BJP Mahila Morcha

মহিলা মোর্চা থেকে ‘চটকদার’ উত্থানে ভর করে বঙ্গ বিজেপির প্রথম সারিতে তিন ‘নব্য’ মুখ, রূপা-লকেট-অগ্নিই কি ‘দৃষ্টান্ত’

রূপা, লকেট, অগ্নিমিত্রাদের জমানায় বিজেপির মহিলা মোর্চা যতটা নজর কাড়ছিল, পরবর্তী দুই সভানেত্রী তনুজা চক্রবর্তী বা ফাল্গুনী পাত্র কি ততটা সফল? এ প্রশ্ন বিজেপির অন্দরেও রয়েছে। আরজি কর কাণ্ডের উত্তাল প্রতিবাদ চলাকালীন ফাল্গুনী ছিলেন মহিলা মোর্চার শীর্ষ পদে। ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন?

Advertisement
ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৫ ০৯:০৩
Is Mahila Morcha a good political launching pad for successful women from glamour world in Bengal, Roopa-Locket-Agni’s tenure sparks discourse

(বাঁ দিক থেকে) রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দ্বন্দ্বের একাধিক উপকরণ মজুত। ‘আদি-নব্য’ দ্বন্দ্ব। ‘খাঁটি-বহিরাগত’ দ্বন্দ্ব। সে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব সামলাতে পাল্টা দৃষ্টান্তও মজুত বিজেপিতে। রূপা-লকেট চান? না কি ফাল্গুনী? অগ্নিমিত্রা চান, না কি তনুজা?

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নতুন সভাপতি পাওয়ার পর দলের অন্দরে এখন অন্যান্য পদাধিকারী বাছাই ঘিরে জোর তৎপরতা। সেই সন্ধিক্ষণে ‘আদি বিজেপি’ বা ‘খাঁটি বিজেপি’ গোছের কোনও শংসাপত্র গলায় ঝুলিয়ে কেউ অগ্রাধিকার পাওয়ার চেষ্টা করলে উঠে আসছে মহিলা মোর্চার গত ১০ বছরের ইতিহাস। ‘বহিরাগত’দের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করলে এসে পড়ছে মহিলা মোর্চার শেষ পাঁচ সভানেত্রীর মেয়াদের লেখচিত্র।

রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অগ্নিমিত্রা পাল। ২০১৫ থেকে ২০২১ পর্যন্ত পর পর রাজ্য মহিলা মোর্চার তিন সভানেত্রী। তিন জনের কেউই ‘আদি’ বিজেপি নন। বরং ‘বহিরাগত’। প্রথম দু’জন অভিনয় এবং তৃতীয় জন ফ্যাশন দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জনের পরে রাজনীতিতে এসেছিলেন। প্রথম জন বিজেপির ‘রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণী’তে (জাতীয় কর্মসমিতি) পৌঁছে গিয়েছেন। বাকি দু’জন দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। রূপা, লকেট সাংসদও হয়েছেন। অগ্নিমিত্রা বিধায়ক। তিন জনে মিলে মোট বছর ছয়েক রাজ্য মহিলা মোর্চাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই ছ’বছরে এ রাজ্যে বিজেপির মহিলা শাখা যতটা নজর কেড়েছিল, আগেও তেমন দেখা যায়নি, পরেও যাচ্ছে না।

লকেট ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে হেরে গিয়েছেন। নতুন রাজ্য কমিটিতে গুরুদায়িত্ব পাবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর টিকিটপ্রাপ্তি প্রায় নিশ্চিত। কারণ, ২০১৯ সালের ভোটে তিনি হুগলির মতো ‘কঠিন’ লোকসভা আসনে জিতেছিলেন। তবে একই সঙ্গে এ-ও ঠিক যে, লকেট ২০২১ সালের বিধানসভা চুঁচুড়া কেন্দ্র থেকে ভোটে জিততে পারেননি। তার পরে হেরেছেন লোকসভাতেও। তার মাঝে ২০২২ সালে উত্তরাখণ্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পর্যবেক্ষক হিসেবে সে রাজ্যের ধুন্ধুমার বিধানসভা নির্বাচন সামলেছিলেন। পর্যবেক্ষক প্রহ্লাদ জোশী তখন কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়ক মন্ত্রক সামলাচ্ছেন। ফলে উত্তরাখণ্ডে বেশি সময় দিতে পারেননি। তাই লকেট অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে পাহাড়ি রাজ্য চষে বেড়িয়েছিলেন। সে নির্বাচনে বিজেপি জেতায় লকেট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রশংসাও পান। তাঁর উপরে নেতৃত্বের ভরসা বাড়ে। ফলে শেষ নির্বাচনে জিততে না পারলেও সংগঠনে লকেটের গুরুত্ব কমানো হয়নি।

