গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে দেশ। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে ধার করা অর্থের পরিমাণ। পরিস্থিতি যা, তাতে ঠাটবাট বজায় রাখাই দায়! ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে দুনিয়ার তাবড় অর্থনীতিবিদদের। প্রশান্ত ও আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ রাষ্ট্রটি দেউলিয়া হলে তার আঁচ থেকে যে অন্যেরা বাঁচতে পারবেন, এমনটা নয়।
ঋণের ভারে বেঁকে যাওয়া দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সে দেশের জাতীয় ধারের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছে। এ বার তাই নজিরবিহীন ভাবে বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটনকে সতর্ক করল ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’ বা আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড)। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির দাবি, গত ১০০ বছরে এই প্রথম বার ঋণের নিরিখে ইটালি এবং গ্রিসকে ছাপিয়ে যেতে পারে আমেরিকা। অর্থাৎ, এককথায় একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে ওয়াশিংটনের অর্থনীতি।
আইএমএফের পদস্থ কর্তাদের অনুমান, ২০৩৫ সালের মধ্যে ‘মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ১৪৩.৪ শতাংশে পৌঁছোবে মার্কিন ঋণের অঙ্ক। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) এর সূচক দাঁড়িয়েছিল ১২৩ শতাংশে। সে ক্ষেত্রে ধারের নিরিখে গ্রিস এবং ইটালিকে পিছনে ফেলবে আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে বিশ্বের ‘সর্বাধিক শক্তিশালী’ রাষ্ট্র। কারণ এক দশক পর আথেন্স এবং রোমের জাতীয় ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির ১৩০ এবং ১৩৭ শতাংশ হবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতিমধ্যেই ৩৮ লক্ষ কোটি ডলার ছাপিয়ে গিয়েছে আমেরিকার জাতীয় ঋণ। বিশ্লেষকেরা অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ধারের সূচক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের কথায়, বছরের পর বছর ধরে প্রতিরক্ষা বা মহাকাশ গবেষণার মতো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় করে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। ফলে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে বাজেট ঘাটতি।
দ্বিতীয়ত, শেষ কয়েক দশকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ একেবারেই বাড়াতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। উল্টে সংশ্লিষ্ট সময়সীমায় ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে সুদের অঙ্ক। এর জেরে মূল ধারের টাকা দিতেই পারছে না মার্কিন সরকার। কেবলমাত্র সুদ পরিশোধ করে চলেছে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো বর্তমানে রাজস্বের তুলনায় ঋণের সুদবাবদ অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে আমেরিকাকে। এটাই দেশটির জাতীয় ধারকে ৩৮ লক্ষ কোটি ডলারে নিয়ে গিয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
‘আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার’-এর অনুমান, ২০৩৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকার বাজেট ঘাটতি ফি বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হারের সাত শতাংশের উপরে থাকবে। এর জেরে আগামী এক দশকে ঋণ পরিশোধ ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হতে চলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বছরে সুদ পরিশোধের অঙ্ক গত তিন বছরে আমেরিকার দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর সূচক পরিবহণ এবং শিক্ষা খাতের ব্যয় বরাদ্দকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের কথায়, যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার প্রতি বছর এক শতাংশ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে একটি অর্থবর্ষ শেষ হলেই মোট জাতীয় ঋণে যোগ হচ্ছে অতিরিক্ত ৩৮ হাজার কোটি ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে শপথ নেওয়ার পর বহু ক্ষেত্রে সরকারি খরচ কাটছাঁট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, সে কথা বলা যাবে না।
অন্য দিকে, ঋণের ব্যাপারে ইটালি এবং গ্রিস কিছুটা স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। ফলে শেষ ১০ বছরে কিছুটা কমেছে ভূমধ্যসাগরের কোলের এই দুই ইউরোপীয় রাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে আথেন্স ও রোমের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ। ফলে ২০৩৫ সালে পৌঁছে তাদের জিডিপি ও ঋণের অনুপাত কিছুটা হ্রাস পাবে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞ মহল।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’কে অবিলম্বে কড়া আইন পাশ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। ইউরোপ, এশিয়া হোক বা আফ্রিকা— ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমেরিকার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই রাস্তা ধরলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রকমের খারাপ হতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন জাতীয় ঋণ নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলে ‘কংগ্রেস বাজেট অফিস’। ওই সময় তাদের বক্তব্য ছিল, ২০৩০ সালের আগে আমেরিকার মোট ধারের অঙ্ক কোনও ভাবেই ৩৭ লক্ষ কোটি ডলার পেরোবে না। যদিও বাস্তবে মেলেনি সেই ভবিষ্যদ্বাণী। ২০৩০ সাল আসার অনেক আগেই ওই অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ।
