SIR in West Bengal

প্রথমে মস্তিষ্কে স্ট্রোক, পরে হার্ট অ্যাটাক! লাঠিতে ভর দিয়ে সেই বৃদ্ধাও হাজিরা দিলেন কমিশনে, দুর্ভোগ শুনানির দ্বিতীয় দিনেও

হুগলিতে অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি এবং ভূমি সংস্কার)-এর দফতরে শুনানিকেন্দ্র খোলা হয়েছে। রবিবার সেখানে দেখা মিলল প্রবীণ গৌরী মান্নার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। লাঠি নিয়ে কোনও ভাবে চলাফেরা করেন। বাড়িতে বেশির ভাগ সময়ই থাকেন শয্যাশায়ী। রবিবার সেই বৃদ্ধাকেও নথি যাচাই করানোর জন্য যেতে হয় শুনানিকেন্দ্রে।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:৪৪
রবিবার হুগলিতে শুনানিকেন্দ্রের বাইরে ইনহেলার হাতে অপেক্ষায় বৃদ্ধা।

রবিবার হুগলিতে শুনানিকেন্দ্রের বাইরে ইনহেলার হাতে অপেক্ষায় বৃদ্ধা। — নিজস্ব চিত্র।

ভোটার শুনানির দ্বিতীয় দিনেও হয়রানির অভিযোগ পিছু ছাড়ল না নির্বাচন কমিশনের। রবিবারও দেখা গেল অনেক জায়গাতেই অসুস্থ এবং প্রবীণেরা এসে লাইন দিয়েছেন শুনানিকক্ষের বাইরে। রবিবারও দেখা গেল, অব্যবস্থার অভিযোগ তুলে কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন বয়স্ক ভোটারেরা এবং তাঁদের পরিজনেরা। শনিবার যে বিক্ষিপ্ত অভিযোগ উঠে এসেছিল, তা অব্যাহত রইল শুনানির দ্বিতীয় দিনেও।

Advertisement

হুগলিতে অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি এবং ভূমি সংস্কার)-এর দফতরে শুনানিকেন্দ্র খোলা হয়েছে। রবিবার সেখানে দেখা মিলল প্রবীণ গৌরী মান্নার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। লাঠি নিয়ে কোনও ভাবে চলাফেরা করেন। বাড়িতে বেশির ভাগ সময়ই থাকেন শয্যাশায়ী। রবিবার সেই বৃদ্ধাকেও নথি যাচাই করানোর জন্য যেতে হয় শুনানিকেন্দ্রে। ছেলে প্রসেনজিৎ মান্নাকে সঙ্গে নিয়ে টোটোয় চেপে কোনও ক্রমে এসে পৌঁছেছেন অতিরিক্ত জেলাশাসকের দফতরের সামনে।

অতীতে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হয়েছিল গৌরীর। পরে হার্ট অ্যাটাকও হয়েছিল বলে দাবি পরিবারের। ইনহেলার ছাড়া এক মুহূর্তেও চলতে পারেন না বৃদ্ধা। আগে পরিচারিকার কাজ করতেন। এখন অসুস্থতা এবং বয়সজনিত কারণে সেই কাজও ছেড়েছেন। অসুস্থ মায়ের এমন হয়রানি দেখে কমিশনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বৃদ্ধার পুত্রও। হুগলির এই ভবনে শুনানিকক্ষ করা হয়েছে উপরের তলে। সিঁড়ি ভেঙে সেখানে যাওয়ার মতো হাঁটুতে বল নেই বৃদ্ধার। ভবনের একতলাতেই অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। প্রশ্ন করায় বললেন, “খুব কষ্ট হচ্ছে বসে থাকতে।” পরে অবশ্য কমিশন নিযুক্ত আধিকারিকেরা নীচে এসে বৃদ্ধার শুনানি করেন।

৮০ বছর বয়সেও শুনানিকেন্দ্রে

হুগলির ওই শুনানিকেন্দ্রে রবিবার যেতে হয় ৮০ বছর বয়সি সুষেনকুমার রায়চৌধুরীকেও। অতীতে পা ভেঙেছিল। কোমর ভেঙেছিল। হৃদযন্ত্রেও সমস্যা রয়েছে বৃদ্ধের। এখন তাঁর বুকে পেসমেকার বসানো। চোখেও ঠিকঠাক দেখতে পান না। গ্লুকোমা হয়েছে। বয়সজনিত কারণে কানেও ঠিকঠাক শুনতে পান না। সেই বৃদ্ধকেও রবিবার লাঠিতে ভর দিয়ে পৌঁছোতে হয়েছে শুনানিকেন্দ্রে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে হাঁফ ধরে যায় তাঁরও। বসে কিছু ক্ষণ জিরিয়ে নেন। তার পরে কমিশন নিযুক্ত আধিকারিকদের অনুরোধ করায়, তাঁর শুনানি আগে করে দেওয়া হয়।

‘রাজ্যবাসীর জন্য শাস্তি’

