স্ত্রীর কথায় উঠছেন-বসছেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রেসিডেন্ট! কে বন্ধু আর কে শত্রু— চোখে আঙুল দিয়ে তাঁকে চিনিয়ে দিচ্ছেন সেই লাস্যময়ী অর্ধাঙ্গিনী। শুধু তা-ই নয়, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নাকি চলে গিয়েছে পর্দার আড়ালে থাকা বিদেশিনি ফার্স্ট লেডির হাতে। ফলে আর পাঁচজনের মতো তাঁকে স্বামী-সংসার ও ঘরকন্না সামলানো অতি সাধারণ বধূ বলে মানতে পারছেন না কেউই। উল্টে ক্ষুরধার মস্তিষ্কের গুপ্তচর বলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
তিনি মার্কিন ফার্স্ট লেডি তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৃতীয় স্ত্রী মেলানিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ইউক্রেনকে আমেরিকা ফের হাতিয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নতুন করে খবরের শিরোনামে এসেছেন তিনি। কিভের সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা অবশ্য তাঁকে গুপ্তচর বলে তাঁর প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। আদর করে ডাকছেন ‘এজেন্ট মেলানিয়া ট্রাম্পেনকো’ নামে।
বছর ৫৫-র ট্রাম্প-পত্নীর পদবির সঙ্গে ‘এনকো’ জুড়ে দেওয়া বিশেষ মর্যাদার শামিল। কারণ, ইউক্রেনে একে আভিজাত্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়। স্থানীয় ভাষায় শব্দটির অর্থ ‘বংশধর’ বা ‘পুত্র’। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, মার্কিন ফার্স্ট লেডিকে ‘ট্রাম্পেনকো’ বলে তাঁকে ‘ইউক্রেনের সন্তান’ আখ্যা দিতে চাইছে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই দেশ।
মেলানিয়ার প্রতি ইউক্রেনের এ-হেন কৃতজ্ঞতার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। যদিও কিভের সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা সেটা প্রকাশ্যে আনার আগেই গোটা বিষয়টি ফাঁস করে দেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি মনোভাব বদলের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছেন মার্কিন ফার্স্ট লেডি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কিছু দিন আগে পর্যন্ত মস্কোর দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে ‘ভাল মানুষ’ বলে দরাজ শংসাপত্র দিচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
চলতি বছরের ১৪ জুলাই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটো-র (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) মহাসচিব মার্ক রাটের সঙ্গে ওয়াশিংটনের ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) বৈঠক করেন ট্রাম্প। তখনই কোনও রাখঢাক না করে পুতিনের দ্বিচারিতা তুলে ধরতে স্ত্রী মেলানিয়া সাহায্য করেছেন বলে স্পষ্ট করেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যের পরেই দুনিয়া জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়।
ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘পুতিনের সঙ্গে কথোপকথন সব সময়ই খুব আনন্দজনক হয়। ঘরে ফিরে সেটা স্ত্রীকে জানাই আমি। ও জিজ্ঞাসা করেছিল, সত্যিই কি তা-ই? অবাক হয়ে দেখলাম সেই রাতেই ইউক্রেনের একাধিক শহরে আছড়ে পড়েছে মস্কোর ক্ষেপণাস্ত্র।’’ উল্লেখ্য, গত ৩ ও ৪ জুলাই রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। ওই কথোপকথনের সময়ে সংঘর্ষবিরতির জন্য ট্রাম্প চাপ দেন বলে জানা গিয়েছিল।
স্লোভেনীয় বংশোদ্ভূত মেলানিয়াকে অবশ্য ইউক্রেনবাসীর গুপ্তচর মনে করার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। কারণ, স্বামী ট্রাম্পের চেয়ে বরাবরই কিভের প্রতি অনেক বেশি দরদি ছিলেন তিনি। গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে ‘স্বৈরাচারী’ বলে উল্লেখ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তখন কিন্তু মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি।
