BJP’s Organisation Survey

সংগঠনের অন্দরে তিনটি ধাপে ‘এসআইআর’ বিজেপির, পূর্ণ আস্থা নয় সরেজমিন হিসাবেও, বঙ্গ জুড়ে ডিজিটাল হিসাব যাচাই

তৃণমূলও সাংগঠনিক কাজে ডিজিটাল মাধ্যমকে অনেক দিন ধরে ব্যবহার করছে। কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে কর্মীদের কাছে দলের বার্তা পাঠানো, দলীয় নির্দেশিকা পৌঁছে দেওয়া, কর্মসূচি পালনে নজরদারি— এমন অনেক কিছুই ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামলায় তৃণমূল।

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৭
BJP conducts three-phase ‘SIR’ inside party in Bengal, Manual reports are being corroborated by two-step Digital Endeavours

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ভোটার তালিকার ‘বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা’ (এসআইআর) করাচ্ছে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কমিশনের আগেই সেই কাজ শুরু করে দিয়েছিল বিজেপি। এ বার সেই ‘এসআইআর’-এর ফলাফল ডিজিটাল পদ্ধতিতে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। অবশ্য ভোটার তালিকায় নয়, বিজেপি ওই ‘এসআইআর’ করছিল নিজেদের সাংগঠনিক কাঠামোর তালিকায়। গ্রাম-গ্রামান্তর ঘুরে সাংগঠনিক পরিস্থিতির হিসাব হাতেকলমে তুলে এনেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা-কর্মীরা। কিন্তু সেই হিসাবকে এবার ‘ডিজিটাল’ পদ্ধতিতে যাচাই করা হচ্ছে। এক ধাপে নয়, পর পর দু’ধাপে দু’রকম ‘ডিজিটাল’ অভিযান চালানো হচ্ছে। হিসেবে ‘জল’ মিশিয়ে সংগঠনকে কুক্ষিগত রাখার প্রবণতা এ রাজ্যের রাজনীতিতে পুরনো। বঙ্গ বিজেপি-কে তা থেকে টেনে বার করতে সচেষ্ট দিল্লি।

Advertisement

সাংগঠনিক নির্বাচন পর্বে বুথ, মণ্ডল, জেলা স্তরের যে সব হিসাব রাজ্য দফতরে পৌঁছচ্ছিল, তা প্রকৃত চিত্র নয় বলে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এক বৈঠকে দাবি করেছিলেন। তাই গত ৪ জুন থেকে রাজ্যে ‘বুথ সশক্তিকরণ অভিযান’ নতুন করে শুরু করিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকেরা। খাতাকলমের হিসাব আর বাস্তব সাংগঠনিক চেহারার মিল কতটা, তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে সেই সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে রাজ্য স্তরের দল জেলায় যায়। জেলা স্তরের দল মণ্ডলে যায়। মণ্ডল স্তরের দল বুথে বুথে পৌঁছোয়। এই ভাবে গোটা রাজ্য থেকে দলের প্রকৃত সাংগঠনিক শক্তির হিসেব তুলে আনা হয়। তার পরে ‘ডিজিটাল’ পদ্ধতিতে তা ফের খতিয়ে দেখা হয়। সেই কাজ শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দ্বিতীয় ডিজিটাল সমীক্ষা শুরু করতে চলেছে বিজেপি।

প্রথম ডিজিটাল সমীক্ষা

এই পর্যায়ে যাচাই করা হয়েছে কমিটি সদস্য তথা পদাধিকারীদের নাম-ঠিকানা। অর্থাৎ, যে অঞ্চলের দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সেই অঞ্চলেরই বাসিন্দা বা ভোটার কি না। রাজ্য স্তর থেকে একটি লিঙ্ক একেবারে বুথ স্তর পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল। সেই লিঙ্কে ঢুকে নিজেদের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্রের দু’টি পিঠেরই ছবি ‘আপলোড’ করতে বলা হয়েছিল। বিজেপি সূত্রের দাবি, প্রায় দেড় লক্ষ নেতা-কর্মীর সচিত্র পরিচয়পত্রের ছবি আপলোড হয়েছে। যে সব বুথে দলের শক্তি কম, সেখানকার কমিটিতে আশপাশের বুথের কর্মীদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে কি না, তা যাচাই করা গিয়েছে এই পদ্ধতিতে। কারণ, ভোটার পরিচয়পত্রের নম্বর মিলিয়েই বুঝে নেওয়া গিয়েছে কে কোন এলাকার ভোটার।

