পারদের মাত্রা ১০-এর নীচে নামলেই শীতের কামড়ে জবুথবু হয়ে যায় রাজ্যবাসী। জনজীবনেও তার প্রভাব পড়ে। দেশের শীতলতম স্থান দ্রাসের তাপমাত্রা কখনও-সখনও নেমে আসে মাইনাস ৪০ ডিগ্রিতেও। পৃথিবীর দ্বিতীয় শীতলতম এলাকা বলে পরিচিত এটি। আর পৃথিবীর শীতলতম স্থান যেটি সেখানে বছরের বেশির ভাগ সময়েই তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নীচে।
বাড়ির বাইরে বেরোলেই তীব্র বাতাস। শীতকালে তুষারঝড়ে বাইরে বেরোনো কার্যত অসম্ভব। তুষারঝড়ে বাইরে বেরোলেই জমে যায় পোশাক। মুহূর্তের মধ্যেই বাইরে কিছু ক্ষণ থাকলে যেখানে গোঁফ-দাড়ি-ভুরু পর্যন্ত জমে সাদা হয়ে যায়। পোশাক ঢেকে যায় সাদা বরফের আস্তরণে। ভয়ঙ্কর সেই শীত সামলেও এই শহরে বাস করেন ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষ।
ইউরোপের একটি শহর। রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তে সাইবেরিয়া এলাকার ছোট্ট শহর ইয়াকুৎস্ক। বিশ্বের শীতলতম শহর। পৃথিবীর উত্তর প্রান্ত থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে ইয়াকুৎস্ক। প্রায়ই তাপমাত্রা নেমে যায় হিমাঙ্কের ৪০ ডিগ্রি নীচে।
সাইবেরিয়ার এই শহরটির অধিবাসীদের প্রতি বছরই চরম আবহাওয়া সহ্য করে দিন গুজরান করতে হয়। সম্প্রতি ইয়াকুৎস্ক শহরে প্রবল ঠান্ডা পড়েছে। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচের ৫০ ডিগ্রিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এই বছর। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে শহর জমে গিয়েছে হিমাঙ্কের ৫৬ ডিগ্রি নীচের তাপমাত্রায়। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের ধারণা সেই তাপমাত্রা -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যেতে পারে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ইয়াকুৎস্ক শহরের তাপমাত্রার পারদ সবচেয়ে বেশি নেমে গিয়েছিল হিমাঙ্কের ৬৪ ডিগ্রি নীচে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে হিমাঙ্কের নীচে ৬২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গিয়েছিল শহরের তাপমাত্রা। বিগত দু’দশকের মধ্যে সবচেয়ে ঠান্ডা আবহাওয়া ছিল ওই বছরে।
তার আগে ১৮৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়াকুৎস্কের সর্বকালের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। থার্মোমিটারের সূচক হিমাঙ্কের নীচে ৬৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বারেও সেই রকম পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় বাসিন্দারা। কারণ তীব্র শীতের ইয়াকুৎস্ক দিনে চার ঘণ্টারও কম সূর্যালোক পায়।
সুমেরুবৃত্তের চেয়ে সাইবেরিয়ার এই শহরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। পৃথিবীর উত্তর প্রান্তের থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে ইয়াকুৎস্ক। শহরের গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাশিয়ার একেবারে পূর্বে রাজধানী মস্কো থেকে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইয়াকুৎস্ক। পৃথিবীর চিরহিমায়িত অঞ্চলের মধ্যে পড়ে এই শহর।
পৃথিবীর চরমতম আবহাওয়া হলেও ইয়াকুৎস্ক শহরের লোকসংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রায় ৩ লক্ষ ৫৫ হাজার। বাসিন্দাদের অধিকাংশ খনিশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। রাশিয়ার দ্রুত উন্নয়নশীল আঞ্চলিক শহরগুলির মধ্যে অন্যতম ইয়াকুৎস্ক। ইয়াকুৎস্কের রাস্তাঘাটে বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফের পুরু আস্তরণ জমে থাকে। তার উপর দিয়েই চলাফেরা করেন সকলে। শহর ঠান্ডায় জমে গেলেও জীবনপ্রবাহ সেখানে থেমে নেই।
প্রবল ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করেই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয় বাসিন্দাদের। তুষারঝড়ের তীব্র আঘাত থেকে দেহকে রক্ষা করার জন্য পরতের পর পরত গরম পোশাক পরাই ইয়াকুৎস্ক শহরের বাসিন্দাদের প্রধান এবং একমাত্র উপায়। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে নেমে গেলে ১০ থেকে ২০ মিনিটের বেশি বাইরে থাকলে দেহ অসাড় হয়ে প্রাণসংশয়ও ঘটতে পারে।