১৯৭০-এর এপ্রিলে নভো মেস্তোতে জন্ম হয় মেলানিয়ার। তাঁর মাতৃভূমি স্লোভেনিয়া তখন ছিল সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্গত, ১৯৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে আলাদা হয়ে যার আলাদা দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ। ১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা পায় স্লোভেনিয়া। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওই বছরই রাশিয়া-সহ ১৫টি স্বাধীন দেশে ভেঙে গিয়েছিল কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে তৈরি হওয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান এলাকায় বেড়ে ওঠার কারণে সেখানকার রাজনীতি সম্পর্কে মেলানিয়া যে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিনের নির্দেশে ইউক্রেন আক্রমণ করে রুশ সেনা। তার পর থেকে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালিয়ে যাচ্ছে মস্কো। এই যুদ্ধ বাধার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজমাধ্যমে ভক্তদের কাছে ‘রেড ক্রস’-এ অনুদান দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প-পত্নী।
এ-হেন মেলানিয়াকে ‘গুপ্তচর’ প্রমাণ করার জন্য ইউক্রেনীয় সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীরা চেষ্টার ত্রুটি করেননি। এর জন্য মার্কিন ফার্স্ট লেডির একটি পুরনো ছবিকে হাতিয়ার করেছেন তাঁরা। সেখানে নীল রঙের টুপিতে অর্ধেক ঢাকা ছিল ট্রাম্প-পত্নীর মুখমণ্ডল। ব্লেজ়ারের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ওই টুপি পরেছিলেন তিনি। ব্লেজ়ারটির বাঁ দিকে বুকের উপর আঁকা ছিল ইউক্রেনের ত্রিশূল প্রতীক।
ইউক্রেনবাসীদের একাংশের দাবি, গত জানুয়ারিতে ট্রাম্পের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মেলানিয়ার গায়ে ছিল ওই ব্লেজ়ার। অনেকে অবশ্য বলছেন, হোয়াইট হাউসের অন্য একটি অনুষ্ঠানে ব্লেজ়ারটি পরেছিলেন তিনি। মজার বিষয় হল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কুর্সি পাওয়ার পর প্রথম দিকে গুজব ছড়িয়েছিল যে, তিনি রুশ গুপ্তচর। কারণ, তখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন তিনি।
গত ৪ জুলাই জ়েলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। সম্প্রতি সেই কথোপকথন ফাঁস হয় সংবাদমাধ্যমে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ওয়াশিংটন দূরপাল্লার হাতিয়ার দিলে মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গকে নিশানা করতে পারবে কিভ? জবাবে জ়েলেনস্কি জানান, তাঁর বাহিনী এই ধরনের আক্রমণ শানাতে সক্ষম।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এর পরেই কিভকে হাতিয়ার সরবরাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমগুলি জানিয়েছে, হাজার কোটি ডলারের অত্যাধুনিক হাতিয়ার নেটোভুক্ত দেশগুলির হাতে তুলে দেবেন ট্রাম্প। সংশ্লিষ্ট অস্ত্রগুলির মধ্যে থাকবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। পরে ওই দেশগুলি আমেরিকার হাতিয়ার পৌঁছে দেবে ইউক্রেনীয় ফৌজের কাছে।
গত ১৪ জুলাই নেটো মহাসচিব রাটের সঙ্গে বৈঠকের পর নতুন করে মস্কোকে শুল্ক-হুমকি দেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘৫০ দিনের মধ্যে রাশিয়াকে শান্তি সমঝোতায় আসতে হবে। নইলে ক্রেমলিনের বাণিজ্যিক বন্ধুদের উপরে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেব আমরা।’’ যদিও তাঁর ওই হুঁশিয়ারি সে ভাবে গায়ে মাখেননি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন।
