মেসির হাতে স্মারক তুলে দিচ্ছেন রেবন্ত রেড্ডি (ডান দিকে)। ছবি: সমাজমাধ্যম।
এই শহর ফুটবলপাগল। ফুটবল তাদের ডিএনএ-তে। অথচ ফুটবলের রাজপুত্র লিয়োনেল মেসিকেই ভাল করে বরণ করে নিতে পারল না কলকাতা। শনিবার সকালে যুবভারতীয় ক্রীড়াঙ্গনে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হল। অথচ সন্ধ্যায় সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা গেল হায়দরাবাদে। কী ভাবে এত বড় মাপের তারকাকে নিয়ে সুষ্ঠ ভাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়, তা দেখিয়ে দিল নিজ়ামের শহর। প্রায় ৪০ মিনিট মাঠে থাকলেন মেসি। অথচ তাঁর গায়ে আঁচটিও পড়ল না। নিরুপদ্রবে হায়দরাবাদের জনতার মন জয় করে নিলেন মেসি।
কলকাতায় শনিবার সকালে যা হয়েছিল, তার পর দেশের বাকি শহরগুলিতে মেসির অনুষ্ঠান আদৌ হবে কি না তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়। মেসি অবশ্য দুপুরে নির্ধারিত সময়েই ব্যক্তিগত বিমানে হায়দরাবাদের উদ্দেশে রওনা দেন। বিকেল ৪.৩০টা নাগাদ তাঁর বিমান হায়দরাবাদের মাটি ছোঁয়। কলকাতার ঘটনার পরেই হায়দরাবাদে মেসিকে নিয়ে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই তাঁকে বিমানবন্দরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।
হায়দরাবাদের উপ্পল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা ৬টা থেকেই। তখন মেসি আসেননি। ঠিক সন্ধ্যা ৭.৫৭ মিনিটে হায়দরাবাদের উপ্পল স্টেডিয়ামে এসে দাঁড়ায় মেসির গাড়ি। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে যান স্টেডিয়ামে। তখন মাঠে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ চলছিল। দুই সতীর্থ লুই সুয়ারেজ় এবং রদ্রিগো ডি’পলকে নিয়ে ভিভিআইপি বক্সে দাঁড়িয়ে সেই ম্যাচ দেখতে থাকেন মেসি। কয়েক বার উচ্ছ্বসিতও হতে দেখা গিয়েছে লিয়োকে। মেসি মাঠে আসার পরেই মাঠে নামেন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডি। কয়েক মিনিটের মধ্যে তিনি একটি গোলও করেন।
মেসির সঙ্গে আলোচনা রাহুল গান্ধীর। ছবি: পিটিআই।
রাত ৮.১০ মিনিট নাগাদ মাঠে নামেন মেসি। গোটা স্টেডিয়াম তখন ‘মেসি, মেসি’ চিৎকারে উত্তাল। স্টেডিয়ামে বাজতে থাকে লাতিন ভাষায় গান। মাঠের মাঝে গিয়ে রেবন্ত, সুয়ারেজ় এবং ডি’পলের সঙ্গে ‘পাসিং দ্য বল’ খেলতে থাকেন মেসি। দু’বার তাঁকে দেখা যায় লম্বা শট মেরে গোল করতে। মাঝেমাঝেই বল পায়ে নিয়ে নাচাচ্ছিলেন তিনি। এর পর মাঠ প্রদক্ষিণ করতে থাকেন মেসি। সম্পূর্ণ নজর ছিল তাঁর দিকেই। মাঝখানে কয়েক বার থেমে ‘পাসিং দ্য বল’ খেলতে দেখা যায় মেসিকে। লম্বা শট মেরে বল গ্যালারিতেও পাঠান কয়েক বার।
কলকাতার সমর্থকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, স্টেডিয়ামে থাকা সত্ত্বেও মেসির আশেপাশে এত লোক ছিলেন যে তাঁরা ফুটবলের রাজপুত্রকে দেখতেই পাননি। তার ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা গেল হায়দরাবাদে। মেসি যত ক্ষণ মাঠে ছিলেন, তত ক্ষণ পুরো নজর ছিল তাঁর দিকেই। গোটা উন্মাদনা যাতে মেসিকে নিয়েই হয়, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মেসির আশেপাশে অনেকটা জায়গা রাখা হয়েছিল, যাতে দর্শকেরা ভাল ভাবে তাঁকে দেখতে পান।