শুনানিতে বয়স্ক ভোটারদের হয়রানির অভিযোগে ইতিমধ্যে সরব হয়েছে তৃণমূল। রবিবার সকালে সমাজমাধ্যমে একটি পোস্টে এই শুনানি প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে রাজ্যের শাসকদল। এসআইআর-এর শুনানিকে রাজ্যবাসীর জন্য এক শাস্তিমূলক প্রক্রিয়ায় পরিণত করা হয়েছে বলে কমিশনকে নিশানা করেছে তৃণমূল। পোস্টে তারা লিখেছে, ‘বয়স্ক, অসুস্থ এবং শয্যাশায়ীদেরও ভোটারদের রক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটি এক জঘন্য নিষ্ঠুরতা। প্রবীণ নাগরিকদেরও হুইলচেয়ারে এনে লাইনে দাঁড় করানো হচ্ছে। শুনানিতে হাজির করানো হচ্ছে। এটা কি বিজেপি বা নির্বাচন কমিশনের বিবেককে একটুও নাড়া দেয় না?’

কমিশনের এই শুনানি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হুগলির শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কমিশনকে ‘অমানবিক’ বলে বিঁধে কল্যাণের প্রশ্ন, “এটা কি হিয়ারিং হচ্ছে? অসুস্থ মানুষদের টেনে তুলে নিয়ে যেতে হচ্ছে।” তৃণমূল সাংসদ আরও বলেন, “এটা বিজেপির এজেন্ডা নির্বাচন, যা কমিশনের মাধ্যমে আসছে। বাঙালিকে সহ্য করতে পারে না। যত অবাঙালি আছেন, তাঁদের সকলের নাম আছে। বাঙালি হলেই বাদ।”

ভোটারদের হয়রানির অভিযোগ তুলে রবিবার হাওড়ার ডোমজুড়ে মিছিল করে তৃণমূল। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ডোমজুড়ের তৃণমূল বিধায়ক কল্যাণ ঘোষ। শনিবারও ভোটারদের হয়রানির অভিযোগে সরব হয়েছিলেন তিনি। কেন বয়স্ক ভোটারদের তিনতলায় শুনানি কক্ষে যেতে হচ্ছে, তা নিয়ে কমিশন নিযুক্ত আধিকারিকদের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন বিধায়ক। পরে একতলায় শুনানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ বার ভোটারদের হয়রানির অভিযোগে রাস্তায় নামলেন বিধায়ক।

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে বিপাকে তরুণী

আবার নদিয়ার রানাঘাটে দেখা গেল বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের জেরে বিপাকে পড়েছেন এক তরুণী। রানাঘাটের বাসিন্দা মানু মিত্রের বয়স ২৮ বছর। জন্ম ১৯৯৭ সালে। সেই সময় তাঁর জন্ম শংসাপত্র এবং স্কুলের নথিতে বাবার নাম হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছিল প্রবীর দাসের নাম। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই মানুর মায়ের সঙ্গে প্রবীরের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। পরবর্তী সময়ে মানুর মা রানাঘাটের দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা তিমির ঘোষকে বিবাহ করেন। শৈশব থেকেই তিমিরবাবুর পরিচয়েই বড় হয়েছেন মানু। আধার থেকে ভোটার কার্ড— সমস্ত নথিতেই এখন তিমিরবাবু তাঁর বাবা। এমনকি বর্তমানে বিবাহিত মানুর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাতেও তিমিরবাবুর নামই নথিভুক্ত। এ দিকে ২০০২ সালের তালিকায় নাম নেই তাঁর মায়ের। নিয়ম অনুযায়ী, এমন ক্ষেত্রে মানুকে তাঁর নিজের জন্ম শংসাপত্র পেশ করতে হয়েছে। আর সেখানেই রয়ে গিয়েছে পুরনো বাবার নাম। ফলে সমস্যায় পড়েছেন তরুণী।

বিএলও-র আত্মহত্যা

এসআইআর-এর শুনানি পর্বেও আত্মঘাতী হয়েছেন এক বিএলও। রবিবার বাঁকুড়ার রানিবাঁধ এলাকায় স্কুলের ক্লাসরুম থেকে উদ্ধার হয় ওই বিএলও-র ঝুলন্ত দেহ। মিলেছে একটি সুইসাইড নোট-ও। দাবি করা হচ্ছে, এসআইআর সংক্রান্ত কাজের চাপের কারণেই আত্মহত্যা করেছেন হারাধন মণ্ডল নামে ওই বিএলও। ওই নোটে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি আর চাপ নিতে পারছি না। বিদায়।’’ তার পরের লাইনে হারাধন লেখেন, ‘‘এই বিএলও কাজের জন্য আমিই দায়ী। এর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। ভুল আমার।’’ তার পরে নিজের পুত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন ওই বিএলও। নোটে তিনি দাবি করেছেন, তাঁর পুত্রকে তিনি কোনও কাজ করতে দেননি। সব কাজ নিজেই করেছেন। হারাধন আরও লেখেন, ‘‘আমি কাউকেই বিশ্বাস করি নাই। সব ঠিক করেও ভুল করলাম। ক্ষমা কর আমাকে।’’

Advertisement
আরও পড়ুন