১৮ বছর পেরোতে না পেরোতেই বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে চিনের ডিং লিরেনকে হারিয়ে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন দোম্মারাজু গুকেশ। ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার তথা প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দের শহর চেন্নাইয়ে জন্ম গুকেশের। বাবা ইএনটি চিকিৎসক। মা মাইক্রোবায়োলজিস্ট।
মাত্র ছয় বছর বয়সে দাবা খেলা শুরু গুকেশের। এক বছর পরেই অনূর্ধ্ব-৯ এশিয়ান স্কুল দাবা প্রতিযোগিতা জেতেন তিনি। গ্যারি ক্যাসপারভ ২২ বছর বয়সে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তাঁর রেকর্ড ভেঙে সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন গুকেশ। বিশ্বনাথন আনন্দের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন গুকেশ।
২০২৫ সালে গুকেশের মুকুটে যুক্ত হয় আরও একটি পালক। বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারান দাবার বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বয়ঃকনিষ্ঠ ভারতীয় দাবাড়ুর কাছে হার মেনে নিতে পারেননি কার্লসেন। রেগে টেবিলে ঘুষি মারেন তিনি। সেই ঘটনা নিয়ে তৈরি হয় বিতর্ক। পরে অবশ্য গুকেশের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেন তিনি।
গুকেশ যে দিন সিঙ্গাপুরে চিনা প্রতিপক্ষ লিরেনের সঙ্গে কালো ঘুঁটি নিয়ে খেলছিলেন, সে দিন তাঁর মা পদ্মাকুমারী এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে সেই ম্যাচটি তিনি দেখতে চাননি। সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ পদ্মার বোন গুকেশের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুখবরটি পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন গুকেশের মা। টানা ১০ মিনিট ধরে কেঁদেছিলেন ছেলের বিশ্বজয়ী হওয়ার সাফল্যে।
সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি গুকেশও। কাঁদতে দেখা গিয়েছিল তাঁকেও। এই বহুকাঙ্ক্ষিত দিনেরই অপেক্ষায় ছিলেন দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ বিজয়ীর পরিবারটি। ছেলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে গিয়েছেন বাবা রজনীকান্ত এবং পদ্মাকুমারী।
গুকেশের সাফল্যের ইতিহাস ঘাঁটতে হলে ফিরে তাকাতে হবে তাঁর শৈশবে। মাত্র ছ’বছরেই চৌষট্টি ছকের খেলায় মন মজেছিল ছোট্ট গুকেশের। ছেলের আগ্রহের চারাগাছে সমানে সার, জল জুগিয়েছিলেন গুকেশের মা-বাবা। বড় বড় প্রতিশ্রুতি নয়, বরং গুকেশকে সাহস ও শক্তি, ভরসা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা।
মাত্র ১২ বছর ৭ মাস ১৭ দিন বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হন তিনি। ভারতের কনিষ্ঠতম ও বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম (১২ বছর ৭ মাস বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন রাশিয়ার সের্গে কারজ়াকিন) হন গুকেশ। ভারতীয় দাবায় তাঁর উত্থান নজর কেড়েছিল সকলেরই।
সেই সাফল্যের কৃতিত্ব গুকেশের একার নয়। ভারতীয় দাবায় তাঁর উল্কার গতিতে উত্থানের পিছনে অবদান রয়েছে গুকেশের মা-বাবারও। প্রতিভার সঙ্গে পরিবারের আত্মত্যাগের মিশেলেই গুকেশের করায়ত্ত হয়েছে বিশ্বজয়ের খেতাব।
গুকেশের দাবা খেলায় যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য নিজের পেশা, পসার ত্যাগ করেছিলেন বাবা রজনীকান্ত। নাক-কান-গলার চিকিৎসক রজনীকান্ত পেশা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ছেলেকে নিয়ে দেশ-বিদেশের টুর্নামেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য। স্থানীয় টুর্নামেন্ট থেকে শুরু করে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের ম্যাচ পর্যন্ত তিনি সর্বদা গুকেশের পাশে ছিলেন।
চোখে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পিতা-পুত্র যখন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বে়ড়াচ্ছেন, তখন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিয়েছেন পদ্মাকুমারী। পেশায় মাইক্রোবায়োলজিস্ট পদ্মা পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন। ঘরে-বাইরে কোনও রকম ঝড়ঝাপটা গুকেশের গায়ে এসে লাগতে দেননি তিনি।
গুকেশ নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তাঁরা খুব একটা একটা সচ্ছল পরিবার ছিলেন না। দাবা খেলার জন্য শুরুর দিকে গুকেশের পরিবারকে আর্থিক সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু সেই সংগ্রামের আঁচ গুকেশের উপর পড়তে দেননি রজনীকান্ত ও পদ্মা। একটি সাক্ষাৎকারে দাবা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জানিয়েছিলেন ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের কোনও এক সময়ে তাঁর পরিবার এতটাই আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যে তাঁর বাবা-মায়ের বন্ধুরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
খেতাব জয়ের পর গুকেশ তাঁর বাবা-মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বলেন, ‘‘টুর্নামেন্ট খেলার জন্য বাবা-মাকে জীবনযাত্রায় প্রচুর পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। তাঁরাই আমার জন্য সবচেয়ে বেশি ত্যাগস্বীকার করেছিলেন।’’ মা পদ্মাকুমারী জানিয়েছিলেন, ছোট থেকেই গুকেশের মনঃসংযোগের অপরিসীম ক্ষমতা ছিল। দাবার জন্য শৈশবে সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন গুকেশ।
ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দের অ্যাকাডেমির ছাত্র ছিলেন গুকেশ। গুকেশ ২০২২ সালে অলিম্পিয়াডে একক বিভাগে সোনা জিতেছিলেন। ২০২৩ সালে সবচেয়ে কম বয়সে ২৭৫০ রেটিং পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। সেই বছর সেপ্টেম্বরে আনন্দকে টপকে ভারতীয়দের মধ্যে শীর্ষে উঠে এসেছিল গুকেশের নামটিই।
সিঙ্গাপুরে দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোটিপতিদের তালিকায় যুক্ত হয়েছে গুকেশের নাম। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে তিনটি ম্যাচ জিতে মোট ৫ কোটি ৭ লক্ষ টাকা জিতে নিয়েছিলেন গুকেশ। প্রতিযোগিতার পুরস্কারমূল্যের মধ্যে গুকেশের মোট প্রাপ্তি হয় ১৩.৫ লক্ষ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১১ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা।
গত বছরের (২০২৪ সাল) শেষ দিকে তরুণতম দাবাড়ু হিসাবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। অর্থের দিক থেকেও বাকিদের পিছনে ফেলেছেন তিনি। গুকেশ খেলাধুলো থেকে ১৩.৬ কোটি টাকা রোজগার করেছেন। এ ছাড়া বিশ্বসেরা হওয়ার পর তামিলনাড়ু সরকার তাঁকে পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছে। ক্যান্ডিডেটস জেতার পর স্কুলের তরফে গুকেশ পেয়েছেন একটি বহুমূল্যের গাড়ি।
সব ছবি: সংগৃহীত।