বিধায়ক অগ্নিমিত্রা বিধানসভার অন্দরে বিজেপির সক্রিয় মুখগুলির অন্যতম। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘বিশেষ আস্থাভাজন’। দলের সামনের সারির প্রতিনিধি হিসেবে নানা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় রোজই ছুটছেন। তার মধ্যেই নিয়ম করে প্রায় প্রতি সপ্তাহে নিজের বিধানসভা কেন্দ্রেও যান। যদিও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুরের মতো ‘জেতা’ আসনে হেরেছেন। তবে হতোদ্যম হননি। আগামী বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় অগ্নিমিত্রার নাম থাকা প্রায় পাকা।

এই দু’জনের আগেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন রূপা। মহিলা মোর্চার সভানেত্রী পদেও রূপা এঁদের পূর্বসূরি। বস্তুত, রূপার জমানা থেকেই বিজেপির মহিলা সংগঠনের পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। মাঠে-ময়দানে মহিলা মোর্চার নানা বিক্ষোভ-আন্দোলন নজরে কাড়ে। যদিও লকেট-অগ্নিমিত্রার মতো নির্বাচনী সাফল্য রূপা এখনও পাননি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হাওড়া উত্তর বিধানসভায় লড়ে হেরে যান। পরে তাঁকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত সাংসদ হিসেবে রাজ্যসভায় পাঠানো হয়। ২০২২ পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন। মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিছুটা অন্তরালেও চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে জাতীয় কর্মসমিতিতে রেখে দিয়েছিল। সম্প্রতি রাজ্যে আবার সামনের সারিতে উঠে আসতে শুরু করেছেন রূপা। বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁকে আবার অগ্রগণ্য ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। ভোটের দিকে তাকিয়ে তৈরি ‘ভাষ্যনির্মাণ সমিতি’র (ন্যারেটিভ কমিটি) বৈঠকে নিয়মিত থাকছেন। ফলে রূপাকে নিয়ে চর্চা বাড়ছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনে রূপা ফের বিজেপির অন্যতম তারকা প্রার্থী হিসাবে লড়বেন বলে এখনও পর্যন্ত খবর।

রূপা, লকেট, অগ্নিমিত্রার পরবর্তী দুই সভানেত্রী তনুজা চক্রবর্তী বা ফাল্গুনী পাত্র কি ততটা সফল? এ প্রশ্ন বিজেপির অন্দরে রয়েছে। তনুজা এবং ফাল্গুনী ‘আদি’ বিজেপি তো বটেই, ‘খাঁটি’ও। চটকের দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করে তাঁরা দলে আসেননি। যে পরিচিতি তৈরি করেছেন, তা শুধু রাজনীতির সূত্রেই। কিন্তু তাঁদের জমানায় মাঠে-ময়দানে মহিলা মোর্চার দাপট সে ভাবে নজরে পড়েনি। দু’জনকেই বিধানসভা নির্বাচনের টিকিটও দেওয়া হয়েছিল। দু’জনেই হেরেছেন। আরজি কর কাণ্ডের উত্তাল প্রতিবাদ চলাকালীন ফাল্গুনী ছিলেন মহিলা মোর্চার শীর্ষপদে। কিন্তু মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে সেই লাগাতার আন্দোলনে তাঁর সংগঠন কি আদৌ আলাদা ‘ছাপ’ ফেলতে পেরেছে? এ প্রশ্নের জবাব বিজেপির প্রথম সারির নেতারা এড়িয়েই যাচ্ছেন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাক্তন রাজ্য সাধারণ সম্পাদকের ব্যাখ্যা, ‘‘এ রাজ্যে মহিলা মোর্চা সম্ভবত গ্ল্যামার (চটক) দুনিয়া থেকে বিজেপিতে আসা প্রতিষ্ঠিত মুখেদের জন্য ভাল লঞ্চিং প্যাড। যাঁরা এই মঞ্চ থেকে যাত্রা শুরু করেছেন, তাঁরা দলেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছেন। আবার তাঁদের মেয়াদ চলাকালীন মহিলা মোর্চাও সংগঠন হিসেবে লাভবান হয়েছে। পরিপূরক সম্পর্ক বলা যায়।’’

