পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারক ওয়াই ক্রোমোজ়োমে জিনের সংখ্যা দিন দিন কমছে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
বাবা দেন ওয়াই, মা দেন এক্স—লিঙ্গ নির্ধারক এই দুই ক্রোমোজ়োমের সমন্বয়ে মাতৃজঠরে গড়়ে ওঠে পুরুষ ভ্রুণ। কিন্তু পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণকারী এই গুরুত্বপূর্ণ ওয়াই ক্রোমোজ়োমই নাকি বিলুপ্তির পথে! সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই ক্রোমোজ়োম হারিয়ে যেতে বসেছে, বিজ্ঞানীরা সে বিষয়ে নিশ্চিত। এখন প্রশ্ন, তা হলে কি মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের এখানেই ইতি? ওয়াই ক্রোমোজ়োম পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেলে কি পুরুষেরাও বিলুপ্ত হয়ে যাবেন? সে ক্ষেত্রে তো মানব সভ্যতায় লিঙ্গের ভারসাম্য আর থাকবে না। পাট চুকে যাবে মানুষেরও। তা-ই কি ভবিতব্য?
জীববিজ্ঞানী জেনি গ্রেভ্স মানুষ-সহ বিভিন্ন প্রাণীর বিবর্তন নিয়ে কাজ করেন। ২০০২ সালে তিনিই প্রথম পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজ়োমের আয়ু সম্পর্কে সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, গত ৩০ কোটি বছরে পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজ়োম ক্রমে বিলুপ্তির দিকে এগিয়েছে। উধাও হয়ে গিয়েছে প্রাচীন ওয়াই ক্রোমোজ়োমের ৯৭ শতাংশ জিনই। এ ভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক কোটি বছরেই পুরুষের এই ক্রোমোজ়োমটি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু তার অর্থ পুরুষের বিলুপ্তি নয়, দাবি গ্রেভ্সের। তিনি বলেন, ‘‘আগামী ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে পুরুষেরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটা যে কেন ভাবা হচ্ছে, কেনই বা তা নিয়ে পুরুষেরা উদ্বিগ্ন, আমি জানি না। পৃথিবীতে আমরা মানুষ হয়ে আছিই তো মাত্র এই কয়েক লক্ষ বছর ধরে।’’
ওয়াই ক্রোমোজ়োম না থাকলেও পুরুষেরা পৃথিবীতে থেকে যাবেন, দাবি গ্রেভ্স-সহ বিজ্ঞানীদের একাংশের। এ ক্ষেত্রে আপাতত তাঁদের ভরসা অন্য প্রাণীদের নিদর্শন। পৃথিবীর বুকে একাধিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, মাছ এবং কিছু সরীসৃপের জিন থেকে লিঙ্গ নির্ধারক বিশেষ সেক্স ক্রোমোজ়োম বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তবু তারা বহাল তবিয়তেই আছে। ইঁদুর শ্রেণির কিছু প্রাণীর শরীর থেকে নিঃশব্দে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে ওয়াই ক্রোমোজ়োম। পরিবর্তে অন্য ক্রোমোজ়োম সেই জায়গা নিয়েছে। এলোবিয়াস ট্যালপিনাস, এলোবিয়াস টানক্রেই এবং এলোবিয়াস অ্যালাইকাস নামের তিনটি ইঁদুরের শরীরে এখন রয়েছে শুধু এক্স ক্রোমোজ়োমই। ওয়াই ক্রোমোজ়োমের লিঙ্গ নির্ধারক জিন অন্যত্র সরে গিয়েছে। টোকুডাইয়া ওসিমেসিস নামের আরও এক ইঁদুরের শরীরে ওয়াই ক্রোমোজ়োমের জায়গায় এসেছে নতুন ক্রোমোজ়োম।