মার্কিন সরকারি তথ্য বলছে, গত কয়েক দশকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ নেওয়ার অঙ্ক। চলতি শতাব্দীর গোড়ায় আমেরিকার জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল পাঁচ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু ২০২০ সালে সেই সংখ্যাই বেড়ে ২৩ লক্ষ ২০ হাজার কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছোয়। পরবর্তী বছরগুলিতে জাতীয় ঋণের সূচক লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।
২০২০ সালে দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় কোভিড অতিমারি। এর ধাক্কায় মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমেরিকার অর্থনীতি। সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে করোনা পরবর্তী সময়ে ঋণের উপর ঋণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সিদ্ধান্ত ওয়াশিংটনের বিপদ বাড়িয়েছে বলেই মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ‘ফেডারেল রিজ়ার্ভ’ জানিয়েছে, কোভিড-পরবর্তী বছরগুলিতে মোট ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে শেষ ৩১৬ দিনে জাতীয় ধারের অঙ্ক প্রতি দিন বেড়েছে ৬৩০ কোটি ডলার। ফলে বর্তমানে এক জন গড় আমেরিকানের মাথার উপর ঝুলছে এক লক্ষ আট হাজার ডলারের ঋণ।
ঋণের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় বর্তমানে দিনে ১০০ কোটি ডলারের বেশি সুদবাবদ খরচ করতে হচ্ছে আমেরিকাকে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, চলতি বছরে এক লক্ষ কোটি ডলারের গণ্ডি অতিক্রম করবে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের খরচ। এই অঙ্ক ওয়াশিংটনের জাতীয় নিরাপত্তা ব্যয়ের চেয়েও বেশি।
২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার ভবিষ্যদ্বাণী করে খবরের শিরোনামে আসেন সমীক্ষক সংস্থা ‘মুডিজ় কর্পোরেশন’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ মার্ক জ়ান্ডি। এ বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন তিনি। তাঁর দাবি, অচিরেই মহামন্দার কোপে পড়তে চলেছে ওয়াশিংটন। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) নিরিখে আমেরিকার প্রায় এক তৃতীয়াংশ প্রদেশের সূচক রয়েছে ঋণাত্মক। এতে মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
সংবাদসংস্থা ‘নিউজ়উইক’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরিস্থিতির বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন জ়ান্ডি। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ আমেরিকাবাসীদের জন্য দুঃসময় শুরু হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা শুরু হলে হু-হু করে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। খাদ্যসামগ্রীর জন্য আরও বেশি খরচ করতে হবে আমাদের। পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলিতে কর্মসংস্থানে আসবে বড় আঘাত। ফের এক বার গণহারে ছাঁটাই দেখতে পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।’’
প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর ভারত-সহ বিশ্বের একাধিক দেশের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে নেমেছেন ট্রাম্প। ‘মুডিজ়’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, এতে আমেরিকার শিল্প সংস্থাগুলির লাভের চেয়ে লোকসান হয়েছে অনেক বেশি। পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট নীতির জেরে ‘কৌশলগত অংশীদার’ বহু দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল দেখা গিয়েছে। ফলে বিদেশ থেকে শিল্পের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ কঠিন হচ্ছে। এর প্রভাব উৎপাদনের খরচে পড়ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
কিন্তু, তার পরেও শুল্কনীতি বদলাতে অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। গত ২৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নিচ্ছে তাঁর প্রশাসন। সম্প্রতি আবার ২৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের যুক্তি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে এই পদক্ষেপ করেছেন তিনি। পূর্ব ইউরোপের ওই সংঘাত শুরু হওয়া ইস্তক মস্কোর থেকে সস্তা দরে অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানি করে চলেছে নয়াদিল্লি। ট্রাম্প মনে করেন, এতে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। আর তাই রাশিয়াকে ‘ভাতে মারতে’ ভারতের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
গত ৩০ জুলাই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে নয়াদিল্লি ও মস্কোকে নিশানা করে একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। ওরা ‘মৃত অর্থনীতি’কে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। আমি সব কিছুর জন্য চিন্তা করি। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। একে বিশ্বের সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে প্রায় কোনও ব্যবসা নেই বললেই চলে।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেই শুরু হয় হইচই।
ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘মৃতবৎ’ বলা ট্রাম্পের রাতের ঘুম কাড়তে পারে বিপুল ঋণের বোঝা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-র মতো ডলার নিয়ে দিন দিন বাড়ছে উদ্বেগ। সমীক্ষক সংস্থা ‘ইওয়াই ইকোনমিক ওয়াচ’ আবার তাদের পূর্বাভাসে জানিয়েছে, আগামী ১৩ বছরের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে ভারত। পাশাপাশি, তালিকায় এক নম্বর স্থানে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গদি টলমল হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। সেখানে চিনের উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল বলেই মনে করছে তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।