শহরের জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যাপক সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয় বাসিন্দাদের। পুরু আস্তরণযুক্ত গরম উলের তৈরি একাধিক পোশাক গায়ে চাপান তাঁরা। পায়ে বিশেষ উত্তাপযুক্ত হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা বুট। হাতে পশমের মোটা একাধিক দস্তানা। মাথায় মোটা উলের টুপি ও মুখ ঢাকা অন্তত দু’টি স্কার্ফে। বাইরে বেরোলে চোখের যেটুকু অংশ খোলা থাকে সেই পাতাতেই কয়েক মিনিটের মধ্যে বরফ জমতে শুরু করে।
দুটি স্কার্ফ এবং একাধিক স্তরের গ্লাভস, টুপি এবং হুড পরা না থাকলে এই শীতের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। সামঞ্জস্যপূর্ণ পোশাক পরতে হবে, নয়তো ঠান্ডার সঙ্গে সম্মুখসমরে হেরে যেতে হবে। তাই এখানকার সমস্ত বাসিন্দাই বাঁধাকপির মতো স্তরে স্তরে পোশাক পরতে অভ্যস্ত। তা নাহলে প্রবল এই ঠান্ডার সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। তাই বিশেষ ওই পোশাকই ভরসা।
এখানে ৩৬৫ দিন ২৪ ঘণ্টা সমস্ত ধরনের গাড়ির ইঞ্জিন চালু রাখার দস্তুর। ইঞ্জিনে তেল এবং ব্যাটারি জমে যাওয়া রোধ করতেই এই ব্যবস্থা। যানবাহনগুলি প্রায়শই উত্তপ্ত গ্যারেজে চালিয়ে রেখে দেওয়া হয়। শীতকালে অধিকাংশ বাসিন্দাই গণপরিবহণের উপর নির্ভর করেন। কারণ খোলা অবস্থায় গাড়ি বন্ধ করলে গাড়িগুলির ইঞ্জিন জমে নষ্ট হয়ে যায়। ভবিষ্যতে তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়।
শীতলতম এই শহরটি নিজেই আস্ত একটি প্রাকৃতিক রেফ্রিজ়ারেটর। সম্পূর্ণ শহরটি পারমাফ্রস্টের ওপর অবস্থিত। সারা বছর পুরু কঠিন বরফের আস্তরণে আবৃত মাটিকেই বলা হয় পারমাফ্রস্ট। তাই বাড়িগুলো খুঁটির ওপর নির্মিত হয় যাতে মাটির তাপের কারণে তা ধসে না পড়ে।
ইয়াকুৎস্কের বাড়িগুলি চরম জলবায়ু সহ্য করার জন্য সেই ভাবেই নকশা করা হয়েছে। বরফে জমা মাটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এড়াতে বাড়িগুলিকে কাঠ, কংক্রিট বা ইস্পাতের খুঁটির উপর তৈরি করা হয়। অন্য দিকে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলোতে সর্ব ক্ষণ কেন্দ্রীয় ভাবে উষ্ণ করার যন্ত্র চালানো হয়। আর এই উষ্ণতা ধরে রাখার জন্য একাধিক ‘ইনসুলেটেড’ দরজা থাকে।
প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে এই শহরে কিছুই নষ্ট হয় না। কারণ খোলা হাওয়ায় যে কোনও খাদ্যদ্রব্য রাখলেই তা জমে শক্ত বরফের চাঁইয়ের আকার ধারণ করে। বরফে ঢাকা রাস্তার উপর বরফ জমে যাওয়া মাছ বিক্রি করতে বসেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মাছ তাজা রাখতে রেফ্রিজ়ারেটরের প্রয়োজন হয় না। মাছের বাজারগুলিও গন্ধহীন। কারণ সব কিছুই হিমায়িত।
খাদ্যতালিকায় তাজা শাকসব্জির প্রচলন কম। তার পরিবর্তে সংরক্ষিত খাবার ও প্রোটিন সমৃদ্ধ স্থানীয় খাবার বেশি থাকে। মূলত মাংসকেই খাদ্যতালিকায় প্রথমে রাখতে পছন্দ করেন এখানকার অধিবাসীরা। তীব্র ঠান্ডায় শরীর গরম রাখতে গরম সুপ ও মাংসের ঝোল খুব জনপ্রিয়। অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়া মোকাবিলা করার জন্য খাদ্যতালিকায় রাখা হয় ঘোড়া, বল্গাহরিণ এবং খরগোশের মাংস।
পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হিমায়িত মাছ। তবে, ইয়াকুৎস্কের প্রিয় সুস্বাদু খাবার হল ঘোড়ার কাঁচা লিভার! এখানকার জনপ্রিয় খাবার পাতলা করে কাটা কাঁচা হিমায়িত মাছ বা মাংস। যদিও শীতকালে খাবার ও জ্বালানির খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে যায়।
তাতে অবশ্য কুছ পরোয়া নেই এখানকার বাসিন্দাদের। সোনা, ইউরেনিয়াম ও হিরের খনির কারণে বাসিন্দারা মোটা অর্থ উপার্জন করেন। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শহর ছেড়ে যেতে চান না বাসিন্দারা। শহর ঠান্ডায় জমে গেলেও জীবনপ্রবাহ সচল ইয়াকুৎস্কে।
সব ছবি: রয়টার্স ও সংগৃহীত।