কলকাতার সঙ্গে হায়দরাবাদের অনুষ্ঠানের মূল পার্থক্য হল, যুবভারতীতে মেসি নামতেই যে ভাবে ছবি এবং নিজস্বী শিকারিরা তাঁকে ঘিরে ধরেছিলেন, তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি হায়দরাবাদে। চিত্রসাংবাদিকেরা ছিলেন, তবে অনেক কম সংখ্যায়। হয়তো মাঠে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই নিরাপত্তার কড়াকড়ি বেশি ছিল। পাশাপাশি কলকাতার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়। মাঠে মেসি যত ক্ষণ ছিলেন, তত ক্ষণ তাঁর ধারেকাছে যেতে দেওয়া হচ্ছিল না কাউকে। খোদ রেবন্তও মেসির কাছে ঘেঁষছিলেন না বেশি। বাকিদেরও ধারেকাছে আসতে দিচ্ছিলেন না। জোর করে মেসির কাছে যেতেও দেখা যায়নি কাউকে। যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিল গোটা ব্যবস্থাপনায়। ফলে মেসিকে অনেক খোলা মনে দেখা গিয়েছে। কলকাতায় যে ভাবে মাঝেমধ্যে ঈষৎ বিরক্ত দেখিয়েছিল তাঁর মুখ, তা ছিল না হায়দরাবাদে। সব সময়েই মুখে লেগে থেকেছে হাসি।
এক ফ্রেমে (বাঁ দিকে) রেবন্ত, মেসি এবং রাহুল। ছবি: পিটিআই।
মাঠে ঢোকার পর সকলের সঙ্গে আগে পরিচিত হন মেসি। তার পর বাকিদের নিয়ে মাঠের এক দিকে দাঁড়িয়ে পড়েন। তখন ‘গোট কাপ’-এর শুটআউট হচ্ছিল। মেসির সামনেই টাইব্রেকারে গোল করেন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত। মেসিকেও দেখা যায় হাততালি দিতে। শট মেরে বল গ্যালারিতে পাঠানোর সময় এক বার মুখ্যমন্ত্রীর দিকে বল বাড়িয়ে দেন খোদ মেসি। রেবন্তও শট মেরে বল গ্যালারিতে পাঠান।
কলকাতায় মেসির মাঠ প্রদক্ষিণের সময় প্রচুর লোক তাঁকে ঘিরে ছিলেন। তার মধ্যে রাজনীতিবিদ, চিত্রসাংবাদিক, নিরাপত্তারক্ষী— সকলেই ছিলেন। অন্তত ২৫০-৩০০ লোক সর্ব ক্ষণ মেসিকে ঘিরে ছিলেন। সেই সংখ্যা হায়দরাবাদে যথেষ্ট কম ছিল। খুব বেশি হলে জনা ৫০-৬০। তবে মেসির কাছে কাউকেই আসতে দেওয়া হচ্ছিল না। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে ছবি তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মাঠ প্রদক্ষিণ করার পর একটি অস্থায়ী মঞ্চের সামনে নিয়ে যাওয়া হয় মেসিকে। রেবন্ত, সুয়ারেজ়, ডি’পলের সঙ্গে ডেকে নেওয়া হয় লোকসভায় বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীকেও। জয়ী দলের হাতে মেসি তুলে দেন ‘গোট কাপ’-এর ট্রফি।
তাঁর নাম লেখা আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসিকে দিয়ে সই করিয়ে নেন রেবন্ত। তার পর মেসির হাতে তুলে দেন একটি স্মারক। সুয়ারেজ়ের হাতে স্মারক তুলে দেন রাহুল গান্ধী। রেবন্তকে দেখা গিয়েছে মাইক হাতে ‘মেসি, মেসি’ বলে চিৎকার করতে। পাশে দাঁড়িয়ে লিয়ো তখন হাসছিলেন।
পরে মাইক তুলে দেওয়া হয় মেসির হাতে। স্পেনীয় ভাষায় তিনি যা বললেন তার অর্থ, “ভারতে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আপনাদের সকলের ভালবাসায় আমি আপ্লুত। এই ভালবাসার কথা মনে থাকবে চিরকাল। যে ভাবে আমাকে আপন করে নিয়েছেন তা ভাবাই যায় না। হায়দরাবাদের মানুষের ভালবাসায় আমি আপ্লুত।” কথা বলেন সুয়ারেজ় এবং ডি’পলও। ঠিক ৮.৫০ নাগাদ সকলের দিকে হাত নাড়িয়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান ফুটবলের রাজপুত্র।
শহরবাসীরা অ্যাপে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে নিশ্চিত ভাবে হাত কামড়েছেন। হওয়ার কথা ছিল কত কিছুই। কিন্তু...