লিয়োনেল মেসির সঙ্গে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ছবি: সংগৃহীত।
নীল-সাদা আগ্নেয়গিরির মুখে নীল-সাদা সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রী!
লিওনেল মেসির সফর ঘিরে শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে যে কেলেঙ্কারি ঘটল, তাতে নীল-সাদা জার্সিধারী মেসিভক্তদের চার্জশিটে যদি প্রথম অপরাধী হন প্রধান উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্ত, তা হলে দ্বিতীয় নামটি অবশ্যই রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। যিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আস্থাভাজন’ হিসাবেই পরিচিত।
যুবভারতীতে মেসি ছিলেন মেরেকেটে ১৬ থেকে ১৮ মিনিট। সেই সময়ের মধ্যেই অরূপ জনতার কাঠগড়ায়। দিন যত গড়িয়েছে, ততই মোবাইলে মোবাইলে ঘুরতে শুরু করেছে মেসির গায়ে লেপ্টে-থাকা অরূপের ছবি। যুবভারতীয় গ্যালারি ছাড়িয়ে দলের অন্দরেও সমালোচিত হতে শুরু করেছেন ক্রীড়ামন্ত্রী। বেলা যত গড়াতে থাকে, ততই যুবভারতী কেলেঙ্কারির ভয়াবহতা আরও প্রকাশ্যে আসতে থাকে। দেশজ তো বটেই, বিদেশি সংবাদমাধ্যমও কলকাতা শহরকে কাঠগড়ায় তুলে তুলোধনা করতে শুরু করে। তখন থেকেই প্রশাসনের অন্দরে জল্পনা তৈরি হয়, অরূপকে কি তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? অনেকে বলেন, অরূপ কি পদত্যাগ করবেন?
আনন্দবাজার ডট কমের তরফে অরূপকে ফোন করা হয়েছিল তাঁর বক্তব্য জানার জন্য। তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটস্অ্যাপে পাঠানো বার্তারও কোনও জবাব দেননি। তবে সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’
ক্রোধের বিস্ফোরণ: যুবভারতীর মেসি সফরের টিকিটে এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রয়োগ করে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপের এই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়েছে ক্রুদ্ধ জনতা। ছবি: সমাজমাধ্যম থেকে সংগৃহীত।
অরূপ কিছু না বললেও ইস্তফা সংক্রান্ত প্রশ্নের প্রত্যাশিত জবাব— না। শনিবার রাত পর্যন্ত তেমন কোনও খবর নেই। সবটাই জল্পনা। তবে এ-ও ঘটনা যে, অতীতে অরূপ এত বেকায়দায় কখনও পড়েননি। রাজ্যের ক্রীড়া এবং টলিউডের বিনোদন জগৎ ‘নিয়ন্ত্রণ’ করেন অরূপ। তারকাদের সঙ্গে তাঁর ছবি রাজ্যের মানুষের কাছে জলভাত। আগে মুখ ‘দেখাতে’ হত। এখন প্রতাপশালী মন্ত্রী হওয়ায় সেটিও করতে হয় না। তবে অরূপ ‘ছবিবিলাসী’ তো বটেই। এবং তা এখন নয়। বহুকাল ধরেই। কংগ্রেসি সংস্কৃতিতে ছবিতে মুখ দেখানোর একটা নিয়মিত অভ্যাস ছিল। তৃণমূলেও যে নেই, তা নয়। কিন্তু অরূপ সে বিষয়ে ‘চ্যাম্পিয়ন’। কলকাতা শহরে কোনও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রীড়াবিদ আসবেন আর অরূপকে তাঁর গায়ে সেঁটে থাকতে দেখা যাবে না, এমন ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম। অনেকে বলছেন, সেই অভ্যাসই কাল হল শনিবার।
সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ অরূপকে যখন প্রথমবার মাঠে দেখা গেল, তখন তিনি গ্যালারির আশপাশ, মেসির মাঠে প্রবেশের পথ ইত্যাদি জরিপ করছিলেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, তার সঙ্গে হাতকাটা কালো জ্যাকেট। তাঁকে ঘিরে পুলিশ এবং উদ্যোক্তাদের মেজো-সেজো কর্তরা। আঙুলের ইশারায় তাঁদের নানাবিধ বিষয় বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী।
মেসি আসছেন। সকাল থেকেই যুবভারতীর গ্যালারিতে ভিড়। একই মঞ্চে থাকবেন মেসি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা, শাহরুখ খান এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যাকে বলে ‘মেগা ইভেন্ট’। আশ্চর্য নয় যে, ক্রীড়ামন্ত্রী নির্ধারিত সময়ের ৪৫ মিনিট আগে মাঠে নেমে জমি জরিপ করবেন। কিন্তু তার এক ঘণ্টার মধ্যে যে যুবভারতী লন্ডভন্ড হয়ে যাবে, মমতা মাঝপথ থেকে কালীঘাট ফিরে যাবেন, সৌরভ নির্দিষ্ট সময়ে ঢুকতে পারবেন না এবং শাহরুখ স্টেডিয়ামে না গিয়ে সপুত্র হোটেল থেকেই ফিরে যাবেন কে জানত!
সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ যুবভারতীর চার এবং পাঁচ নম্বর গ্যালারির মাঝের পথ দিয়ে মেসির গাড়ি এসে থামে অ্যাথলেটিক ট্র্যাকের সামনে। গাড়ির বনেট দেখা যেতেই জনগর্জনে ফেটে পড়ে গ্যালারি। মেসি নামতেই মুহূর্তে তাঁকে ঘিরে ফেলেন শ’খানেক লোক। সেই জটলায় অরূপ যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন উদ্যোক্তাদের মধ্যে কোট-টাই পরা কিছু অপেশাদার এবং কিছু তরুণী। মেসি এগোচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে এগোচ্ছে একদল মানুষ। যা প্রায় ঢেকেই দিয়েছে পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির বিশ্বকাপজয়ী তারকাকে। সময় এগোচ্ছে, মেসি এগোচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে মানুষের দঙ্গলও এগোচ্ছে। হাজার হাজার টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যাঁরা মেসিকে দেখতে এসেছেন, তাঁরাই মেসিকে দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু সেই চলমান জটলার মধ্যে নিজস্বী তোলা দিব্যি চালু আছে।
ধৈর্য্যচ্যুতির শুরু তখনই। বেলা ১১ট ৩৯ মিনিটে হঠাৎ গ্যালারি কাঁপিয়ে স্লোগান উঠতে শুরু করে, ‘উই ওয়ান্ট মেসি’। সেই স্লোগানের লয় খানিকটা মিলে যাচ্ছিল আরজি কর পর্বের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’-এর সঙ্গে। সেটা শুনেই পোড়খাওয়া রাজনীতিক অরূপ সম্ভবত বুঝে গিয়েছিলেন, পরিস্থিতি বেগতিক। প্রথম তিনিই হাতে কর্ডলেস মাইক্রোফোন নিয়ে মেসিকে ঘিরে থাকা ভিড় সরাতে উদ্যোগী হন। কিন্তু ততক্ষণে বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে পড়েছে। তার পরে শতদ্রু। তিনিও ব্যর্থ।
বেলা ১১টা ৫০ নাগাদ জনপ্লাবনে মিলিয়ে গেলেন মেসি। ততক্ষণে গ্যালারিতে ক্রোধের বিস্ফোরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। জনতার হাতে ধরা ফোনে ফোনে ঘুরতে শুরু করল সেই ছবি, যেখানে মেসির বগলের নীচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন দন্তবিকশিত অরূপ। ততক্ষণে গ্যালারিতে হোর্ডিং ছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। তার পর শুরু বোতলবৃষ্টি। তার পরে চেয়ার ভেঙে তাণ্ডব। তারও পরে ফেন্সিং ভেঙে গলগল করে মানবস্রোত ঢুকে পড়ল মাঠে। চতুর্দিক থেকে। যাতে কার্যত ভেসে গেলেন অরূপও। তিনি যখন যুবভারতী ছেড়ে বেরোচ্ছেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান উঠতে শুরু করেছে।
ততক্ষণে অরূপের ‘সৌজন্যে’ বিরোধীরা ‘বিষয়’ পেয়ে গিয়েছে। তারা যখন কোমর বাঁধছে, তখনই কালক্ষেপ না করে টুইট করে মেসি এবং দর্শকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা। দোষ দেন যুবভারতীর অব্যবস্থাকে। ঘোষণা করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করারও।
যুবভারতীতে যখন মাঠজুড়ে তাণ্ডব শুরু হয়েছে, তখন অরূপকে ঘিরে আন্দোলিত হতে শুরু করে তৃণমূলের অন্দরমহল। এক প্রথম সারির মুখপাত্র ঘনিষ্ঠদের ফোন করে বলতে শুরু করেন, ‘‘অরূপ ইস্তফা দিচ্ছে কিনা খেয়াল রাখিস! দিদি কিন্তু বলে দিতে পারেন।’’ যদিও শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে হবে, এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে অরূপের সূত্রেই নতুন করে তৃণমূলের অন্দরের আলোচনায় ‘প্রাসঙ্গিক’ হয়ে উঠেছেন মদন মিত্র। যিনি মমতার প্রথম সরকারের ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন।
ঘটনাচক্রে, ১৪ বছর আগে মদনের ক্রীড়ামন্ত্রিত্বের সময়েই প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন মেসি। আর্জেন্টিনা ফুটবল দল প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিল ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে। সে দিনও যুবভারতী ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু কোনও অব্যবস্থা ছিল না। সেই সূত্রেই শাসকদলের অনেকে বলছেন, মদন ‘যোগ্যতর’ ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন। তবে এ-ও ঠিক যে, মেসি সে বার খেলতে এসেছিলেন। তিনি কোনও ‘স্পোর্টস প্রমোটার’-এর ব্যবসায়িক উদ্যোগের অংশ হয়ে আসেননি। তখন মেসিকে দেখতে বা তাঁর খেলা দেখতে হাজার হাজার টাকার টিকিট কাটতে হয়নি। দ্বিতীয়ত, ১৪ বছর পরে এই মেসির আকর্ষণ গগনচুম্বী। তাঁর নেতৃত্বেই শেষ বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্তিনা। এই মেসি স্বপ্নপূরণের ঈশ্বর। ফলে তাঁকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও নজিরবিহীন।
মদন-ভক্তেরা অবশ্য বলছেন, এই মেসির জন্যই বরং আরও বেশি ‘সতর্ক এবং সজাগ’ থাকা উচিত ছিল ক্রীড়ামন্ত্রীর। তাঁদের ‘দাদা’ থাকলে এই জায়গাটায় কোনও আপস করতেন না। মদন নিজে স্বভাবতই অবশ্য অরূপের সঙ্গে তাঁর তুলনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠেরা বলছেন, ‘ওহ লাভলি!’