দ্বিতীয় ডিজিটাল সমীক্ষা

এই পর্বের সমীক্ষা শুরু হচ্ছে অগস্টে। ৪ অগস্ট একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হচ্ছে। তার আগের তিন দিনে বিভিন্ন জেলা কমিটি গঠন এবং আরও কিছু বিষয় নিয়ে লাগাতার বৈঠক করবেন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক এবং রাজ্য নেতারা। তার পরেই প্রশিক্ষণ শিবির ডাকা হয়েছে। যাঁরা ‘বুথ সশক্তিকরণে’র কাজ করছিলেন, মূলত তাঁদেরই এই প্রশিক্ষণ শিবিরে ডাকা হচ্ছে। বিজেপির তরফ থেকে একটি ‘মোবাইল অ্যাপ’ সেই প্রশিক্ষণ শিবিরে দেখা যাবে। অ্যাপ হাতে নেতৃত্বের প্রতিনিধিরা সংগঠনের একেবারে নীচের স্তর পর্যন্ত পৌঁছোবেন। যে সব অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক ভাল নয়, সেখানে বেশ কয়েকটি গ্রামের দলীয় পদাধিকারী তথা কমিটি সদস্যদের একসঙ্গে কোনও একটি জায়গায় ডেকে নেওয়া হবে। যেখানে নেটওয়ার্ক ভাল। ওই অ্যাপে কমিটি সদস্যদের ফোন নম্বর টাইপ করলেই তাঁদের নাম, ঠিকানা, বুথ নম্বর-সহ বিশদ বিবরণ বেরিয়ে আসবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বুথ ও মণ্ডল স্তরের কর্মীদের সম্পর্কে রাজ্য নেতৃত্বের সার্ভারে জমা তথ্য সামনাসামনি বসে যাচাই করা যাবে।

রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলও সাংগঠনিক কাজে ডিজিটাল মাধ্যমকে অনেক দিন ধরে ব্যবহার করছে। কোনও নির্দিষ্ট বিষয়ে কর্মীদের কাছে দলের বার্তা পাঠানো, দলীয় নির্দেশিকা পৌঁছে দেওয়া, কর্মসূচি পালনে নজরদারি— এমন অনেক কিছুই ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামলায় তৃণমূল। কিন্তু শুধু সাংগঠনিক কাঠামোর হিসাব নির্দিষ্ট করতে এত রকমের ডিজিটাল অভিযান বিজেপি ছাড়া কোনও দল করেছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিজেপি নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘দুটো কারণে এই বন্দোবস্ত। প্রথম কারণ, সাংগঠনিক শক্তির হিসেবে জল মেশানো পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির অনেক দশকের অভ্যাস। তা পুরোপুরি নির্মূল করতে হলে বার বার সমীক্ষা হওয়া জরুরি ছিল। দ্বিতীয় কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সংগঠন কুক্ষিগত রাখতে ‘ভুয়ো সদস্য’ বা ‘ভূতুড়ে কর্মী’দের তালিকা তৈরি রাখার বহু বছরের অভ্যাস। কংগ্রেসেও একই প্রবণতা ছিল। এমনকি, সিপিএমেও সংগঠন কুক্ষিগত রাখতে ভোটাভুটি এড়িয়ে উচ্চতর নেতৃত্বের পাঠানো প্যানেল অনুমোদন করানোর চেষ্টা বরাবর দেখা গিয়েছে। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেই প্রবণতাও নির্মূল করতে চান।’’

যে প্রবণতাকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্মূল করতে চাইছেন বলে বিজেপি সূত্রের দাবি, সেই প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গের পুরনো বাস্তবতা। অনেকে এ প্রসঙ্গে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবের নির্বাচনে ‘ভূতুড়ে ভোটার’দের দাপটের কথাও মনে করাচ্ছেন। অনেকে আবার কংগ্রেসের সেই সাংগঠনিক নির্বাচনের উদাহরণ টানছেন, যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় নেত্রীকে সোমেন মিত্রের কাছে হারতে হয়েছিল। তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেসকে ‘কুক্ষিগত’ রাখতে সোমেন বড় সংখ্যায় ‘ভুয়ো সদস্য’ দলে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন বলে এখনও অনেক প্রবীণ নেতা দাবি করেন। যাঁকে রুখতে সে সব ‘কারসাজি’, সেই মমতা এ রাজ্যে কংগ্রেসকে ছাপিয়ে গিয়েছেন বহু বছর আগেই। উল্টো দিকে সে সময়ের একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল কংগ্রেস এখন রাজ্যে প্রান্তিক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রধান বিরোধীদলকে যাতে কখনও তেমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, তার জন্য আগে থেকেই সতর্ক হচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

Advertisement
আরও পড়ুন