Human Fingerprint

একটি আঙুলের ‘অনন্য’ ছাপ নিয়ে পুরনো ধারণা কি বদলে যাবে? অজানা দৃষ্টান্ত ‘খুঁড়ে’ বার করল কৃত্রিম মেধা

আঙুলের ছাপ। অপরাধের তদন্তে বা ফরেন্সিক বিশ্লেষণে এক গুরুত্বপূর্ণ নমুনা। দু’জনের আঙুলের ছাপ কখনও একরকম হয় না। কিন্তু একই মানুষের ভিন্ন ভিন্ন আঙুলের ছাপের মধ্যে কি কোনও মিল থাকতে পারে? এ বার মিলল সেই উত্তর।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৩
আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত গবেষণায় নতুন তথ্যের জোগান দিল কৃত্রিম মেধা।

আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত গবেষণায় নতুন তথ্যের জোগান দিল কৃত্রিম মেধা। — প্রতীকী চিত্র।

দু’জনের আঙুলের ছাপ কখনও একরকম হয় না। এমন কোনও দৃষ্টান্তও নেই। এমনকি বিশেষজ্ঞেরা এ-ও মনে করেন, কোনও এক জনের ১০টি আঙুলের ছাপের মধ্যেও মিল থাকে না। সত্যিই কি তাই? একই মানুষের ১০টি আঙুলের ছাপের মধ্যে কোনও মিল পাওয়া কি সত্যিই সম্ভব নয়? বহু বছরের প্রচলিত ধারণায় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে সাম্প্রতিক এক গবেষণা।

Advertisement

হাতের দশটি আঙুলের গড়ন আলাদা। ফলে তাদের ছাপও আলাদা আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছাপ আলাদা আলাদা হলেও এগুলির মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য সামঞ্জস্য রয়েছে। অপরাধের তদন্ত বা ফরেন্সিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে আঙুলের ছাপ সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণা নিয়ে এ বার প্রশ্ন উঠে গিয়েছে আমেরিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের এক সাম্প্রতিক গবেষণায়। কৃত্রিম মেধা (এআই) নির্ভর ওই গবেষণায় দাবি করা হচ্ছে, একই ব্যক্তির দু’টি ভিন্ন আঙুলের ছাপের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য মিল থাকতে পারে।

আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মিলে এই গবেষণাটি করেন। গবেষণার জন্য ৬০ হাজারেরও বেশি আঙুলের ছাপ ব্যবহার করেন তাঁরা। তার পরে একটি এআই টুলের মাধ্যমে ওই আঙুলের ছাপগুলি পরীক্ষা করে দেখেন গবেষকেরা। এআই নির্ভর ওই গবেষণায় দেখা যায়, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন আঙুলের ছাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল রয়েছে। দুই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের এই গবেষণাটি ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকদের দাবি, ফরেন্সিক বিশ্লেষণের প্রথাগত পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপে এই মিলগুলি ধরা পড়ে না। তবে কৃত্রিম মেধা ভিত্তিক যন্ত্রের মাধ্যমে ওই সাদৃশ্যগুলি চিহ্নিত করা যায়।

বস্তুত, কোনও এআই যন্ত্রই এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভাবে স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। ওই কৃত্রিম মেধাকে আগাম কিছু প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখতে হয়। যেমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই ভাবেই কাজ করে এআই। এ ক্ষেত্রেও গবেষণার জন্য ব্যবহৃত এআই যন্ত্রটিকে আগাম প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখা হয়েছিল। কোন আঙুলের ছাপগুলি একই ব্যক্তির, তা চিহ্নিত করার জন্য প্রশিক্ষিত ছিল ওই কৃত্রিম মেধা। এমনকি দু’টি আঙুলের ছাপ একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন আঙুলের কি না— তা-ও শনাক্ত করতে সক্ষম ছিল যন্ত্রটি।

আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের প্রথাগত পদ্ধতিতে অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের উপরে জোর দেওয়া হয়। যেমন আঙুলের ছাপের রেখাগুলির বিভাজন, বা সেগুলি কোথায় শেষ হচ্ছে— নির্দিষ্ট রেখার এমন বিবিধ বৈশিষ্ট্য পরখ করে দেখা হয় প্রথাগত পদ্ধতিতে। তবে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক এই গবেষণায় কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতির উপর নির্ভর করা হয়। এ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া হয়েছে আঙুলের ছাপের গড়নের উপরে। আঙুলের ছাপের রেখাগুলি কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে বা কোন দিকে এগিয়ে আছে— এমন বৈশিষ্ট্যগুলিতে বেশি গুরুত্ব দেন গবেষকেরা। তাতে দেখা যায়, একই ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন আঙুলের ছাপের মধ্যে বেশ কিছু মিল রয়েছে।

তবে এই গবেষণালব্ধ ফল পুরোপুরি নির্ভুল নয়। গবেষকদের দাবি, বিভিন্ন আঙুলের ছাপের মধ্যে কোনগুলি একই ব্যক্তির, তা ৭৫-৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল ভাবে চিহ্নিত করে পারে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক এই প্রযুক্তি। কিন্তু এই প্রযুক্তি কী ভাবে তা নির্ধারণ করে, সে বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত নন গবেষকেরা।

আমেরিকার এই গবেষকদলের প্রধান কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হড লিপসনের কথায়, “কৃত্রিম মেধা কী ভাবে এটি (নির্ধারণ) করে, তা আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না।” তাই এ বিষয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।

বিজ্ঞানীদের অনুমান, আঙুলের ছাপ নির্ধারণের এই নতুন পদ্ধতি ফরেন্সিক বিশ্লেষণে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধস্থলে বহু আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে আবার এমনও আঙুলের ছাপ মেলে, যা আংশিক। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ ছাপ নেই তাতে। সে ক্ষেত্রে দু’টি ছাপই একই সন্দেহভাজনের কি না, তা বোঝা যেতে পারে এই পদ্ধতিতে। এই সংক্রান্তও একটি পৃথক পরীক্ষা চালিয়েছেন আমেরিকার ওই গবেষকেরা। দু’টি ভিন্ন অপরাধস্থল থেকে পাওয়া একগুচ্ছ আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে দেখেন তাঁরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে ১০০০ জন সন্দেহভাজনের তালিকাও আগে থেকে দিয়ে রাখা হয় এআই টুলে। তাতে দেখা যায়, আঙুলের ছাপ শনাক্ত করে সন্দেহভাজনের সংখ্যা কমিয়ে ৪০ করে দিয়েছে কৃত্রিম মেধা। তবে প্রথাগত পদ্ধতিতে বিশ্লেষণ করা হলে ওই ১০০০ জনের মধ্যে প্রত্যেকের আঙুলের ছাপের প্রয়োজন হত।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকদলও মনে করছে, এ নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। এই গবেষকদলের অন্যতম সদস্য গ্যাবে-ও জানাচ্ছেন, এই পদ্ধতিতে ফরেন্সিক বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য আদালতে কোনও কিছু প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। তবে তদন্তে সাহায্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে এই পদ্ধতি।

যদিও আঙুলের ছাপ নিয়ে এই গবেষণা ফরেন্সিক ক্ষেত্রে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ব্রিটেনের হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন্সিক সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক গ্রাহাম উইলিয়ামসের মতে, দু’টি আঙুলের ছাপে যে কখনওই মিল পাওয়া যাবে না— তা নিশ্চিত ভাবে কখনও দাবি করা হয়নি। ফলে এই গবেষণাকে কোনও ‘বড় খবর’ বলে মানতে চান না তিনি। তাঁর কথায়, “মিল যে থাকবেই না, তা কোথাও পাথরে খোদাই করে লেখা নেই। মানুষের আঙুলের ছাপ সত্যিই স্বতন্ত্র কি না, তা আমরা কোনও দিনই জানতে পারিনি। তবে আমরা এটা বলতে পারি যে, একাধিক ব্যক্তির হাতে একইরকম আঙুল ছাপ থাকার কোনও ঘটনা আমাদের নজরে আসেনি।”

Advertisement
আরও পড়ুন