সংবাদমাধ্যমের দাবি, গত ৩ ও ৪ তারিখ পুতিনের সঙ্গে শেষ বার ফোনে কথা বলেন ট্রাম্প। সেখানেও কোনও সমাধানসূত্র না বার হওয়ায় জ়েলেনস্কির সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। গত জুনে রুশ বায়ুসেনার একাধিক ছাউনিতে ড্রোন হামলা চালিয়ে তাদের একগুচ্ছ বোমারু বিমানকে ধ্বংস করে ইউক্রেন। কিভের ওই পরিকল্পিত আক্রমণে হকচকিয়ে যায় মস্কো। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকের দাবি, সেই কারণে জ়েলেনস্কিকে দূরপাল্লার হাতিয়ার দিয়ে ‘জুয়া’ খেলার সাহস পেয়েছেন ট্রাম্প।
ইউক্রেন যুদ্ধে শান্তি সমঝোতার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের ৫০ দিনের হুমকির পর এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছেন আমেরিকার সাবেক বিদেশমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাঁকে ওই পদে বসান ট্রাম্প। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝাতে ইরানের উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। পম্পেও বলেছেন, ‘‘ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি অবজ্ঞা করছিল তেহরান। সেই কারণে সাবেক পারস্য দেশে হামলা চালায় আমাদের কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান। তার পর ইজ়রায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ থামাতে বাধ্য হয় ইরান। রাশিয়ার এটা মনে রাখা উচিত।’’
তবে ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা মোটেই সহজ নয়। কারণ, পম্পেওর যুক্তি মেনে কখনওই ইরান ও রাশিয়াকে এক সারিতে রাখা সম্ভব নয়। পুতিনের হাতে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অস্ত্রভান্ডার। ঘুরপথে নেটোর মাধ্যমে কিভকে অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টি ভালই বুঝতে পারছেন তিনি। আর তাই মস্কো বা সেন্ট পিটার্সবার্গকে বাঁচাতে সরাসরি আমেরিকার উপর আণবিক বোমা ফেলার নির্দেশ দিতেই পারেন তিনি। সে ক্ষেত্রে বিপদে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র।
এ ছাড়া নেটোভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড এবং বাল্টিক দেশগুলিকে বাদ দিলে অনেকেই এই পদ্ধতিতে জ়েলেনস্কির কাছে দূরপাল্লার হাতিয়ার পৌঁছোনোর ঘোর বিরোধী। উদাহরণ হিসাবে ইটালি, গ্রিস, পর্তুগাল বা স্পেনের কথা বলা যেতে পারে। নেটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের আবার ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। এককালের ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ এখনও ব্যবহার করে মস্কোর তৈরি একাধিক হাতিয়ার।
আমেরিকা ঘুরপথে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার হাতিয়ার সরবরাহ করলে এবং ফের শুল্ক চাপালে আরও কাছাকাছি আসতে পারে রাশিয়া, ভারত ও চিন। পরমাণু শক্তিধর এই তিন দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট বড়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইরান, ব্রাজ়িল এবং উত্তর কোরিয়াকে পাশে পাবে মস্কো। বর্তমানে খুব সস্তায় মস্কোর থেকে খনিজ তেল কিনছে নয়াদিল্লি। মুদ্রাস্ফীতির হার ঠিক রাখতে তাই ট্রাম্পের হুমকি মেনে ক্রেমলিনের সঙ্গে থাকা ওই চুক্তি থেকে কেন্দ্রের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন।
আর তাই ট্রাম্প ও তাঁর স্ত্রী মেলানিয়াকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেওয়া ইউক্রেনবাসীকে সমালোচনায় বিঁধেছেন এক সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) করা একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘‘গত কাল পর্যন্ত যে ছিল ক্রেমলিনের এজেন্ট, ক্রাসনভের পুতুল আর গণতন্ত্রের জন্য হুমকি, সে-ই আজ হঠাৎ নায়ক হয়ে গিয়েছে। মনে রাখতে হবে ট্রাম্প আজ যা বলেন, কাল করেন ঠিক তার উল্টো কাজ। তাঁকে কিনে নেওয়া মস্কোর পক্ষে কঠিন নয়।’’ আমেরিকার বিদেশনীতি নির্ধারণে মেলানিয়ার কতটা প্রভাব রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।