গ্রেভ্স বলেন, ‘‘যদি নতুন কোনও ক্রোমোজ়োম আমাদের ওয়াই-এর চেয়ে ভাল কাজ করে, তবে খুব দ্রুত তা ওয়াই-এর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। হয়তো ইতিমধ্যে পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কোনও মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সেই ক্রোমোজ়োম চলেও এসেছে। আমরা তো এখনই তা জানতে পারব না।’’ ওয়াই ক্রোমোজ়োমের ভূমিকাটি যদি মানবদেহের অন্য কোনও ক্রোমোজ়োমের মধ্যে স্থানান্তরিত হয়ে যায়, তবে পুরুষের শরীরে বিশেষ ফারাক হবে না। পুরুষ থাকবে এবং তাদের প্রজনন ক্ষমতাও অপরিবর্তিত থাকবে।
ওয়াই ক্রোমোজ়োমের ভবিতব্য নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীরা দু’ভাগে বিভক্ত। একাংশ গ্রেভ্সদের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। ওয়াই ক্রোমোজ়োম যে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, তা তাঁরা মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন, ওয়াই ক্রোমোজ়োম দীর্ঘ সংগ্রামের সম্মুখীন হয়েছে এবং তা টিকে থেকেছে। ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে। এই দ্বিতীয় তত্ত্বে বিশ্বাস করেন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জেন হিউজেস। ২০১২ সালে তিনি পরিসংখ্যান তুলে দেখান, গত ২.৫ কোটি বছরে মানবদেহ থেকে ওয়াই ক্রোমোজ়োম বিলুপ্তির হার অনেক কমেছে। অর্থাৎ, পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজ়োম স্থিতিশীল হচ্ছে। হিউজেসের কথায়, ‘‘আমরা একাধিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওয়াই ক্রোমোজ়োমের তুল্যমূল্য বিচার করে দেখেছি। প্রথম দিকে জিনের বিলুপ্তির হার খুব বেশি ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা স্থিতিশীল হয়েছে এবং একসময় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, আর কোনও জিন বিলুপ্তই হয়নি।’’ বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে হিউজেস বলেন, ‘‘আসলে ওয়াই ক্রোমোজ়োমের মধ্যে যে জিনগুলি থাকে, মানুষের শরীরে তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই শরীরে সেই জিন ধরে রাখার তাগিদও বেশি। আমাদেরই শরীরই একে সহজে হারিয়ে যেতে দেবে না।’’
গ্রেভ্স অবশ্য হিউজেসের এই যুক্তি মানেননি। শরীরে তার গুরুত্ব বেশি হলে এবং রক্ষণ শক্তিশালী হলেই যে কোনও জিন বিলুপ্ত হতে পারে না, তা তিনি মানতে চান না। তাঁর দাবি, সম্প্রতি মানুষের শরীরে ওয়াই ক্রোমোজ়োম কিছু বাড়তি জিন তৈরি করছে। সেগুলি অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। এটি বিলুপ্তির অন্যতম লক্ষণ বলে দাবি করেন গ্রেভ্স।
বিজ্ঞানীদের দাবি, স্তন্যপায়ীদের পূর্বপুরুষদের ক্ষেত্রে এক্স এবং ওয়াই ক্রোমোজ়োম অভিন্ন ছিল। একত্রে তাদের ছিল প্রায় ৮০০টি জিন। কিন্তু আজ থেকে ২০ কোটি বছর আগে পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণের ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে ওঠে ওয়াই ক্রোমোজ়োম। তখন থেকে পুরুষের শরীরে এক্স এবং ওয়াই মিলিত হওয়া বন্ধ করে দেয়। ওয়াই ক্রোমোজ়োম তার জিন হারাতে শুরু করে। তবে মেয়েদের শরীরে এক্স আরও একটি এক্স ক্রোমোজ়োমের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। তাই এই ক্রোমোজ়োমটি অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে। অন্য দিকে, জিন হারাতে হারাতে এখন ওয়াই ক্রোমোজ়োমে বিপন্ন। তাতে পড়ে আছে মাত্র তিন শতাংশ জিন। বিবর্তনকেই এর জন্য দায়ী করছেন বিজ্ঞানীরা।