তবে এর বিপরীত উদাহরণও রয়েছে। বিনোদন দুনিয়ার এক ঝাঁক পরিচিত মহিলা মুখ বিজেপিতে শামিল হয়েছিলেন। পায়েল সরকার, শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, তনুশ্রী চক্রবর্তী, পার্নো মিত্র, পাপিয়া অধিকারীরা ভোটে লড়েছেন। সকলে হেরেছেন। অঞ্জনা বসু, রূপাঞ্জনা মিত্র, শর্বরী মুখোপাধ্যায়, সুভদ্রা মুখোপাধ্যায়েরা দলের বৃত্তে বেশ কিছু দিন ঘোরাফেরা করেছেন। দাগ কাটতে পারেননি। অনেকে দল বদলে নিয়েছেন। তবে এঁদের ‘বিজেপি ভ্রমণ’ মূলত নির্বাচনভিত্তিক। সাংগঠনিক নয়। এঁরা কেউ মহিলা মোর্চার সভানেত্রী পদ সামলে আসেননি।

অগ্নিমিত্রার ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা যেহেতু রাজনীতিতে আসার আগেই নিজেদের একটা পরিচিতি তৈরি করেছিলাম, তাই আমাদের উপরে একটা প্রত্যাশার চাপ ছিল। সেই চাপটা মাথার উপরে ছিল বলেই বোধহয় মহিলা মোর্চার দায়িত্ব পেয়ে নিজেদের প্রমাণ করার তাগিদ আমাদের বেশি ছিল। তাই আমরা আপ্রাণ পরিশ্রম করেছি।’’ আসানসোল দক্ষিণের বিধায়ক অবশ্য একটি ‘বাড়তি সুবিধা’র কথাও উল্লেখ করছেন, ‘‘আমাদের পরিচিতি আমাদের অনেক জায়গায় পৌঁছোতে বা চট করে যোগাযোগ করতে সাহায্য করেছে। ফলে আমাদের কাজটা অন্যদের তুলনায় একটু সহজও ছিল।’’

সাংবাদিকতা থেকে রাজনীতিতে আগত কেয়া ঘোষ আবার সাবধানি। রূপা, লকেট, অগ্নিমিত্রার জমানায় মহিলা মোর্চা যে বেশি নজর কাড়ছিল, সে কথা পুরোপুরি অস্বীকার করছেন না। তবে সংবাদমাধ্যমের উপরেও কিছুটা দায় ঠেলছেন। বলছেন, ‘‘রূপাদি, লকেটদি, অগ্নিমিত্রাদি বিখ্যাত মানুষ। সংবাদমাধ্যমের নজর তাঁদের দিকে বেশি করে থাকত। কিন্তু তাঁদের আগে যাঁরা ছিলেন বা পরে যাঁরা এসেছেন, নেতৃত্ব বুঝেশুনেই তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন।’’ অর্থাৎ কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে, সেই তুল্যমূল্য বিচারে কেয়া যেতে চান না। তবে উল্লেখ করছেন, সেই সময়ের কথা, যখন তিনি নিজেও মহিলা মোর্চায় ছিলেন। বলছেন, ‘‘লকেটদির নেতৃত্বে আমাদের একটা বিক্ষোভ ছিল। রাস্তায় পুলিশ লকেটদির শাড়ি ছিঁড়ে ফালাফালা করে দিল! ওই রকম পরিচিত মুখকে প্রকাশ্য রাস্তায় ওই পরিস্থিতিতে পড়তে হলে সংবাদমাধ্যমের নজর সে দিকেই যাবে।’’ অর্থাৎ, অগ্নিমিত্রার উল্লিখিত ‘বাড়তি সুবিধা’।

জল্পনা একটাই— সফল এবং ব্যর্থদের উদাহরণ পাশাপাশি রেখে তুল্যমূল্য বিচার করে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি কি ‘বাড়তি সুবিধা’র দৃষ্টান্তের দিকে ঝুঁকবে? না কি গত বিধানসভা ভোটের ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখে পিছিয়ে আসবে!

Advertisement
আরও পড়ুন