর্শী। ১৯৬৭ সালে, অর্থাৎ মাত্র ১৭ বছর বয়সে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি (এনডিএ)-তে যোগ দিয়েছিলেন অরুণ। স্কোয়াড্রনকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বও পেয়েছিলেন।
এনডিএ-তে ফক্সট্রট স্কোয়াড্রনের সদস্য ছিলেন অরুণ। সেখানে তিনি ৩৮তম কোরের স্কোয়াড্রন ক্যাডেট ক্যাপ্টেন ছিলেন। পরে তিনি আইএমএ (ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি) থেকে স্নাতক হন এবং ১৯৭১ সালে ১৭ পুণে হর্স ব্যাটালিয়নে নিযুক্ত হন।
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত সামরিক মুহূর্তগুলির মধ্যে একটি। ১৩ দিনের অভিযানের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৩ হাজার পাক সেনা। প্রশস্ত হয় বাংলাদেশ তৈরির পথ।
অরুণ এবং তাঁর ব্যাটালিয়নকে শীঘ্রই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ডাকা হয়। ১৭ পুণে হর্স রেজিমেন্টকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪৭তম পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রেজিমেন্টটি শকরগড় সেক্টরে ছিল।
অরুণের স্কোয়াডের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল বসন্তর নদীর উপর একটি সেতুবন্ধ তৈরি করা এবং শত্রুপক্ষের দিকে নজর রাখা। সেই সেতুবন্ধ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি ফৌজ মাইন পুঁতে রাখার কারণে এগোতে পারেনি ভারতীয় সেনা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি সাঁজোয়া রেজিমেন্ট জারপালের শকরগড় সেক্টরে প্রথম আক্রমণ শুরু করে। ওই জায়গায় ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা কম ছিল। বিস্ফোরক পুঁতে রাখায় এগোতেও পারছিল না ভারতের সেনা। শত্রুর আক্রমণের ঝাঁজ দেখে স্কোয়াড্রন লিডার তৎক্ষণাৎ আরও সেনা পাঠানোর আবেদন করেন।
রেডিয়োয় সেই বার্তা পাওয়ার পর, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ ক্ষেত্রপাল প্রতিক্রিয়া জানান। ভারতের আক্রমণকে শক্তিশালী করার জন্য সেনা নিয়ে পৌঁছে যান যুদ্ধক্ষেত্রে। সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে বুঝতে পেরে ট্যাঙ্ক নিয়ে শত্রুপক্ষের উপর হামলা শুরু করেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট অরুণ।
কিছু ক্ষণ পরে আবার আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি সেনা। পাক সেনার আক্রমণের কারণে ভারতীয় সেনা বিপদে পড়ে। উদ্ধারের জন্য আবার এগিয়ে যান অরুণ। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হন তিনি।
এর পর ভয়াবহ ট্যাঙ্কযুদ্ধ শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে। নিহত হন অরুণের সঙ্গে থাকা দ্বিতীয় ট্যাঙ্কের কমান্ডার। এর পর শত্রুনিধনের দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নেন অরুণ। ট্যাঙ্ক নিয়ে পাক সেনার সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে যান তিনি। ট্যাঙ্ক নিয়ে পাকিস্তানের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলি আক্রমণ করেন। শত্রু সেনার ট্যাঙ্ক ধ্বংস করতেও সক্ষম হন।
বীরের মতো লড়াইয়ের সময় শত্রুর ছোড়া গোলা লেগে অরুণের ট্যাঙ্কে আগুন ধরে যায়। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ট্যাঙ্ক ছেড়়ে বেরিয়ে আসতে বলেন ঊর্ধ্বতনেরা। কিন্তু অরুণ রাজি হননি। ওই অবস্থাতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এক ঊর্ধ্বতন অফিসার তাঁকে ট্যাঙ্ক ত্যাগ করার নির্দেশ দিলে অরুণের শেষ কথা ছিল, ‘‘না, স্যর। আমি আমার ট্যাঙ্ক ত্যাগ করব না। আমার প্রধান বন্দুক এখনও কাজ করছে এবং আমি এই শয়তানদের ধরব।’’
দুর্ভাগ্যবশত এর পর আর বেশি ক্ষণ পাক সেনাকে ঠেকাতে পারেননি অরুণ। পাক সেনার আক্রমণে ধ্বংস হয় তাঁর ট্যাঙ্ক। একাধিক গুলি লাগে অরুণের শরীরে। তবে গুরুতর আহত অবস্থাতেও লড়াই চালিয়ে যান তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট।
গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগে ১০টি পাকিস্তানি প্যাটন ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেন অরুণ। শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্কশক্তির ভিত নাড়িয়ে দেন তিনি। তাঁর আত্মত্যাগ শকরগড়ে ভারতকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসে।
অরুণের দেহ এবং ট্যাঙ্ক পাক সেনাবাহিনীর হাতে পড়েছিল। পরে তা ভারতে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। অরুণের ট্যাঙ্কের নাম ছিল ‘ফামাগুস্তা’। বর্তমানে আহমদনগরের আর্মার্ড কোর সেন্টার অ্যান্ড স্কুলে প্রদর্শনের জন্য রেখে দেওয়া রয়েছে সেটি। তাতে যুদ্ধের চিহ্ন আজও দৃশ্যমান।
অরুণের সাহসিকতা এবং ত্যাগকে সম্মান জানিয়েছিল ভারত। তাঁকে মরণোত্তর পরমবীর চক্রে ভূষিত করা হয়। অরুণ যখন দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২১।
সব ছবি: সংগৃহীত।